এগিয়ে যাচ্ছে স্টার্টআপ

বাংলাদেশে এখন ১ হাজার ২০০-এর বেশি সচল স্টার্টআপ আছে। এ খাতে বিনিয়োগ আসছে, বড় অংশই বিদেশি।

স্টার্টআপ বাংলাদেশ লোগো

বাসার গৃহকর্মী প্রায়ই আসতেন না। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে পাওয়া যায়, তা ভাবতেই মাথায় এল, ‘পাঠাও’তে যদি যখন খুশি রাইডার পাওয়া যেতে পারে, তাহলে গৃহকর্মী কেন নয়? পাঁচ বছর আগের এই ভাবনা থেকেই আজকের ‘হ্যালো টাস্কে’র যাত্রা। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হাসানের ভাষায়, ‘বাংলাদেশে সমস্যা যেমন বেশি, তেমনি সেগুলোর সমাধানও প্রয়োজন। আর সেখানেই স্টার্টআপের সুযোগ।’

স্টার্টআপ হচ্ছে এমন কোনো নতুন উদ্যোগ, যারা একেবারেই নতুন ধরনের (ইউনিক) পণ্য বা পরিষেবা নিয়ে কাজ করে। যে পণ্য বা পরিষেবার বাজার আছে এবং যার বিকল্প নেই। স্টার্টআপের উদ্যোক্তারা এমন ভাবনা নিয়ে আসে, যার সমাজে চাহিদা আছে কিন্তু জোগান নেই। অর্থাৎ হ্যালো টাস্কের মতোই।

শহুরে জীবনে গৃহকর্মীর সহায়তা সবারই প্রয়োজন। এর বিকল্প নেই। তাই অ্যাপের মাধ্যমে ডাকলেই এখন চাহিদা অনুযায়ী গৃহকর্মী হাজির হবে। এককথায় বলা যায়, স্টার্টআপ হচ্ছে সমাজের প্রচলিত সমস্যার সমাধানভিত্তিক ব্যবসা।

বিশ্বব্যাপীই স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ কমছে। বাংলাদেশের স্টার্টআপেও তার প্রভাব পড়ছে। তাই এখনই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের সময়।
এ কে এম ফাহিম মাশরুর, প্রতিষ্ঠাতা, বিডিজবস

দেশের উঠতি পর্যায়ের স্টার্টআপ হ্যালো টাস্ক এখন পর্যন্ত এক মিলিয়ন ডলার (১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা) বিনিয়োগ পেয়েছে। যার বেশির ভাগই এসেছে দেশের বাইরে থেকে। মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের চাকরির প্ল্যাটফর্ম হতে চাই। যেখানে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকেরা স্মার্টফোন ব্যবহার না করলেও তাঁদের প্রযুক্তিগতভাবে সংযুক্ত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। পাশাপাশি মানুষও নির্বিঘ্নে সেবা পাবে।’

বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর থেকে স্টার্টআপের ধারণা বিস্তৃত হতে থাকে। দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইট ক্যাসল পার্টনারের গত জুলাইয়ে ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ২০২১-২২’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে দেশের স্টার্টআপের পরিস্থিতি জানা যায়। সেখানে বলা হয়, দেশে এখন ১ হাজার ২০০-এর বেশি সচল স্টার্টআপ আছে। ২০২১ ও ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫০৫ মিলিয়ন ডলার (৫ হাজার ৩০২ কোটি টাকা) বিনিয়োগ পেয়েছে, যার মধ্যে ৪৯৮ মিলিয়ন ডলার (৫ হাজার ২২৯ কোটি টাকা) ছিল বিদেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৮০৪ মিলিয়ন ডলারের (৮ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা) বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে ২৩২টি চুক্তি থেকে। ২০২২-এর প্রথম ছয় মাসেই এসেছে ৯০ মিলিয়ন ডলার (৯শ ৪৫ কোটি টাকা) বিনিয়োগ।

বাংলাদেশে স্টার্টআপে ২০২০ থেকে ২০২১ সালে ১০ গুণ বিনিয়োগ বেড়েছে। স্টার্টআপে যেসব বিনিয়োগ আসছে, তার ৯৫ শতাংশের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ।

স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের ৭০ শতাংশের বেশি হয়েছে ফিনটেকে (আর্থিক প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান)। এরপর লজিস্টিক ও মোবিলিটিতে ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ই-কমার্স ও রিটেইলে প্রায় ৬ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাত আড়াই শতাংশ, কনজ্যুমার সেবায় ২ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং সফটওয়্যার ও প্রযুক্তিতে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগ এসেছে।

সরকারের স্টার্টআপ খাতকে বিকশিত করার নানান উদ্যোগের কথা জানিয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ প্রথম আলোকে বলেন, উন্নত বিশ্বে স্টার্টআপরাই সমাজকে এগিয়ে নিয়েছে। সরকারও সে লক্ষ্যে এগিয়েছে। স্টার্টআপ নীতিমালার খসড়া হয়েছে, এখন পর্যালোচনা হচ্ছে; যেখানে স্টার্টআপের জন্য সরকারের কোন সংস্থার কী ভূমিকা থাকবে এবং ব্যাংক থেকে যাতে তারা ঋণ পায়, সে বিষয়গুলোর উল্লেখ থাকবে।

করোনা মহামারির পরই বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। এই সময়টায় মানুষের প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ে। যার ফলে ই-কমার্স, স্বাস্থ্য খাতকেন্দ্রিক পরিষেবার চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টার্টআপগুলোও নিজেদের মেলে ধরে। এ ছাড়া গত এক দশকে স্টার্টআপ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশের মানুষের জীবনে নানামুখী পরিবর্তন এনেছে। বিকাশ, পাঠাও, শপআপ, চালডাল এখন ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশের বাজারকে ‘ফ্রন্টিয়ার বাজার’ বলা হয়, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নজর থাকে। মানুষ স্মার্টফোন, ইন্টারনেটসহ নানান প্রযুক্তির সঙ্গে অভ্যস্ত হচ্ছে। বড় বাজার গড়ে উঠছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেটা বুঝতে পারছেন। পাশাপাশি স্টার্টআপের দিকে দেশের বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আগ্রহও বাড়ছে।

দেশের স্টার্টআপ খাতের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি ভূমিকাও রয়েছে। বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে সরকার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ৫০০ কোটি টাকা মূলধনের স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন করেছে। এ ছাড়া আইডিয়া নামে আরেকটি প্রকল্প আছে, যেখান থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে অনুদান দেওয়া হয়। সরকার স্টার্টআপ নীতিমালাও করতে যাচ্ছে।

দেশের স্টার্টআপগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগের দাপট থাকলেও সার্বিক কাঠামো তৈরিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অনেক। ব্র্যাক, গ্রামীণফোন, রবি, হুয়াওয়েসহ কিছু প্রতিষ্ঠান দেশের স্টার্টআপ তৈরিতে নিয়মিত নানান আয়োজন করে আসছে।

কর্মসংস্থান তৈরিতে স্টার্টআপের ভূমিকার কথা বলেন বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা এ কে এম ফাহিম মাশরুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের স্টার্টআপ সেবা এখনো রাজধানী ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক।

একে বিকশিত করতে সরকারকে সে অনুযায়ী অবকাঠামো অর্থাৎ ডিজিটাল গ্রাহক তৈরির পথ করে দিতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আসন্ন মন্দার কথা উল্লেখ করে ফাহিম মাশরুর বলেন, বিশ্বব্যাপীই স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ কমছে। বাংলাদেশের স্টার্টআপেও তার প্রভাব পড়ছে। তাই এখনই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের সময়।