‘কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত

এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের আয়োজনে ‘কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা হয়েছে গতকাল রোববারছবি: সংগৃহীত

পেডিয়াট্রিক অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট গাইনোকলজি সোসাইটি বাংলাদেশ (পিএজিএসবি) এবং দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের আয়োজনে ১০ মার্চ অনলাইনে বিশেষ গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা।

আলোচনায় সভাপতি হিসেবে ছিলেন পিএজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক কোহিনূর বেগম। মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পিএজিএসবির মহাসচিব অধ্যাপক গুলশান আরা।

আলোচনার শুরুতেই অধ‌্যাপক গুলশান আরা বিশ্বের এবং বাংলাদেশের কিশোরী স্বাস্থ্যের অবস্থা তুলে ধরেন। দেশে তিন কোটির বেশি কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ৫০ শতাংশই কিশোরী। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী কিশোরী স্বাস্থ্য একটি অবহেলিত বিষয়। প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার কিশোরী মারা যায়, যার অন্যতম কারণ আঘাত ও সহিংসতা। বাংলাদেশের ৫৪ শতাংশ কিশোরীর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করে থাকে। কিশোরকালীন রক্তস্বল্পতার হার ৪৩ শতাংশ। তবে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, পুষ্টিহীনতা ও সহিংসতা বিষয়ের সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক লতিফা সামসুদ্দিন, অধ্যাপক রওশন আরা বেগম, অধ্যাপক সামিনা চৌধুরী, অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম, সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান, সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক সালেহা বেগম চৌধুরী, মহাসচিব অধ্যাপক সালমা রউফ, ট্রেজারার অধ্যাপক বেগম নাসরিন, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক দিপি বড়ুয়া ও অধ্যাপক সেহেরিন ফরহাদ সিদ্দিকা, সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি অধ্যাপক ফাতেমা রহমান এবং পিএজিএসবি ট্রেজারার অধ্যাপক ইফফাত আরা।

আলোচক চিকিৎসকেরা বাংলাদেশের কিশোরীদের স্বাস্থ্য নিয়ে চলমান চিকিৎসাপদ্ধতির ওপর আলোচনা করেন। বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতে তাদের স্বাস্থ্যের যত্নে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেন। এ ছাড়া প্রথমবার গর্ভধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সচেতনতামূলক উপদেশ দেওয়া হয়। গর্ভাবস্থায় এবং গর্ভধারণের আগে কী করণীয় এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার ভয়াবহতাও উঠে আসে তাঁদের আলোচনায়। এ ছাড়া নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থানের কথাসহ প্রতিনিয়ত নারীরা রাস্তায় বা তাঁদের কর্মস্থলে যেসব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন, সেগুলো নিয়েও আলোচনা করেন তাঁরা।

সুরক্ষার ক্ষেত্রে ছোট ছোট কাজের প্রসঙ্গ টেনে পিএজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক কোহিনূর বেগম বলেন, ছোট কাজ বলতে কিশোরীর প্রজনন, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। সকল প্রকার নির্যাতন থেকে তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যার অন্যতম হচ্ছে বাল্যবিবাহ। এটি রোধ করলে তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে।’

ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক লতিফা সামসুদ্দিন যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সম্পর্কে বলেন, ‘জরিপে উঠে এসেছে, প্রতি তিনজনে একজন নারী সহিংসতার শিকার হন। এটি প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ, আমাদের সঙ্গে নারীরা আছে, পুরুষেরাও আছে। নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের বলতে হবে—আমরা নারী, আমরা সব পারি। আমরা জয় করতে পারি।’

কিশোরী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় লিঙ্গ ভারসাম্যের ব্যাপারে ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম গুরুত্ব দিয়ে বলেন, লিঙ্গসমতা থাকতে হবে। ছেলে হোক বা মেয়ে—সমাজে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে বুঝতে হবে। সমাজে ছেলে-মেয়ের সমতাটা অবশ্যই স্বয়ংক্রিয় এবং ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।’

অনিরাপদ গর্ভপাত সম্পর্কে ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেন, অধিকাংশ কিশোরী, যাঁরা অনিরাপদ গর্ভপাত করেন, তাঁরা গর্ভধারণই চাননি। তাই, আমাদের যে স্লোগান আছে—আঠারোর আগে বিয়ে নয়, বিশের আগে গর্ভধারণ নয়; এটা মাথায় রাখতে হবে। নিরাপদ গর্ভধারণের বিষয়গুলো কিশোরীদের জানাতে হবে। এক গর্ভধারণ থেকে আরেকটা গর্ভধারণ পর্যন্ত কতটুকু বিরতি থাকবে সেটাও তাদের বলতে হবে।

ওজিএসবির সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক সালেহা বেগম চৌধুরী কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে। এটা কেন হয়? কারণ, তাদের আবেগ বেশি কাজ করে। সে জন্য মানসিক অবসাদে ভোগে। আরেকটা হচ্ছে, পড়াশোনার চাপের কারণে তারা একাকিত্বে ভোগে। তারা খেলাধুলা বাদ দিয়ে ডিভাইসে আসক্ত হয়ে গেছে। এ জায়গাগুলোতে কাজ করলেই মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শরীরচর্চা থাকতে হবে। বাবা-মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।  

দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিষয়ে ওজিএসবির মহাসচিব অধ্যাপক সালমা রউফ বলেন, বিভিন্ন জরিপে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৫০ ভাগ কিশোর-কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগে। এতে করে তাদের প্রজননস্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষা পাওয়ার অধিকার বাধাগ্রস্ত হয়। তাই কোন পরিস্থিতির মুখে পড়ে অভিভাবকেরা সন্তানকে বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন, সে জায়গায় কাজ করতে হবে।  

জরিপে উঠে এসেছে, বয়ঃসন্ধিকালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাজনিত সমস্যায় পৃথিবীতে প্রতিবছর আট লাখ কিশোরী মারা যায়। এর থেকে সুরক্ষার উপায় সম্পর্কে ওজিএসবির ট্রেজারার অধ্যাপক বেগম নাসরিন বলেন, ‘মা-বাবা-শিক্ষকদের কিশোরীদের মাসিক হওয়ার আগেই এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এর স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক ব্যাপারগুলো বোঝাতে হবে। মাসিককালে এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলো জানাতে হবে। তাহলেই এ ধরনের ক্ষতির হাত থেকে আমরা বাঁচতে পারব।’

ওজিএসবির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক দিপি বড়ুয়া বলেন, ১০-১৫ বছর হচ্ছে শরীর বৃদ্ধির উপযুক্ত সময়, তখন কাঠামোগত পরিবর্তন হয়। এ সময়টায় শরীরে খাদ্যের চাহিদা বেশি থাকে। সে কারণে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। পুষ্টিহীনতা এবং অতিপুষ্টি কিন্তু অপুষ্টিরই অন্তর্গত। ফলে কিশোরীদের স্থূলতার সমস্যা হচ্ছে। কারণ, তারা বাইরের খাবার বেশি খাচ্ছে। তাই তাদের বাইরের খাবার বাদ দিয়ে ঘরে তৈরি খাবার খেতে হবে।

স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে ওজিএসবির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক সেহেরিন ফরহাদ সিদ্দিকা বলেন, হেলথ অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামগুলো স্কুল-কলেজের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর আয়োজন করতে হবে। তাহলেই কিশোর-কিশোরীরা সচেতন হতে পারবে।

এত সচেতনতার পরও বাংলাদেশের ৪৬ ভাগ তরুণী ১৯ বছরের আগেই গর্ভধারণ করে। এসব তরুণীকে যত্নের বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে ওজিএসবির সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি অধ্যাপক ফাতেমা রহমান বলেন, আগে বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে। তবু যদি হয়েই যায়, অবশ্যই গর্ভধারণ ও ডেলিভারির সময় প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ নিতে হবে। তবেই জটিলতা কম হবে।

পিএজিএসবি ট্রেজারার অধ্যাপক ইফফাত আরা বলেন, ‘প্রি-পিউবিটাল কেয়ার’ নামক নতুন একটি বিষয় নিয়ে। কোন কোন লক্ষণ দেখলে কিশোরীরা গাইনোকোলজিস্টের শরণাপন্ন হবে, সে বিষয়ে আলোকপাত করে তিনি বলেন, ‘অনেকে এটাকে বড় ধরনের সমস্যা মনে করেন। আসলে এটা হরমোনজাতীয় একটা সমস্যা। এটা মাসিকের আগেই হয়ে থাকে। এটা হলে চুলকানি হবে, স্রাব হবে, প্রস্রাবের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে মনে হতে পারে। একটা ক্রিম ব্যবহার করলেই এই সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। সে জন্য গাইনোকোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। অভিভাবকেরা ঘাবড়ে না গিয়ে সঠিক চিকিৎসাটা নিশ্চিত করবেন।’

সর্বোপরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারকে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতে হবে বলে সবাই জানান। পাশাপাশি স্কুলে প্রায় ১ হাজার ৩০০ ‘অ্যাডলসেন্ট কর্নার’ স্থাপনকে কিশোরীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি মাইলফলক হিসেবে অবহিত করেন আলোচকেরা। সেই সঙ্গে এর কার্যকারিতা ও চর্চা যেন অব্যাহত থাকে, সে বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়।

অনুষ্ঠানে চিকিৎসকদের সঙ্গে একাত্ম থাকতে পেরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এসকেএফের বিক্রয়প্রধান মাসুদ মহিউদ্দিন খসরু। ভবিষ্যতেও এ ধরনের বৈজ্ঞানিক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত থাকতে এসকেএফের আগ্রহের কথা জানান।
অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন এসকেএফের মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের চিকিৎসক ব্যাপ্তি রায়। সায়েন্টিফিক পার্টনার হিসেবে ছিল এসকেএফ এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ‘অস্টোক্যাল জিএক্স’।