পাঠকের লেখা–৬১
ছোট বোনের শ্বশুরবাড়ি
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম–ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
অনেক বছর ধরে যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। আসলে অপেক্ষা করছিলাম পদ্মা সেতুর জন্য। শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো গত ২ এপ্রিল। আমরা উত্তরার বাসা থেকে রওনা করলাম সকাল ৮টা ২০ মিনিটে। গাড়িতে আমার পরিবার, সঙ্গে মা। যাচ্ছি শরীয়তপুর সদর উপজেলার বুড়িরহাটের মুন্সিবাড়ি। আমার ছোট বোনের শ্বশুরবাড়ি।
রাস্তাঘাটে লোকজন তেমন নেই। চারপাশে মুগ্ধ করার মতো পরিবেশ। আমরা যাচ্ছি আর গল্প করছি। ইচ্ছা হলে ছবি তুলছি। ভিডিও করছি।
১১টা ১০–এ আমরা মুন্সিবাড়ির গেটে পৌঁছে গেলাম। মস্ত বড় গেট পার হয়ে আমাদের গাড়ি বাড়ির ভেতরে চলে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল আমার ছোট বোনের জামাই রাজু, ভাগনে মাহিদ, আরও কেউ কেউ। বাড়ির গেট খুললেই চোখে পড়ল কাঠের একটা পুরোনো দোতলা কাছারিঘর।
পাকিস্তান আমলে আমার বোনের দাদাশ্বশুর ছিলেন এখানকার চেয়ারম্যান। তখন চেয়ারম্যানকে বলা হতো প্রেসিডেন্ট। তিনি এই ঘরে বসে কাজকর্ম করতেন। বিচার–সালিস করতেন। ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
কাছারিঘরের দুই পাশ দিয়ে দুটি রাস্তা চলে গেছে বাড়ির ভেতর। আমরা বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে ঢুকলাম। ভেতরে কাঠের গেট পেরোলেই পুরোনো সব ঘর। বাড়িটিতে বড় বড় প্রায় ১০টি এ রকম ঘর আছে। একটা ঘরের ভেতর অনেকগুলো কক্ষ।
আমরা ভেতরে চলে গেলাম। আমাদের জন্য ফুল ও মিষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সবাই । একে একে আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করা হলো। মিষ্টিমুখ করানো হলো সবাইকে। আমরাও সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলাম। তারপর নানা রকম মিষ্টি, পায়েস, ফলমূল দিয়ে নাশতার আয়োজন। গাছ থেকে ডাব পাড়া হলো। জম্পেশ নাশতার পর আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাড়িটা একটু ঘুরে দেখার জন্য।
বাড়ির দুই পাশে দুটো পুকুর, ঘাট বাঁধানো। পুকুরের পাশেই বারবিকিউ করার জায়গা। জানলাম পুকুরঘাটে বিকেলবেলা বসে সবাই গল্প করে। আমার ছেলেমেয়েরা তো গিয়েই পুকুরে নেমে গেল। আমিও আর বাধা দিলাম না।
এ বাড়িটা মূলত আমার বোনের চার দাদাশ্বশুরের। তাঁরা কেউ দেশে থাকতেন, কেউ বিদেশে। তাঁদের ছেলেপুলেরা আছেন। তাঁরাও অনেকে দেশের বাইরে থাকেন। বেশির ভাগই থাকেন ঢাকায়। শত ব্যস্ততার মধ্যেও নানা উপলক্ষে বাড়িতে গিয়ে সময় কাটান তাঁরা। আমার ছোট বোনের ভাশুর সুফি ভাই আর চাচাশ্বশুর বাবু চাচা দুজনে মিলে এ বাড়ির সবকিছু দেখভাল করেন।
এ বাড়িতে আমরা যা–ই দেখছিলাম, তাতেই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমার বোনের ভাশুর বাজারে গিয়ে প্রতিদিন নানা রকম মাছ, সবজি, ফলমূল আর বাচ্চাদের খাবার কিনে আনছিলেন। আর তাঁদের পুকুরের মাছ তো ছিলই। আমরা যাওয়ার পর ঢাকা থেকে আমার বোনের চাচিশাশুড়ি, ওনার বোন, আরও দুজন চাচাতো ভাই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন়। বাড়িতে আগে থেকেই আত্মীয়স্বজন ছিল। সব মিলে ৩০–৩৫ জন প্রতি বেলায় একসঙ্গে খাবার খেয়েছি।
এ বাড়ির নিয়মই হচ্ছে এক ঘরে মেহমান এলে পাশের চাচিরাও তখন একসঙ্গে হয়ে যান। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি, আমার স্বামী, বোনের ছেলেমেয়ে চলে গেলাম একটা ইজিবাইক ভাড়া করে এলাকাটা ঘুরে দেখতে। অটোওয়ালা আমাদের নিয়ে গেল একটা বড় দিঘির পাশে। সেখান বিভিন্ন খাবারের দোকান। ওখানে নেমে আমরা অনেক ছবি তুললাম। সবুজে ঘেরা চারদিকটা ভালো লাগছিল।
ওখান থেকে ফিরে এসে দেখি, দুটি খাসি জবাই করার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। দুপুরের মধ্যে এলেন আরও আত্মীয়স্বজন। রাতের খাবার খেলাম প্রায় ১০০ জন। সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের দাওয়াত ছিল বাবু চাচার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখি, তাঁর অনেক বন্ধুবান্ধব এসেছেন। উনি বারবিকিউর আয়োজন করলেন। বাচ্চারা খুব হইহুল্লোড় করল।
এই বাড়ির চারপাশে অনেক হিন্দু বসতি। সেখানে চলছিল বাসন্তীপূজা। পূজামণ্ডপের গানবাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এখানকার মানুষের সম্প্রীতি দেখে মুগ্ধ হলাম।
চারদিকে আজ যেখানে ভাঙনের সুর, সেখানে শরীয়তপুরের বুড়িরহাটের এই মুন্সিবাড়ির সদস্যরা তাঁদের একতা দিয়ে পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন, যা দেখে আমি অনেক কিছু শিখলাম।