আইন ভেঙে গম কেনায় তৃতীয় পক্ষ

জিটুজি পর্যায়ে বেসরকারি পক্ষকে যুক্ত করার সুযোগ নেই। তবু দুজনকে যুক্ত করে বেশি দামে গম কেনা হচ্ছে

গণখাতে ক্রয় আইন লঙ্ঘন করে রাশিয়া থেকে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) পাঁচ লাখ টন গম কেনায় তৃতীয় একটি পক্ষকে যুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে পড়তির দিকে থাকলেও ওই পক্ষের মাধ্যমে এই গম কেনা হচ্ছে বেশি দামে।

বিশ্ববাজারে রাশিয়ার গমের দাম এখন প্রতি টন ৩০০ ডলারের কিছু বেশি। তবে এখন এই গম পরিবহন ব্যয়সহ ৪৩০ ডলারে কেনা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বেশি দামে গম কেনার ব্যাপারে খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই দাম সব বিবেচনায় সবচেয়ে কম। এতে বাংলাদেশ লাভবান হবে।

গণখাতে ক্রয় আইন অনুযায়ী, সরকারি পর্যায়ে ক্রয় প্রক্রিয়ায় বেসরকারি তৃতীয় কোনো পক্ষ থাকবে না। এ ছাড়া ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জিটুজি পর্যায়ে পণ্য কেনার বিষয়ে জারি করা একটি পরিপত্রেও বলা হয়েছে, দাম নির্ধারণ ও সমঝোতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর আটজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি থাকবে।

কিন্তু রাশিয়ার গম ক্রয়সংক্রান্ত পুরো প্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ন্যাশনাল ইলেকট্রিক নামের একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান সাত্তার মিঞা ও তাঁর ভাই ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিরুজ্জামান যুক্ত আছেন।

জিটুজি ক্রয়সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে, দাম নির্ধারণবিষয়ক সরকারি কমিটির সভাপতি হবেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব বা অতিরিক্ত সচিব। সদস্যসচিব থাকবেন একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব। এর বাইরে অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মনোনীত ব্যক্তি থাকবেন। এর বাইরে বেসরকারি তৃতীয় কোনো পক্ষ থাকবে না।

জানতে চাইলে খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিঞা সাত্তার ও আমিরুজ্জামানকে আমি আগে চিনতাম না। গমের দাম নিয়ে ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের দিন তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁরা সমঝোতায় সহযোগিতা করেছেন।’

মুঠোফোনে সাত্তার রাশিয়া থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু জানতে হলে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলুন।’

দাম কমার পর দরপত্র বাতিল

খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের সাবেক দুই পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, ২০১০ সাল থেকে সরকারি পর্যায়ে বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানির ক্ষেত্রে আরেকটি নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে। সেটি হচ্ছে, জিটুজি পর্যায়ে বিশ্বের কোন দেশ থেকে কত দামে গম কেনার চেষ্টা করা হবে, তা বোঝার জন্য প্রথমে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মাধ্যমে বিশ্ববাজারে দাম সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তারপর উন্মুক্ত দরপত্রের চেয়ে কম দামে ওই পণ্য কেনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে দরদাম করা হতো।

এবারও খাদ্য অধিদপ্তর থেকে ৫০ হাজার টন গম কেনার জন্য গত ১৭ আগস্ট একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরই মধ্যে আগস্টের শেষের দিকে প্রতি টন ৪৩০ ডলার করে রাশিয়ার সঙ্গে গম কেনার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়। তত দিনে বিশ্ববাজারেও গমের দাম কমতে শুরু করেছে। আগস্টের শেষে দাম ৩০০ ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। একই সময়ে খাদ্য অধিদপ্তর গত ২৯ আগস্ট ওই দরপত্র বাতিল করে।

১৩ সেপ্টেম্বর বিশ্বের দানাদার খাদ্যের আন্তর্জাতিক বাজার ও দামবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়াসহ বিশ্বের চারটি দেশে চলতি মৌসুমে গমের ভালো ফলন হয়েছে। তাই এক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যটির দাম দ্রুত কমছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে রাশিয়ার গমের দাম। এক মাসে দেশটির গমের রপ্তানি মূল্য টনে ৩৬ ডলার কমে ৩১৩ ডলারে নেমে এসেছে।

রাশিয়ায় কারা গম রপ্তানি করে

আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়ার গমের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ইউনাইটেড গ্রেইন কোম্পানি (ওজেডকে)। তবে বাংলাদেশ সরকার গম আমদানির জন্য চুক্তি করেছে রাশিয়ার আরেক খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রডিনটর্গের সঙ্গে।

১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রডিনটর্গ এখন স্বল্প জনবল দিয়ে চলছে। এই প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে ন্যাশনাল ইলেকট্রিক বিডি লিমিটেড।

২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ইলেকট্রিক মূলত জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত নিয়ে কাজ করে। তারা রাশিয়ার সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি কোম্পানির বাংলাদেশ প্রতিনিধি। কোম্পানিটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়ার কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি রাশিয়া ছাড়াও নিজেদের চীন, ইউক্রেন, দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন কোম্পানির আন্তর্জাতিক অংশীদার বলে দাবি করছে।

ন্যাশনাল ইলেকট্রিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করি। গম রপ্তানিতে তারা আমাদের পরামর্শ চেয়েছে। তাই তাদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছি। এর বাইরে কিছু বলতে চাই না।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য বাংলাদেশে বিক্রির ক্ষেত্রে এই দুই ভাই সমঝোতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশে রাশিয়ার গম প্রতি টন ৪৩০ ডলারে বিক্রির সমঝোতায় তাঁদের ভূমিকা রয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সরকারি গুদামে বর্তমানে ১৯ লাখ ৬৪ হাজার টনের বেশি খাদ্যশস্য (চাল ও গম) মজুত আছে।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে সরকার আমদানির ক্ষেত্রে সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে। তারপরও খাদ্য মন্ত্রণালয় কেন বেশি দামে এই গম কিনছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যাঁদের মাধ্যমে এই গম আনা হচ্ছে, তাঁদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলে, তা–ও অনুসন্ধান করা দরকার। বিপদের সময়ে এ ধরনের ক্রয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের বড় অপচয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।