মাহিয়া মাহিকে গ্রেপ্তার: পুলিশের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কেন বাতিল করতে হবে, আইনটি কতটা ভয়াবহ হতে পারে—মাহিয়া মাহির ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়েছে।

মাহিয়া মাহি

ফেসবুক লাইভকে কেন্দ্র করে অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও বিদেশ থেকে ফেরার পরপর বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তারসহ গাজীপুর পুলিশের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে এটাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেক অপপ্রয়োগ বলেও মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা।

মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সংক্ষুব্ধ কোনো নাগরিক অসন্তোষ, অভিযোগ প্রকাশ করতে পারেন। পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা নিয়ে তদন্ত হতে পারে। অভিযোগ সত্য না হলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা মানহানির মামলাও করতে পারেন। কিন্তু তা না করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে মাহিয়া মাহির বিরুদ্ধে।

আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মাহিয়া মাহির বিরুদ্ধে তো ফৌজদারি অপরাধে মামলা হওয়ারই কথা নয়। মাহিয়া মাহি কারও চরিত্র হরণ করে থাকলে দেওয়ানি মামলা হতে পারত। তিনি যদি অন্তঃসত্ত্বা না–ও হতেন, তবু তাঁর সঙ্গে এ ধরনের আচরণ কেউ করতে পারেন না। তিনি তো দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন না। তিনি বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মাহির। তারপর যে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটে গেল তাতে মনে হচ্ছে, সবার বেলায় আইন একইভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। মাহির বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার এবং তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন সারা হোসেন।

জমি নিয়ে বিরোধের জেরে গাজীপুরে মাহির স্বামী রকিব সরকারের গাড়ির শোরুম ভাঙচুর করা হয় বলে গত শুক্রবার ফেসবুক লাইভ করেন এই চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। তাতে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধেও তিনি অভিযোগ তোলেন। পরদিন মাহি ও তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেয় পুলিশ। তাতে অভিযোগ করা হয়, মাহি ও তাঁর স্বামী অপমান, অপদস্থ ও হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মিথ্যা, বানোয়াট, আক্রমণাত্মক, কুরুচিপূর্ণ ও মানহানিকার তথ্য প্রচার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপরাধ করেছেন।

মাহিয়া মাহি সৌদি আরব থেকে ওমরাহ পালন শেষে ঢাকায় ফেরার পর গত শনিবার সকালে বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে গাজীপুর মহানগর পুলিশ। তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ারও আবেদন করা হয়। রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। অবশ্য পরে আদালত অন্তঃসত্ত্বা এই নারীর জামিন মঞ্জুর করেছেন। একই মামলায় মাহির স্বামী রকিব সরকারকেও পুলিশ আসামি করে। তবে গতকাল রোববার রকিব দেশে ফিরলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

মুক্তি পাওয়ার পর শনিবার রাতে সংবাদ সম্মেলন করে মাহিয়া মাহি বলেন, তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ যেভাবে তৎপরতা চালিয়েছে, তাতে নিজেকে ‘যুদ্ধাপরাধী’, ‘দেশদ্রোহী’র মতো অপরাধী মনে হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, গোটা পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি।

এই ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে এমন আলোচনাও হচ্ছে যে মাহিয়া মাহি ফেসবুক লাইভে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার শিকার এবং দেশের মাটিতে পা দিয়েই গ্রেপ্তার হয়েছেন। অপরদিকে পুলিশ খুনের আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুবাই থেকে একাধিকবার দেশে এলেও পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলোকে বলেন, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে গ্রেপ্তার এ বার্তাই দিচ্ছে যে দেশে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ঘটছে না। অথচ জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেও নারী, অসুস্থ ব্যক্তি বা শিশুরা অগ্রাধিকার পায়। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কেন বাতিল করতে হবে, আইনটি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, মাহিয়া মাহির ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়েছে।