সরকারি নতুন ভবন
ছিটকিনি লাগে না, দেয়ালে শেওলা
সরকারি কর্মচারীদের জন্য ২১০ কোটি টাকায় চারটি ২০ তলা ভবন নির্মাণ শেষ হয় ২০১৮ সালে। এর মধ্যেই দুরবস্থা।
রাজধানীর মতিঝিলে সরকারি কর্মচারীদের আবাসনের জন্য নির্মিত নতুন চারটি বহুতল বাইরে থেকে দেখতে ফিটফাট। কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখা গেল দুরবস্থার চিত্র।
সরেজমিনে ২ জুলাই দেখা যায়, প্রকল্প শেষ হওয়ার ৫ বছরের মধ্যেই ফ্ল্যাটের মূল দরজা ও ভেতরের কক্ষের দরজাগুলো বেঁকে গেছে। শৌচাগারের দরজা নষ্ট হয়ে গেছে। দেয়ালে জমেছে শেওলা। কোথাও টাইলস উঠে গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, নিম্নমানের নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারের কারণে ভবনগুলোর এই দশা হয়েছে। নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি মেরামতের সুপারিশ করা হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে। তারা বলছে, ভবনের কাঠামো ভালো থাকলেও ‘ফিনিশিং’–এর কাজ ভালো হয়নি।
ভবনগুলোর মেয়াদ ৭৫ বছর। কিন্তু চার বছরের মধ্যে এগুলোর এমন দশা হওয়ার কথা নয়। এর মানে ভবনগুলোতে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে।এম ডি সেলিম, চেয়ারম্যান, ইএসডি কনসালট্যান্টস
আইএমইডি প্রকল্প মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি তৈরি করিয়েছে ইএসডি কনসালট্যান্টস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে। গত এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ভবনগুলো পরিদর্শন করেন। প্রতিবেদন জমা দেন জুনে।
ইএসডি কনসালট্যান্টসের চেয়ারম্যান এম ডি সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ভবনগুলোর মেয়াদ ৭৫ বছর। কিন্তু চার বছরের মধ্যে এগুলো এমন দশা হওয়ার কথা নয়। এর মানে ভবনগুলোতে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, এগুলো সংস্কার করা জরুরি।’
সরকারি চাকরিতে বেতনকাঠামোর শেষের দিকে থাকা (আগের চতুর্থ শ্রেণি) কর্মীদের জন্য মতিঝিল সরকারি কলোনিতে চারটি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। শেষ হয় ২০১৮ সালে। চারটি ভবনে ফ্ল্যাট আছে ৫৩২টি। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ৬৫০ বর্গফুট। ভবনগুলো ২০ তলা করে। বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২১০ কোটি টাকা।
দরজায় ছিটকিনি লাগানো যায় না
নতুন নির্মিত ১ নম্বর ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় দেখা গেল, দরজাটি বাঁকা। এর বাসিন্দা রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বললেন, ‘আপনি ভেতরে ঢোকেন। আমি দেখাই দরজা লাগানো যায় কি না।’ ভেতরে ঢুকলাম। তিনি সজোরে দরজাটি ধাক্কা দিলেন। দেখা গেল, দরজা লাগেনি। নানা কসরত করেও ছিটকিনি লাগানো গেল না।
উল্লিখিত কর্মচারী বললেন, নিম্নমানের কাঁচা কাঠ দিয়ে দরজাগুলো তৈরি হয়েছে। এ কারণে কয়েক মাস পরেই বেঁকে যায়। শুধু ফ্ল্যাটের মূল দরজা নয়, প্রতিটি দরজার একই অবস্থা।
শৌচাগারের দরজার অবস্থা আরও করুণ। সেখানেও ছিটকিনি লাগানো যায় না। ভেতরে কেউ ঢুকলে তাঁকে দরজায় পানিভরা বালতি ঠেকিয়ে ভিড়িয়ে রাখতে হয়।
ফ্ল্যাটের দরজা যে নিম্নমানের কাঁচা কাঠ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে আইএমইডির প্রতিবেদনেই। সেখানে আরও বলা হয়েছে, ৫০ শতাংশ মূল দরজা ভঙ্গুর। ভেতরের দরজার ৭০ শতাংশ এতটাই বাঁকা হয়ে গেছে যে বাইরে থেকে কক্ষের ভেতরে দেখা যায়। ৯০ শতাংশ শৌচাগারের দরজা এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। সেখানে প্লাস্টিকের দরজা দেওয়ার দরকার ছিল। দেওয়া হয়েছে ‘সলিড পার্টিকেল বোর্ড’–এর দরজা, যা পানিতে ভিজে খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
ভবনগুলোতে ঢোকা ও ফ্ল্যাট ঘুরে দেখার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাকর্মীদের আপত্তির মুখে পড়তে হলো। দুটি ভবনের কিছু জায়গা ও কয়েকটি ফ্ল্যাট ঘুরে শেওলা পড়া দেয়াল ও টাইলস উঠে যাওয়ার চিত্র দেখা গেল। নোংরা ও অপরিচ্ছন্নতার ছাপ সব জায়গায়।
দুটি ভবনে দেখা যায়, কয়েকটি ফ্ল্যাটের সামনে পানি জমে আছে। বাসিন্দারা বলছেন, বৃষ্টি হলে ভবনের কিছু জায়গা দিয়ে ভেতরে পানি ঢোকে। সেই পানি ভবনের সিঁড়ি ও করিডরে জমে থাকে। এতে দেয়াল ও মেঝে স্যাঁতসেতে হয়ে যায়। ৪ নম্বর ভবনের বাসিন্দাদের সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাকী বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের নকশার ত্রুটির কারণেই পানি ভেতরে আসে।
আইএমইডির প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, পানির ট্যাংকের লাইন থেকে পানি চুয়ে পড়ে, যা ভবনের ছাদের স্থায়িত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তিন মাস না যেতেই লিফট অকেজো
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ নম্বর ভবন উদ্বোধনের তিন মাস না যেতেই একটি লিফট নষ্ট হয়ে যায়। আরেকটি লিফট হঠাৎ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ে কেউ সেটি ব্যবহার করেন না। ভবনটিতে লিফট চারটি। ২ জুলাই গিয়ে দেখা যায়, নষ্ট লিফটি তখনো মেরামত করা হয়নি। যে লিফটটি হঠাৎ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, সেটি এখনো অব্যবহৃত।
লিফট সরবরাহকারী হরাইজন টেকনো লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা লিফটটি ঠিক করতে চেয়েছি; কিন্তু গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছ থেকে বাজেট পাওয়া যায়নি।’ এত অল্প সময়ে কেন যন্ত্রাংশ নষ্ট হলো, এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
গণপূর্ত যা বলছে
ভবনগুলো নির্মাণ করেছে জামাল অ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের মালিক জামাল উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ভবন নির্মাণে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। তবে আইএমইডি ঢালাওভাবে বলেছে, তা ঠিক নয়। তাদের প্রতিবেদন অতিরঞ্জিত করেছে।
সরেজমিনে নানা সমস্যা দেখা গেছে জানালে আবুল কালাম আজাদ বলেন, একেকটি ফ্ল্যাটে যদি ১০-১২ জন করে থাকেন, তখন দরজা-জানালা নষ্ট হবেই। ভবনে বৃষ্টির পানি পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা নকশাগত ত্রুটি। পানি অপসারণ করা বাসিন্দাদের দায়িত্ব।
‘জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে’
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন চার ভবনের বাসিন্দারা বসবাসের ফ্ল্যাট পাওয়ায় তাঁদের আবাসন ব্যয় কমেছে। আরও কিছু সুবিধা তাঁরা পেয়েছেন।
অবশ্য নিম্নমানের উপকরণের কারণে পুরো সুফল পাওয়া যায়নি। দেখা যাচ্ছে, সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়িত না করায় সরকারি কর্মচারীরাই ভুক্তভোগী হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যারা কাজটি বুঝে নিয়েছে, সেই গণপূর্ত অধিদপ্তরকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।