তারুণ্যের সংহতি: বন্ধুসভা

যদি জেঁকে বসে কভু তিমির কালো

জেনে রেখো তবে,

বন্ধুরা আছে, জ্বালাতে দীপ্ত আলো। 

 বন্ধুসভা হলো আলোকোজ্জ্বল সেই দীপ্তির নাম, হার না মানা সব তরুণ প্রাণ। যদি সংহতি হয় হাতে রাখা হাত, কিংবা সমস্বরের তেজ তবে বন্ধুরা সেই হাত আর স্বরের সম্মিলনে এক অচিন্তনীয় শক্তি। তারুণ্যের আকরে ভরপুর বন্ধুসভা লেখে আশার গল্প, ছড়ায় ইতিবাচকতার নান্দনিক সুর। মানবিক এক মহতী সম্মিলনের উৎস আর আত্মোন্নয়নের মধ্য দিয়ে দেশের প্রতি দায় শোধের সুতীব্র বাসনার বাস্তব রূপান্তর বন্ধুসভা।

২৬ বছরের পথচলায় যদি শুধু শেষ দুই বছরের দিকেই তাকাই, দেখি বছরজুড়ে নানা অস্থিরতা আর শঙ্কার ফাঁক গলে দেশের প্রতিটি কোণেই আছে বন্ধুদের ছোঁয়া, আছে তাঁদের সহানুভূতি আর সহমর্মিতার কোমল পরশ। 

এই যেমন ২০২৪-এর উত্তাল জুলাই-আগস্টে বন্ধুসভার প্রত্যেক বন্ধুর চিন্তায় ছিল শুধুই স্বদেশ। নিজেদের সব ভুলে, কেন্দ্রীয় নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে, নিজেদের মতো করে দেশ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন বন্ধুরা। ৫ আগস্ট–পরবর্তী অনিশ্চিত সময়ে অন্য সব তরুণের মতো বন্ধুরাও রাস্তায় নেমে ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করেছেন, ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দিয়েছেন, পরিষ্কার করেছেন শহর-বন্দর, রাস্তায় নামা অন্য সব তরুণের হাতে তুলে দিয়েছেন পানি ও খাবার।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের নোয়াখালী বন্ধুসভার পক্ষ থেকে খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়
ছবি: প্রথম আলো

দুর্যোগে মানুষের পাশে

গত বছর প্রলয়ংকরী বন্যায় বন্ধুসভার বন্ধুরা প্রথম সাড়াদানকারীদের মধ্যে ছিল অন্যতম। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে‒মানুষ যখন দিশাহারা, তখন শত শত বন্ধু এক হাতে ত্রাণ, অন্য হাতে আশার আলো নিয়ে পানিতে নেমে পড়েন। কেউ খাবার পৌঁছে দেন, আবার কেউবা ওষুধ! স্যানিটারি ন্যাপকিন থেকে শিশুখাদ্যসামগ্রী বিতরণ কিংবা সরাসরি উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা—কোনো কিছুতেই পিছিয়ে ছিলেন না বন্ধুরা। জাতীয় পর্ষদের পক্ষ থেকে অন্তত ১১ হাজার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় ১১ টন খাদ্যসামগ্রীসহ নানা উপকরণ। আয়োজন করা হয় ১ হাজার ২০০ মানুষ ও ৪০০ গবাদিপশুর জন্য মেডিকেল ক্যাম্প।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে দেশের নানা প্রান্তে লক্ষাধিক বৃক্ষরোপণ করেন বন্ধুরা। বৃক্ষরোপণের নিয়মিত কর্মসূচি হয়ে ওঠে শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর ভাষা। পরের বছর আরও সোয়া লাখ চারাসহ দুই বছরে প্রায় আড়াই লাখ বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পরিবেশের সঙ্গে তারুণ্যের মেলবন্ধন তৈরি করেন বন্ধুরা। একেকটি চারা শুধু একটি গাছই নয়, বরং একেকটি ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।

ঈদে সহমর্মিতা

আবার প্রতিবছর পবিত্র রোজার ঈদে সহমর্মিতার ঈদ কর্মসূচিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে নতুন পোশাক আর তাদের পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী উপহার দেন বন্ধুরা। গত দুই বছরে দেশব্যাপী ৯ হাজার শিশুকে নতুন পোশাক এবং ১০ হাজারের বেশি পরিবারকে খাদ্যসামগ্রীসহ প্রায় ৭৫ লাখ টাকার উপহারসামগ্রী প্রদান করেন বন্ধুসভার বন্ধুরা। শুধু ঈদই নয়, দুর্গাপূজায়ও একই কর্মসূচি পালন করে অনেক বন্ধুসভা।

আত্মোন্নয়ন

স্বেচ্ছাসেবা আর পরিবেশসচেতনতাই নয়, আত্মোন্নয়নেও বন্ধুসভা এখন এক অনন্য শক্তির নাম। বছরজুড়ে দক্ষতা উন্নয়নে দেশ ও দেশের বাইরের বন্ধুরা আয়োজন করছেন নানা কর্মশালা-প্রশিক্ষণ। অংশ নিচ্ছেন জাতীয় পর্ষদ আয়োজিত উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, সফট স্কিল ডেভেলপমেন্ট, পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং, দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া, প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার, ইংরেজি শিক্ষা, লেখালেখি, যোগাযোগ, নেতৃত্ব, বিতর্কসহ বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মশালায়। এসব কর্মসূচিতে বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিন দূতাবাস, ইউএনডিপি, টিআইবি, ব্র্যাক, আইডিপি বাংলাদেশ, মোবাইল ব্র্যান্ড অনার, দেশি ফুডস, ইস্পাহানিসহ দেশ ও বিশ্বসেরা সব প্রতিষ্ঠান। 

অনলাইনেও টেক শোর মধ্য দিয়ে বন্ধুরা জানছেন প্রযুক্তি খাতের নানা সম্ভাবনা আর ডিজিটাল দুনিয়ার বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মের গল্প। বইমেলায় নিজেদের লেখা বই নিয়ে আলোচনার জন্য প্রতিবছর ‘বন্ধুর বই লাইভ’-এ লেখক, কবি, পাঠকেরা একত্র হচ্ছেন, চিন্তার আলোয় স্নাত হচ্ছে হাজারো তরুণ প্রাণ। বিতর্ক ও বিতর্কবিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করে যুক্তিবাদী তারুণ্য গঠনে নিজেদের প্রত্যয় জানিয়ে দেন বন্ধুরা। বিশেষ করে নারী দিবসে প্রতিবছর বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন নারীদের কথা বলার অসাধারণ এক প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। যেমন করে দেশব্যাপী বন্ধুর গান প্রতিযোগিতা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তরুণ কণ্ঠশিল্পীদের নতুন প্ল্যাটফর্ম করে দিয়েছে বন্ধুসভা। 

কাগজের বই পড়ায় যখন ভাটার টান, তখন দেশব্যাপী হাজারের বেশি পাঠচক্র আয়োজন করে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি আর পাঠের মধ্য দিয়ে ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার তেজোদ্দীপ্ত সংকল্পে বলীয়ান হয়েছেন বন্ধুরা। শুধু নিজের নয়, বরং অন্যের পাঠাভ্যাস গঠনে সারা দেশে ৩০টির বেশি বইমেলার আয়োজন করেছেন বন্ধুরা। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী কিংবা আড্ডা, নানা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস কিংবা ঋতুভিত্তিক উৎসব উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কথাই বলেন বন্ধুসভার বন্ধুরা। আর কে আছে বন্ধুদের মতো, যাদের মননে, মেধায়, স্মরণে, প্রেরণায় শুধুই বাংলাদেশ! 

তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও কাজ করছে বন্ধুসভা। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিষয়ভিত্তিক অধিবেশন ও পরামর্শমূলক সভার আয়োজন
করা হয়। 

জয় হোক তারুণ্যের

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষেও বন্ধুরা যুক্ত হন ভালো কাজের লড়াইয়ে। কেউ অসহায় পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছেন সেলাই মেশিন, কেউ দিচ্ছেন গবাদিপশু, কেউ তৈরি করে দিচ্ছেন নতুন দোকানঘর আবার কেউবা তুলে দিচ্ছেন আস্ত বসতবাড়ি! শিশুদের জন্য কোনো বন্ধুসভা স্কুল করছে তো আরেক বন্ধুসভা উপহার দিচ্ছে শিক্ষাসামগ্রী। এভাবেই বন্ধুরা একে অন্যের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন সুন্দর এক ভবিষ্যতের দিকে। তারুণ্যের সংহতিতে সতেজ প্রাণে লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে একই সুর—বন্ধু মানেই সংহতি, বন্ধু মানেই ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে এক ধাপ অগ্রগতি। জয় হোক প্রথম আলোর, জয় হোক বন্ধুসভার, জয় হোক তারুণ্যের।

  • জাফর সাদিক: সভাপতি, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ