নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনের আরও যে পথ রয়েছে

‘দলীয় নাকি তত্ত্বাবধায়ক’—এই বিতর্কের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনপদ্ধতির অচলাবস্থার সমাধান দেখা কঠিন।

নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশে একটি অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। সরকারি দল বিদ্যমান দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে চায়। অন্যদিকে বিরোধী দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করছে। এই বিপরীতধর্মী মতামতের মধ্যে কোনো সমঝোতার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না এবং একটা সংঘর্ষের সূত্রপাত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংগত কারণেই জনগণ উদ্বিগ্ন।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, যেকোনো ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়। তারা নিশ্চিত হতে চায় যে নির্বাচনের ফলাফল তাদের পক্ষে যাবে। এর একটি  সম্ভবত কারণ হলো, তাদের ভয় যে নির্বাচনে হারলে তারা একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়বে; জাতীয় দৃশ্যপটে এবং নীতিনির্ধারণে কোনো ভূমিকা থাকবে না; বিভিন্ন নিগ্রহের সম্মুখীন হবেন।

এই ভয় দূর করা গেলে নির্বাচনের বিষয়ে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা দূর করা যেতে পারে এবং নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে বারবার যে অচলাবস্থা এবং সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে, তার অবসান করা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই ভয় লাঘব করা যায়?

সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচনের মূল অসুবিধা: অন্যায্যতা ও অস্থিতিশীলতা

এই ভয়ের মূল উৎস হলো বাংলাদেশের বর্তমান ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক’ নির্বাচনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় ভোট অনুপাতের সামান্য পরিবর্তনের ফলে কোণঠাসা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচনে একটি আসনে বিভিন্ন দলের প্রার্থীর মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনি নির্বাচিত হন। তাঁকে ওই আসনের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পেতে হয় না। যেমন ধরা যাক, একটি আসনে পাঁচটি দলের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

প্রথম তিন দলের প্রার্থী প্রত্যেকে পেলেন ২০ শতাংশ ভোট। চতুর্থ দলের প্রার্থী পেলেন ১৯ শতাংশ এবং পঞ্চম দলের প্রার্থী ২১ শতাংশ। তাহলে পঞ্চম দলের প্রার্থী জিতে যাবেন। আরও ধরা যাক, সব আসনেই এই পাঁচটি দলের জনপ্রিয়তার হার উপর্যুক্ত আসনের মতো। তাহলে সব আসনেই পঞ্চম দল জিতে যাবে এবং সংসদের সব কটি, অর্থাৎ ৩০০ আসনই এই দল পেয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে মাত্র ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি দল সংসদের ১০০ শতাংশ আসন পাবে এবং বাকি চার দল মোট ৭৯ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি আসনও পাবে না। এখন ধরা যাক, পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচন হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে প্রথম দলের জনপ্রিয়তা একটু বেড়ে ২১ শতাংশ হয়েছে এবং পঞ্চম দলের জনপ্রিয়তা কমে ২০ শতাংশ হয়েছে। এ বছর প্রথম দলটি পেয়ে যাবে ৩০০ আসন এবং পঞ্চম দলসহ বাকি দলগুলো একটি আসনও পাবে না।

সুতরাং এই নির্বাচন পদ্ধতির দুটি বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, এটি অন্যায্য; কারণ, একটি দল মাত্র ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদের ১০০ শতাংশ আসন পেয়ে যাচ্ছে এবং বাকিরা ৭৯ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি আসনও পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, এটি অস্থিতিশীলতা বাড়ায়; কারণ, ভোটের মাত্র ১ শতাংশ পরিবর্তনের কারণে একটি দল একবার নির্বাচনে ১০০ শতাংশ আসনের অধিকারী হচ্ছে, আবার পরবর্তী নির্বাচনে কোনো আসন পাচ্ছে না। অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তব সম্ভাবনাই বাংলাদেশের যেকোনো ক্ষমতাসীন দলকে নির্বাচন সম্পর্কে অতিরিক্ত স্পর্শকাতর করে দেয়। তারা কয়েক শতাংশ ভোট হারানোর কারণে একেবারে ‘নিশ্চিহ্ন’ হওয়ার পরিণতি এড়াতে চায়।

আনুপাতিক নির্বাচনের মূল সুবিধা: ন্যায্যতা ও স্থিতিশীলতা

আনুপাতিক নির্বাচন ভোটানুপাতের সামান্য পরিবর্তনের কারণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার বিপদ প্রতিরোধ করে। এই নির্বাচন আসনভিত্তিক না হয়ে গোটা দেশের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি দল নির্বাচনের আগে ক্রমাধিকারসম্পন্ন প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। গোটা দেশে যে দল যত শতাংশ ভোট পায়, সংসদেও তত শতাংশ আসন পায়। ধরা যাক, একটি দল সারা দেশে ৩০ শতাংশ ভোট পেল। সে ক্ষেত্রে সে সংসদেরও ৩০ শতাংশ আসন, অর্থাৎ ৯০টি আসন পাবে। সে ক্ষেত্রে তার পূর্বপ্রকাশিত প্রার্থী তালিকা থেকে ওপরের ৯০ জন সে দলের সংসদ সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন।

ফলে আনুপাতিক নির্বাচনের ফলাফলে বাঞ্ছিত স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন ওপরে যে উদাহরণটি আমরা বিবেচনা করেছি, তাতে আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রথমবারের নির্বাচনে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম দল পাবে যথাক্রমে ৬০, ৬০, ৬০, ৫৭ ও ৬৩ আসন এবং পরের নির্বাচনে পাবে যথাক্রমে ৬৩, ৬০, ৬০, ৫৭ ও ৬০ আসন। ভোটানুপাতের ১ শতাংশ পরিবর্তনের কারণে আসন শতাংশের পরিবর্তনও ১ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকে—কমও নয়, বেশিও নয়। ফলে জনপ্রিয়তার সামান্য পরিবর্তনে কোনো দল সংসদ থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয় না, আবার সর্বেসর্বা হয়ে পড়ে না। সংসদে সব দলের ভোটানুপাতিক উপস্থিতি নিশ্চিত থাকে।

সরকার গঠনে সমর্থ না হলেও সংসদে এবং নীতিনির্ধারণে সব বড় দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বজায় থাকে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি সহনশীল হতে বাধ্য হয়। কারণ, তারা জানে যে কেউ কাউকে একেবারে কোণঠাসা কিংবা নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। সুতরাং আনুপাতিক নির্বাচনের দুটি মৌল বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, এটি ন্যায্য; কারণ, প্রতিটি ভোট সংসদের আসন বিতরণে সমান ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয়ত, এটা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল রাখে। কোনো দলকে একবার সর্বেসর্বা এবং আরেকবার প্রান্তিক করে না!

বিশ্বব্যাপী আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার জনপ্রিয়তা

আনুপাতিক নির্বাচনের এসব ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রায় সব উন্নত দেশ এই নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করে। উন্নত দেশগুলোর সংস্থা ওইসিডির আদি ২২টি দেশের মধ্যে ১৯টি দেশেই আনুপাতিক নির্বাচন প্রচলিত এবং নব্বইয়ের দশকে যখন বিভিন্ন সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে গণতন্ত্র চালু হয়, তখন এরূপ ১০টি দেশের প্রতিটি আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা গ্রহণ করে। মূলত যুক্তরাজ্য এবং যেসব দেশ যুক্তরাজ্যের উপনিবেশ ছিল (যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া অন্তর্ভুক্ত), সেসব দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত। যেহেতু ভারতবর্ষ যুক্তরাজ্যের উপনিবেশ ছিল, সেহেতু এই উপমহাদেশের বেশির ভাগ দেশের মতো বাংলাদেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থা চালু হয়। বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল এই নির্বাচনব্যবস্থাই দেখে এসেছেন।

ফলে, তাঁরা মনে করেন যে এটাই একমাত্র নির্বাচনব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে শুধু উন্নত দেশ নয়, উন্নয়নশীল বহু দেশেও আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত। বস্তুত বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ দেশে আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত। ক্রমে আরও দেশ (যেমন নিউজিল্যান্ড) সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচন পরিত্যাগ করে আনুপাতিক নির্বাচনপদ্ধতি গ্রহণ করছে।

এমনকি খোদ যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলস তাদের পার্লামেন্ট এবং অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের জন্য আনুপাতিকপদ্ধতি গ্রহণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা অনেক আগে থেকেই আনুপাতিক নির্বাচন অনুসরণ করছে। সম্প্রতি (২০১৫ সালে) প্রতিবেশী নেপালও আংশিকভাবে আনুপাতিক নির্বাচন প্রবর্তন করেছে। সুতরাং গোটা বিশ্ব আনুপাতিক নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। উন্নত বিশ্বে আনুপাতিক নির্বাচন প্রায় সর্বজনীনব্যবস্থা। গবেষণা দেখায় যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্বাচনভিত্তিক দেশের তুলনায় গড়ে আনুপাতিক নির্বাচন অনুসারী দেশে সুশাসনের মান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার উঁচু। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যাভিসারী বাংলাদেশেরও প্রয়োজন এই নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের জন্য আনুপাতিক নির্বাচনের অন্যান্য সুফল

লক্ষণীয়, স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতা বৃদ্ধি ছাড়াও বাংলাদেশের জন্য আনুপাতিক নির্বাচনের আরও বহু সম্ভাব্য সুফল রয়েছে। এগুলো নিয়ে আমি এর আগে প্রকাশিত একাধিক প্রবন্ধ এবং গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সংক্ষেপে লক্ষ করা যেতে পারে যে আনুপাতিক নির্বাচনে কারচুপির প্রভাব কমে যায়; কারণ, সামান্য কয়েক শতাংশ ভোটের এদিক-ওদিক করে নির্বাচনের সামগ্রিক ফলাফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব হয় না।

ফলে নির্বাচনে কারচুপির জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সামর্থ্য ও পেশিশক্তির গুরুত্ব হ্রাস পায়। আনুপাতিক নির্বাচনে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মাধ্যমে পরিচিত গুণী ব্যক্তিদের সংসদের সদস্য হওয়ার সুযোগ বাড়ে। নির্বাচনী প্রচারাভিযান কূপমণ্ডূকতার পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলোর ওপর নিবদ্ধ হয়। প্রাক্-নির্বাচনী জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা থাকে না। ফলে সব দল নির্বিঘ্নে তাদের নিজস্ব ইশতেহারের ভিত্তিতে জনপ্রিয়তা যাচাই এবং তার ভিত্তিতে নির্বাচনোত্তর জোট গঠন করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়; কারণ, দলীয় প্রার্থী তালিকায় স্থানপ্রত্যাশীদের গোটা সময় দলের জন্য কাজ করতে হয়। আনুপাতিক নির্বাচন ক্ষুদ্র দলগুলোর জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্ব অর্জন সুগম করে; স্থানীয় সরকারগুলোর বিকশিত হওয়ার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং উপনির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা দূর করে। ন্যায্যতা এবং সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে আনুপাতিক নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে শান্তিপূর্ণ এবং গঠনমূলক করায় সহায়ক হয়।

আরও পড়ুন

শেষ কথা

সুতরাং ‘দলীয় নাকি তত্ত্বাবধায়ক’—এই বিতর্কের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনপদ্ধতির অচলাবস্থার সমাধান দেখা কঠিন; বরং আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অস্থিতিশীলতা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের পরিবর্তনের মাধ্যমেই এটা করা যেতে পারে। যদি সংবিধানের কোনো সংশোধনী আবশ্যক হয়, সেটিও করা যেতে পারে। সংঘর্ষে যাওয়ার পরিবর্তে যদি রাজনৈতিক দলগুলো এসব বিষয়ে আলোচনা শুরু করে, তাহলেই দেশের মঙ্গল হবে।

  • ড. নজরুল ইসলাম, জাতিসংঘের সাবেক উন্নয়ন গবেষণাপ্রধান