বিশ্ববিদ্যালয় পাস বেকার ৮ লাখ: জরিপ

উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার সবচেয়ে বেশি ১২ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করেই সাধারণত বিপুলসংখ্যক তরুণ চাকরির বাজারে ঢোকেন। একই প্রক্রিয়ায় চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন প্রকৌশলী ও চিকিৎসকেরাও। চাকরির বাজার কিংবা সামাজিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষিতদের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংশই এখন বেকার।

গতকাল বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিএস। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার এখন ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। সংখ্যার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে আছেন প্রায় আট লাখ নারী-পুরুষ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ, প্রতিবছর যেসব তরুণ-তরুণী স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন, তাঁদের প্রায় অর্ধেক গড়ে দু-তিন বছর বেকার থাকেন। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, কোভিড মহামারি এবং অর্থনীতির চলমান সংকটের কারণেই দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে।

আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, বিগত ৩০ দিনের মধ্যে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি সর্বশেষ সাত দিনে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাঁকে বেকার হিসেবে ধরা হবে।

 বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকার ১ শতাংশের একটু বেশি। সংখ্যার দিক থেকে এমন বেকার আছেন ১ লাখ ৫৩ হাজার। এ ছাড়া প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোদের মধ্যে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বা ৩ লাখ ২২ হাজার বেকার আছেন। পড়াশোনা করেননি বা স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব কম হওয়ার কারণ এই শ্রেণির মানুষ যা কাজ পান, তা-ই করেন।

বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, মাধ্যমিক পাস করেছে এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৭ লাখ ৩৯ হাজার বেকার। উচ্চমাধ্যমিক পাস করাদের মধ্যে বেকার ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২২ সালে দেশে ২৫ লাখ ৮২ হাজার বেকার আছেন। বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে বিবিএসের শিল্প ও শ্রম শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, উচ্চশিক্ষিতরা মনমতো কাজ না পেলে নিজেদের বেকার হিসেবে পরিচয় দেন। যেমন স্নাতকোত্তর পাস করে ভালো চাকরির অপেক্ষা করছেন বা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই সময় হয়তো টিউশনি করেন কিংবা অস্থায়ী চাকরি করেন। চিকিৎসকদের অনেকেই সম্মানীর বিনিময়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। জরিপের সময় তাঁদের অনেকেই নিজেদের বেকার হিসেবে গণ্য করেন।

বেকারত্ব নিয়ে বিবিএস যে সংখ্যা প্রকাশ করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাঁর মতে, বাস্তবে আরও বেশি বেকার আছে।
প্ল্যাটফর্ম বিডিজবসডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর

বেকারের সংজ্ঞা

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, এখন দেশে শ্রমশক্তিতে ৭ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার মানুষ আছেন। এর মধ্যে কাজে নিয়োজিত আছেন ৭ কোটি ৪ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। সার্বিকভাবে কর্মজীবী নারী-পুরুষের মধ্যে ৪ কোটি ৫৬ লাখ ১০ হাজার পুরুষ এবং ২ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার নারী।

বেকার মানুষের পরিসংখ্যান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী বের করে বিবিএস। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, বিগত ৩০ দিনের মধ্যে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি সর্বশেষ সাত দিনে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাঁকে বেকার হিসেবে ধরা হবে।

এ হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে। সপ্তাহে এক ঘণ্টার মজুরি এই মূল্যস্ফীতির যুগে জীবনধারণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।

তবে নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীও আছে। তারা শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণে নেই, আবার কাজের মধ্যেও নেই। বিবিএস বলছে, এদের সংখ্যা ৯৬ লাখ ৪৯ হাজার।

বেকারদের মধ্যে তরুণ-তরুণী ৮৩%

শ্রমশক্তিতে ২ কোটি ৬৮ লাখ ২৪ হাজার যুবক-যুবতী আছেন, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। তাঁদের মধ্যে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার কাজের মধ্যে আছেন। যুবক-যুবতীদের মধ্যে ২১ লাখ ৪৮ হাজার বেকার, যা দেশের মোট বেকার গোষ্ঠীর ৮৩ শতাংশ।

চাকরি খোঁজার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিডিজবসডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, বেকারত্ব নিয়ে বিবিএস যে সংখ্যা প্রকাশ করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাঁর মতে, বাস্তবে আরও বেশি বেকার আছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, প্রতিবছর চার-পাঁচ লাখ তরুণ-তরুণী স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন। তাঁদের ৫০-৬০ শতাংশকে গড়ে দু-তিন বছর বেকার থাকতে হয়। সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়ায় প্রতিবছর বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।

এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে অর্থনীতিতে একধরনের সংকট চলছে। ছোট-বড় সব ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে। ছাঁটাই করা কর্মীদেরও বসে থাকতে হয় কিংবা আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি নিতে হয়।

শিক্ষিত বেকারত্ব পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি হবে, এমন সম্ভাবনাও দেখছি না। সামনে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের সময় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান

উচ্চশিক্ষিতরা বেকার কেন

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড এবং অর্থনীতির বর্তমান সংকটের কারণে উচ্চশিক্ষিত বেকার বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ পরিবেশেও একধরনের স্থবিরতা আছে এবং বিনিয়োগ প্রস্তাবও ৩০ শতাংশের মতো কমে গেছে।

সেলিম রায়হান বলেন, শিক্ষিত বেকারত্ব পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি হবে, এমন সম্ভাবনাও দেখছি না। সামনে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের সময় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করে। তাঁরা নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী হন না। তাঁর মতে, অর্থনীতিতে একধরনের কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। শোভন কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

মজুরিহীন পারিবারিক শ্রম কমছে

বাসাবাড়িতে নারীরা সংসারের নানা কাজ করেন, কিন্তু মজুরি পান না। এমন অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম কমে আসছে। ২০১০ সালে ৯১ লাখ নারী এমন মজুরহীন পারিবারিক কাজ করতেন। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৩১ লাখে নেমে এসেছে। এক যুগের ব্যবধানে এই সংখ্যা ৬০ লাখ কমেছে, যা শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। ২০১০ সালে ১ কোটি ৭২ লাখ নারী শ্রমশক্তিতে ছিলেন। এখন তা বেড়ে ২ কোটি ৫৮ লাখ হয়েছে।

দেশে আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয় মাত্র ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। বাকি প্রায় ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয়। যেখানে কোনো চাকরির নিশ্চয়তা নেই। কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। যেকোনো সময় মালিকপক্ষ চাকরি থেকে ছাঁটাই করতে পারে। আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি হয় বরিশাল বিভাগে। আর সবচেয়ে কম সিলেটে। ­