প্রথম টিউশনির গল্প 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে পাঠকের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

যেদিন অনার্সে ভর্তি হই, সেদিনই মনে মনে স্থির করেছিলাম বাড়ি থেকে আর টাকা নেব না। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাব। টিউশনি খুঁজতে যা যা করার—দেয়ালে পোস্টার লাগানো, টিউশন মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার—সবই করি। কিন্তু টিউশনি আর পাই না।

আমি রসায়নের ছাত্র। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় সামান্যর জন্য মেধাতালিকা থেকে পিছিয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য মা-বাবা জোরাজুরি করলেও চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন যখন পূরণ হলো না, অন্য কিছু আর করব না। জেদ থেকে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও পরীক্ষা দিই না। বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে অপেক্ষমাণ তালিকায় যদিও নাম আসে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভর্তির সুযোগ হয় না। যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই।

স্বপ্ন ভাঙার ব্যথা, টিউশনি না পাওয়ার কষ্ট—সব মিলিয়ে তখন ব্যথিত আমি। কিছু ভালো লাগে না। বেশির ভাগ সময় যশোর ইনস্টিটিউট লাইব্রেরিতে কাটাই। একদিন লাইব্রেরিতে পলাশদার সঙ্গে দেখা হয়। আমার পিসতুতো দাদার বন্ধু, স্কুলশিক্ষক। তাঁকে টিউশনির কথাটা বলি। বিষয়টা দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।

দিন ১৫ দিন পর পলাশদাকে মেসেঞ্জারে নক করি, ‘দাদা, কোনো খবর কি হলো?’ দাদা জবাবে লিখে পাঠান, ‘হবে হবে, অপেক্ষা করো।’

২০১৮ সালে জন্মদিনের দিন চমৎকার কাণ্ড ঘটে। সকাল থেকে মন খারাপ, কেউ তেমন উইশ করেনি। ফেসবুক নিষ্ক্রিয় থাকা যদিও একটা কারণ হতে পারে। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে রাত ১০টা ৫ মিনিটে কাঙ্ক্ষিত নম্বর থেকে মুঠোফোনে কল আসে। ‘শুভ জন্মদিন। হাল ছেড়ো না, জীবন অনেক বড়। কার জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে আমরা কেউ জানি না। তোমার জন্য একটা টিউশনি আছে। তিন হাজার টাকা দেবে। অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াতে হবে। সপ্তাহে পাঁচ দিন। ঠিকানা লিখে পাঠাচ্ছি। ইচ্ছে হলে যেতে পারো। কে বলতে পারে, নিয়তিতে থাকলে আমরা হয়তো একসঙ্গে সমুদ্রের জলে পা ভেজাব।’ সংগত কারণেই কথাগুলো যে বলেছিল, তার নাম উল্লেখ করছি না। তবে জবাবে উল্লেখযোগ্য কিছু সেদিন তাকে বলতে না পারলেও তার দেওয়া ঠিকানায় যাই এবং টিউশনিটা শুরু করি।

ভালো ছাত্র, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। অঙ্ক একটা দেখিয়ে দিলে পরেরগুলো নিজেই করতে পারে। ভালোই সময় কাটছিল, কিন্তু বিপত্তি বাধে মাস শেষে বেতন হাতে পাওয়ার পর। এক হাজার টাকা কম। টিউশনিটা যে দিয়েছিল, তাকে বিষয়টা জানাতে লজ্জা করছে। অন্যদিকে কেন যে টাকাপয়সার ব্যাপারটা আগেই পরিষ্কার করে নিইনি, ভেবে চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থা। বন্ধুদের কেউ বলল, বিষয়টি নিয়ে সরাসরি অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলতে পারিস। আবার কেউ বলল, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।

মাস দুয়েক পর পলাশ দাদা তাঁর সহকর্মীর ছেলেকে পড়ানোর জন্য ঠিক করে দেন। পাশাপাশি যেখানে থাকতাম, সেখানকার লন্ড্রির দোকানের মালিক জুয়েল ভাইয়ের মাধ্যমেও একটা টিউশনি পাই। সিদ্ধান্ত নিই, আগের টিউশনিটা ছেড়ে দেব। অভিভাবককে কথাটা বলব বলব করেও বলে উঠতে পারি না। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। মনস্থির করে গেছি কথাটা বলব। ‘মুড়ি আর জল খেয়ে গিয়ে পড়তে বসো। বাবা চাল নিয়ে এলেই রান্না করব। পড়ে উঠে খাস। আর কয়েকটা দিন তো, বাবার অফিসের ঝামেলা মিটে গেল বলে।’ দরজার সামনে যেতেই কথাগুলো শুনে দুচোখ ভিজে ওঠে। টিউশনি ছাড়ার চিন্তা করা তো দূর, প্রশান্ত মনে পড়াতে থাকি।

এ ঘটনার মাস তিনেক পর। একদিন পড়ানো শেষে বের হওয়ার সময় ছাত্রের মা বললেন, ‘স্যার, একটু বসেন, কথা আছে।’ কয়েক মুহূর্ত পর একটা খাম হাতে ফিরলেন তিনি, ‘স্যার, ওর বাবার তো বদলি হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে আমরা চলে যাচ্ছি। খামটা নিন, আগের মাসগুলোয় পুরো টাকাটা দিতে পারিনি। ওর বাবার অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছিল। ভেবেছিলাম আপনি জিজ্ঞাসা করলে বলব। কিন্তু আপনি কিছু বলেননি দেখে বলা হয়নি। এখানে এ মাসের বেতন আর আগের মাসগুলোর বাকি টাকাটাও আছে।’

জবাবে বলার মতো কথা সাজিয়ে উঠতে পারি না। ছাত্রের মাথায় হাত দিয়ে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে বেরিয়ে আসি।