প্রতিটি মৃত্যু–ইচ্ছাকে আত্মহত্যার ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিতে হবে

ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ১৫ মার্চ কুমিল্লা শহরে নিজেদের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা (২৪)। আগের দিন ঢাকার মোহাম্মদপুরে ঘরের দরজা ভেঙে বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছেই। আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় কী অথবা আত্মহত্যা করতে চাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মানুষটির প্রতি পরিবার, সমাজ, গণমাধ্যমের ভূমিকা কতটুকু—এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইন

প্রথম আলো:

মানুষ কেন আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে?

হেলাল উদ্দীন আহমেদ: মানসিক বিপর্যয়ের কারণেই বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তি ইত্যাদি মানসিক রোগের যথাযথ চিকিৎসা না করলে এবং সম্পর্কজনিত জটিলতা, ব্যর্থতা ইত্যাদি মেনে নিতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। রেগে গিয়ে বা হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে কেউ আত্মহত্যা করলে তাকে আবেগতাড়িত আত্মহত্যা (ইমপালসিভ) বলা হয়। এ ছাড়া সংকল্পিত ও পরিকল্পিত (ডিসাইসিভ অ্যান্ড প্ল্যানড) আত্মহত্যার ক্ষেত্রে যিনি আত্মহত্যা করতে চান, দীর্ঘ সময় ধরে তিনি আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেন। ২০১৮-১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের করা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি জাতীয় জরিপের তথ্য বলছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের গড়ে ১০০ জনের মধ্যে ৭ জনই বিষণ্নতায় ভুগছেন। করোনার পর মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

প্রথম আলো:

কেউ আত্মহত্যা করতে চাচ্ছেন, তা অন্যরা বুঝবেন কীভাবে?

হেলাল উদ্দীন আহমেদ: কেউ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করলে তার আচরণে সেটা প্রকাশ পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করতে পারে কেউ। নিজের ক্ষতি করা, সব কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা, নিজেকে দোষী ভাবা, নিজেকে অপাঙ্‌ক্তেয় ভাবা, সারা রাত জেগে থাকা আর সারা দিন ঘুমানো, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া, শখের বিষয় থেকে দূরে থাকা, কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারাসহ বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। কোনো ব্যক্তির মধ্যে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে এসব লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকলে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

প্রথম আলো:

কেউ আত্মহত্যা করতে পারেন এটা বোঝার পর পাশে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের করণীয় নিয়ে কিছু বলেন।

হেলাল উদ্দীন আহমেদ: এমন কোনো টিকা নেই যা দিয়ে বলা যাবে যে কেউ আত্মহত্যা করবে না। সফল মানুষও আত্মহত্যা করতে পারেন। কেউ আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করছেন এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিই ঠিক করবেন কাউন্সেলিং, ওষুধ কোনটা লাগবে। দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে কথা বললে হবে না। এমন পরিস্থিতিতে ওই মানুষটির আশপাশে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা কোনোভাবেই নিজেরা এ সমস্যার সমাধান বা পরামর্শ দেবেন না। সমবেদনা, করুণা দেখাতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। ওই ব্যক্তির প্রতি সমানুভূতি প্রকাশ করতে হবে। তাকে বলতে হবে, যে কারও এমন সমস্যা হতে পারে, এর পেছনে তোমার কোনো দুর্বলতা বা দোষ নেই, এই সমস্যা থেকে উত্তরণে যথাযথ চিকিৎসা আছে। প্রথমেই মনে রাখতে হবে, বিষণ্নতা একটি রোগ। ক্যানসার, করোনাসহ অন্য রোগে আমরা যেমন নিজেরা চিকিৎসা না করে যথাযথ চিকিৎসকের কাছে রোগীকে নিয়ে যাই, এ ক্ষেত্রেও তাই করতে হবে। সাদি মহম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদসহ অনেকেই বলেছেন, মা ও বোনের মৃত্যুর পর থেকে সাদি মহম্মদ ভেঙে পড়েছিলেন। কর্মময় জীবনে স্বীকৃতি না পাওয়াসহ অন্যান্য আক্ষেপও ছিল। সাদি মহম্মদ বিষণ্নতায় ডুবে গিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বজনেরা তাঁকে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির কাছে নিয়েছিলেন কি না, তা অবশ্য আমরা জানি না।

প্রথম আলো:

বলা হচ্ছে আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অনেকাংশেই আত্মহত্যা ঠেকানো যায়। এ বিষয়ে কিছু বলেন।

হেলাল উদ্দীন আহমেদ: আত্মহত্যা প্রতিরোধে যার যার ক্ষেত্র থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। শিশুদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে। শিক্ষার্থীদের সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহিত করতে হবে। সব ধরনের মানসিক রোগ দ্রুত শনাক্ত করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজপ্রাপ্যতা কমানোর পাশাপাশি প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারলে আত্মহত্যার ঘটনা আর ঘটবেই না, তা বলা না গেলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। মূল কথা, এসব লক্ষণ দেখা দিলে ওই ব্যক্তির প্রতি সবাইকে মনোযোগী হতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিবারে যদি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে, তবে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও আত্মহত্যার ঝুঁকি থেকে যায়, তাই সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

প্রথম আলো:

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অবন্তিকার আত্মহত্যার পর প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেছেন।

হেলাল উদ্দীন আহমেদ: প্রথমেই বলছি, আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়। অবন্তিকার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কোনোভাবেই বিচার কাম্য নয়। ভুক্তভোগীকে বেঁচে থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। কোনো জায়গায় প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হলে অন্য জায়গায় যেতে হবে। একইভাবে সমাজে অন্যায়ের প্রতিকার ও বিচার পাওয়ার সুব্যবস্থাও থাকতে হবে।

প্রথম আলো:

আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের ভূমিকা কেমন হবে?

হেলাল উদ্দীন আহমেদ: গণমাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদের অতি প্রচার, অপপ্রচার বা অদায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনে কখনো কখনো আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে পারে। দেশে পরপর দুটো আত্মহত্যার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, সাদি মহম্মদের ঘটনায় গণমাধ্যমগুলো সংবাদ পরিবেশনে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তবে অবন্তিকার ক্ষেত্রে তা সেভাবে হয়নি। অবন্তিকার ব্যক্তিগত জীবন বা তাঁকে গ্লোরিফাই (মহিমান্বিত) করে এমন অনেক কিছু প্রকাশ বা প্রচার করা হচ্ছে। এতে করে এমন বার্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যে অবন্তিকা আত্মহত্যা করেছিলেন বলেই অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে। অবন্তিকার মতো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আরও অনেকে থাকতে পারেন, তাঁরা এতে করে আত্মহত্যা করতে উৎসাহিত হতে পারেন। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যার খবর পরিবেশনে গাইডলাইন দিয়েছে। তা মেনে চলতে হবে। আত্মহত্যার খবর নির্মোহভাবে পরিবেশন করতে হবে। তবে গত ১০ বছরে বলা যায়, দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে অনেক সংবেদনশীল আচরণ করছে।

প্রথম আলো:

আত্মহত্যা প্রতিরোধে আপনার পরামর্শগুলো জানতে চাচ্ছিলাম।

হেলাল উদ্দীন আহমেদ: কারও মধ্যে মৃত্যু–ইচ্ছা দেখা দিলে বিদ্রূপ হাসাহাসি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল করা যাবে না। প্রতিটি মৃত্যু–ইচ্ছাকে আত্মহত্যার ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিতে হবে। এ সময় বন্ধু হয়ে তাদের পাশে থাকতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে হবে। মনের যত্ন নেওয়াটা যে গুরুত্বপূর্ণ, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সেটা বোঝাতে হবে। আত্মহত্যার প্রসঙ্গ উঠলে তা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। আত্মহত্যা যে কোনো সমাধান নয়, সেটাও বোঝাতে হবে। সব থেকে বড় কথা, মানসিক সমস্যাকে লোকলজ্জার ভয়ে লুকিয়ে রাখা যাবে না। মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে প্রয়োজন হলে ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

প্রথম আলো:

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

হেলাল উদ্দীন আহমেদ: প্রথম আলোকেও অনেক ধন্যবাদ।