অভিজ্ঞতার আলো–৩

আব্বা নায়ক হতে চেয়েছিলেন: ফেরদৌসী রহমান

ক্রাউন সিমেন্ট ‘অভিজ্ঞতার আলো’ অনুষ্ঠানে দেশের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকেন আনিসুল হক। বাংলাদেশের অগ্রগণ্য সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে শিল্পীর কিংবদন্তিতুল্য পিতা আব্বাসউদ্দীন আহমদের স্মৃতি, ফেরদৌসী রহমানের শৈশব, কৈশোর আর ফেলে আসা জীবনের কথা; এখন তিনি কী করছেন, কেমন আছেন?

আনিসুল হক:

সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। প্রথম আলোর এই বিশেষ আয়োজন ‘অভিজ্ঞতার আলো’য়। সহযোগিতায় ক্রাউন সিমেন্ট। এই অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের পথিকৃৎ মানুষদের কথা শুনি। আজ আমি সম্মানিত বোধ করছি, সৌভাগ্যবান মনে করছি যে ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে আমি আছি। ফেরদৌসী রহমানকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই। তিনি আমাদের কিংবদন্তি শিল্পী, বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগৎকে যাঁরা আকার দিয়েছেন, স্বরূপ দিয়েছেন, তিনি তাঁদেরই একজন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে, গড়ে ওঠার সঙ্গে তাঁর জীবনের ইতিহাস যুক্ত হয়েছে। আমরা সবাই জানি, তিনি আব্বাসউদ্দীন আহমদের সুযোগ্য কন্যা। আব্বাসউদ্দীন আহমদ এমন একজন শিল্পী, যিনি অবিভক্ত বাংলার মানুষকে জাগিয়েছিলেন গানের মাধ্যমে। তাঁরই মেয়ে ফেরদৌসী রহমান, কিন্তু ফেরদৌসী রহমান তাঁর নিজের পরিচয়ে ভাস্বর। ফেরদৌসী আপা, কেমন আছেন?

ফেরদৌসী রহমান: আমি খুব ভালো আছি। আপনি এত সুন্দর করে আমাকে ইন্ট্রোডিউস করলেন, আমি জানি না এসব কিছু আমার প্রাপ্য কি না। হ্যাঁ, গান গেয়েছি, এটা সত্যি কথা। একসময় ভাবি, শুধু গান গেয়ে যদি মানুষের এত ভালোবাসা পাওয়া যায়, তাহলে আরও অনেক কিছু করা উচিত বোধ হয়, মানে বড় ভালো কিছু করা উচিত।

আনিসুল হক:

গান গেয়েই তো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। শুধু ভালোবাসা পাওয়া না, গান দিয়ে একটা দেশ, একটা দেশের সংস্কৃতিকেও তো আমরা আকার দিতে পারি। কারণ, গানের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ তাদের ভাষা খুঁজে পায়, তাদের স্বর খুঁজে পায়, তেমনি সুরও খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই না? মানুষকে, মানুষের হৃদয়কে জাগ্রত রাখে, একটা দেশকেও তো জাগিয়ে তোলে।

ফেরদৌসী রহমান: সেটা সত্যি কথা। আমি নিজে শিখেছি, গেয়েছি, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, শ্রদ্ধা পেয়েছি। কিন্তু যে জিনিসটা আমি করে যেতে পারিনি, সেটার দিকে আমার অতৃপ্তি বেশি।

সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের সাক্ষাৎকার নেন আনিসুল হক
ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

সেটা শিল্পীমাত্রেরই থাকে এবং মানুষ হিসেবেও হয়তো থাকতে পারে। ১৯৪১ সালে আপনার জন্ম, কোচবিহারেই। তখন অবিভক্ত বাংলা, অবিভক্ত ভারত। আপনার জন্মের পরপর কি আপনারা কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন?

ফেরদৌসী রহমান: না, তার ঠিক পরপরই না। এই তিন-চার বছর বয়সে। বেশ কিছুদিন কোচবিহারে আমরা ছিলাম।

আনিসুল হক:

স্মৃতি আছে আপনার?

ফেরদৌসী রহমান: অনেক। এত বেশি স্মৃতি...

আনিসুল হক:

তিন-চার বছর বয়সের কথা মনে আছে আপনার? আপনি শ্রুতিধর!

ফেরদৌসী রহমান: সত্যিই খুব মনে থাকে। মানে মা বলতেন, এত ছোটবেলার কথা মনে রাখলে কী করে? যেমন আমার গান গাওয়ার স্মৃতিটা মনে আছে। দুই বছর কি আড়াই বছর হবে আমার। ঘুম পেলে আমি মায়ের কাছে গিয়ে ‘আঁখি পাতা ঘুমে জড়ায়ে আসে’ গানটা গাইতাম।

আনিসুল হক:

আপনার মায়ের অন্য আরেকটা গানের লাইন কি মনে আছে আপনার?

ফেরদৌসী রহমান: মা তো অনেক গান গাইত। আমি গাইতাম মায়ের কাছে ‘আঁখি পাতা ঘুমে জড়ায়ে আসে’, নজরুলের গান। কারণ, আমাদের বাড়িতে সব সময় রেকর্ড বাজত, গ্রামোফোন কলের গান। এগুলো আব্বার কাছেই ছিল।

আনিসুল হক:

তার মানে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত আপনি কোচবিহারে ছিলেন। এ সময় আপনার আব্বা কি কলকাতা শহরে গিয়ে গান গাইতেন, রেকর্ড করতেন?

ফেরদৌসী রহমান: আব্বা অন্য গান গাইতেন তখন। আব্বার ক্যারিয়ার কিন্তু আবার শুরু হয়েছে আধুনিক গান দিয়ে। এটা অনেকেই জানেন না। আধুনিক গানের পরের ধাপটা কিন্তু নজরুল সংগীত।

বাবা বিখ্যাত সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও মা বেগম লুৎফুন্নেসা আব্বাসের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান। ১৯৫৯ সালে
ছবি: ফেরদৌসী রহমানের ওয়েবসাইট থেকে
আনিসুল হক:

তারপর আপনারা কলকাতায় গেলেন। সেখানে কোন পাড়ায় উঠলেন, মনে আছে?

ফেরদৌসী রহমান: হ্যাঁ, মনে আছে। সেটা ছিল ৬ নম্বর বেনিয়াপুকুর লেন। কয়েক বছর আগে আমি গিয়েছি ওই ছয় নম্বর বেনিয়াপুকুর লেনে। স্মৃতি আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেছে ওখানে। গিয়ে দেখি, আমার সে পুকুর লেন ওরকমই আছে কি না। কিন্তু এত বেশি বদলে গেছে যে আমার এখন মনে হয়, না গেলেই পারতাম। আমার স্মৃতির বেনিয়াপুকুর লেনটা আর নেই।

আনিসুল হক:

এটা সবারই হয়। ছোটবেলায় যে মাঠটাকে অনেক বড় মনে হয়, যে রাস্তাটাকে বড় মনে হয়, বড় হয়ে গেলে মনে হয়, অত বড় নয়।

ফেরদৌসী রহমান: এটা সত্যি কথা। কিন্তু বাড়িটার যে লেআউট ছিল, সেটাই বদলে গেছে।

আনিসুল হক:

আচ্ছা, আপনার আব্বা তো কাজী নজরুল ইসলামের গান করতেন...তখন তো বোধ হয় নজরুল অসুস্থ হতে শুরু করেছেন, নাকি?

ফেরদৌসী রহমান: কাজী নজরুল ইসলামকে আমি সুস্থ পাইনি। মানে যত দিনে আমি একটু বুঝতে শিখলাম... তখন আব্বার সঙ্গে গিয়েছিলাম তাঁকে দেখতে। কিন্তু তখন তাঁকে সুস্থ দেখিনি।

আনিসুল হক:

কিন্তু আমি এখন কল্পনা করতে পারি বই পড়ে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম খুবই প্রাণবন্ত একজন মানুষ। যেখানে যাচ্ছেন, শত শত ছেলেমেয়ে তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। উনি পান খাচ্ছেন, গান গাচ্ছেন, হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন। ঢাকায় এলেন, লোকজন তাঁকে ঘিরে ধরল। বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে...সেই সব স্মৃতিকথা আপনারা শুনেছেন, কিন্তু দেখেননি।

সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান
ছবি: প্রথম আলো

ফেরদৌসী রহমান: মনে আছে, ওনার বাড়িতে গেছি। উনি বসে আছেন, কাগজ ছিঁড়ছেন আর তাকাচ্ছেন একটু পরপর। মানে উনি তত দিনে একদম বাক্রুদ্ধ হয়ে গেছেন।

আনিসুল হক:

আবার কাজী নজরুল ইসলামের এই জনপ্রিয়তার পেছনে আপনার আব্বার অনেক বড় ভূমিকা আছে।

ফেরদৌসী রহমান: এটা আপনি বলছেন, খুব ভালো লাগছে শুনতে। আসলেও বিরাট ভূমিকা আছে। কারণ, এই যে আব্বাসউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, ইসলামি গান—এই তিনটা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। অনেক জাগরণী গান, যেগুলো আব্বা গেয়েছেন, সেগুলোর অনেকগুলো নজরুলের লেখা। তখন আব্বাসউদ্দীনের নজরুল না হলে হবে না। সে সময়ের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটার কথা মনে না করে আপনি থাকতে পারবেন না।

আনিসুল হক:

বাংলাদেশে আমাদের রোজার ঈদ শুরুই হয় না, যদি ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ আমরা না শুনি। সবারই ঈদ শুরু হয় যেই চাঁদ দেখা গেল, সবগুলো টেলিভিশন, রেডিওতে একযোগে এই গান বাজতে শুরু করল। আমাদের হৃদয়ের মধ্যেও কিন্তু এই আনন্দ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেটার পেছনে কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দীনের অবদান তো আমরা কোনো দিনও ভুলতে পারব না।

ফেরদৌসী রহমান: নজরুলের লেখা অনেক গজল আব্বা গেয়েছেন। ‘আসে বসন্ত ফুল বনে’—এত পপুলার একটা গান। তারপর এই হিন্দু-মুসলমানকে নিয়ে...আব্বার একটা গান আছে বাংলাদেশকে নিয়ে। এগুলো অনেকে আমরা জানি না, আমরা তেমন ভালো করে পড়াশোনা করিনি। কিন্তু যেটা আপনি বললেন যে নজরুল–আব্বাসউদ্দীনের ওপর যদি গবেষণা করা হয়, তাহলে বলা যাবে, দুজন দুজনকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। সেটা ঠিক এত অল্প শিক্ষায় আমি হয়তো ভালো করে বলতে পারব না।

প্রকৌশলী স্বামী রেজাউর রহমানের সঙ্গে সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান
ছবি : ফেরদৌসী রহমানের সৌজন্যে
আনিসুল হক:

আপনি আনুষ্ঠানিকভাবে গান শিখতে শুরু করলেন কি শৈশব থেকেই?

ফেরদৌসী রহমান: হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকেই। যখন আব্বা  কলকাতা থেকে কোচবিহারে যেতেন, আমরা বারান্দায় বসতাম...

আনিসুল হক:

তার মানে তো আপনি ভাষা শিখছেন, লিখতে শিখছেন, গান শিখছেন। মনে হয় হাঁটতেও শিখছেন একসঙ্গে।

ফেরদৌসী রহমান: তখন আব্বার কোলে বসতাম, আর ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, তারপর ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ’—এসব গান তিন ভাইবোনকে নিয়ে আব্বা গাইতেন। আর পাশে মা বসে থাকতেন। তারপর এসব গান যখন শেষ হতো, তখন মাকে আব্বা বলতেন, ‘আলেয়া তুমি গান করো।’ তখন মা শুরু করতেন, ‘রাতের ময়ূর ছড়াল যে পাখনা’—এসব গান।

আনিসুল হক:

তো আপনারা দুই ভাই এক বোন। বিচারপতি মোস্তফা কামাল। এরপর সম্প্রতি আমরা যাঁকে হারালাম, আমাদের খুবই প্রিয় মানুষ মুস্তাফা জামান আব্বাসী, তিনি তো প্রথম আলোর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন, কলাম লিখতেন। ভাবিও লিখতেন—আসমা আব্বাসী...আমরা তাঁদের আমাদের পরিবারের মানুষ গণ্য করি এবং ভুলব না। আপনারা তিনজনই কি গান শিখেছেন? মানে মোস্তফা কামালও কি গান শিখেছেন?

ফেরদৌসী রহমান: তাঁর ডাক নাম দুলু, আব্বাসী ভাইয়ের নাম তুলু। আমাদের তিনজনের মধ্যে দুলু ভাই সবচেয়ে বেশি বোদ্ধা, মানে সংগীতের ক্ষেত্রে। তিনি বলে দিতে পারতেন, আব্বার ওটা কী গান ছিল...ওটা অত নম্বর রেকর্ড, ওটা আব্বার, ওটা নজরুল ইসলামের। হ্যাঁ, আমরা যদি এতটুকু ভুল করতাম কোনো গানে, ‘মির্না, গানটা দেখে নিস তো, ওখানে তোর ভুল আছে।’ মির্না আমার ডাক নাম। কোথাও যদি একটু ভুল গাইলেন তুলুভাই, দুলু ভাই বলবেন, ‘মির্না, তুলুকে বল, ওখানে কিন্তু গানটা ভুল আছে, ও যেন ঠিক করে নেয়।’ সুর হোক বা কথা হোক, বাণী হোক—হোয়াট এভার। আর শুধু এ ধরনের গান নয়, উচ্চাঙ্গসংগীতও ভালো বুঝতেন। সে জন্য বলছি, শুধু পড়াশোনার ব্যাপারে না, আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে দুলু ভাই সবচেয়ে বেশি ভালো বুঝতেন গান এবং আমাকে সারাক্ষণ ভালোই গাইড করতেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ, আর কেউ তেমন করে গাইড করার ছিল না আব্বা চলে যাওয়ার পর। অন্য শিল্পীরা ভালোবাসত, স্নেহ করত, হয়তো কোনো সময় কেউ একটু আদর করে বুঝিয়ে দিত। দুলু ভাই একদম শেখার মতো করে গাইড করতেন। আমাকে রবীন্দ্রসংগীতও শিখিয়েছেন।

আনিসুল হক:

আপনারা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় চলে এলেন। এসে উঠলেন পুরান ঢাকায়।

ফেরদৌসী রহমান: এসে উঠলাম নারিন্দা, ৭৭ নম্বর ঋষিকেশ দাস রোড।

১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর হোটেল শাহবাগে (বর্তমান বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রকৌশলী রেজাউর রহমানের সঙ্গে সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের বিয়ের অনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়
ছবি : ফেরদৌসী রহমানের সৌজন্যে
আনিসুল হক:

সেই সময়ের স্মৃতি আপনার মনে আছে? আপনি এসে কোন স্কুলে ভর্তি হলেন?

ফেরদৌসী রহমান: তখন আমি সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্টে ভর্তি হলাম। আব্বাসী ভাই সেন্ট গ্রেগরিজে ভর্তি হলেন। আর কামাল ভাই কলেজ কি ম্যাট্রিকে, গুলিয়ে যাচ্ছি। যাহোক, একটা কথা কিন্তু বলা হয়নি, দুলু ভাই আর তুলু ভাইয়ের মাঝখানে আমার আরেকটা ভাই ছিল, নাম নীলু। ও যদি আজকে বেঁচে থাকত, তাহলে হয়তো আমাদের কথা আপনারা কেউ বেশি বলতেন না, ওর কথাই বলতেন। কারণ, ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ছিল।

আনিসুল হক:

কত বছর বয়সে চলে গেলেন?

ফেরদৌসী রহমান: আমার জন্মের কয়েক মাস আগে মারা গেছে। ওর টাইফয়েড হয়েছিল। তখনো টাইফয়েডের তেমন ওষুধ বের হয়নি। দাদাজি ওকে অসম্ভব ভালোবাসতেন খুব বুদ্ধিমান হওয়ায়। ভাওয়াইয়া গান নাকি অপূর্ব গাইত। সবাই তাই বলে, নীলু থাকলে তোদের আর কেউ পুছত না।

আনিসুল হক:

এই রেকর্ড শুরুর আগেই আমি বলছিলাম, আমার জন্ম নীলফামারীতে। শৈশব কেটেছে রংপুর শহরে।  ভাওয়াইয়া আমার স্মৃতির মধ্যে, রক্তের মধ্যে আছে। কারণ, ওই সময় রংপুর রেডিওতে তিস্তাপাড়ের গান হতো। তখন ঢাকা বেতার থেকে আপনার ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’–এর মতো গানগুলো বাজত।

ফেরদৌসী রহমান: ‘ফান্দে পড়িয়া পড়িয়া বগা কান্দে রে’, ‘নদী না যাইও রে  বৈদ’—

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর পল্টনের বাসায় বাবা আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান
ছবি : ফেরদৌসী রহমানের সৌজন্যে
আনিসুল হক:

ভাওয়াইয়া গান তো খুবই জনপ্রিয়, খুবই মর্মস্পর্শী। তারপরও এই গানগুলোকে জনপ্রিয় করার পেছনে আব্বাসউদ্দীন ও মুস্তাফা জামান আব্বাসী এবং আপনার—ফেরদৌসী রহমানের— অবদান খুব বেশি। একটা যে সিনেমা হয়েছিল (নোলক), যে সিনেমায় আপনার কণ্ঠে আমরা ভাওয়াইয়া গানগুলো পেলাম।

ফেরদৌসী রহমান: প্রথম ছবি ‘আসিয়া’ এখানে তৈরি হয়। এর পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন নাজির আহমেদ। একটা ডুয়েট গান ছিল—‘দেওয়ায় করছে মেঘ মেঘালি তোলাইল পুবাইল বাও’। আমি আর আব্বাসি ভাই সেটা করলাম। ওই গানই প্রথম। তারপর ‘ও মোর কালারে কালা’। এটা আমি সলো গাইলাম ওই ছবির জন্য। যদিও ছবিটা রিলিজ হয় অনেক পরে, কিন্তু ওটাই এ দেশের প্রথম ছায়াছবি ছিল আর...

আনিসুল হক:

তারপর আপনি প্রথম মঞ্চে গান গেছেন অতিশৈশবে, তাই তো?

ফেরদৌসী রহমান: একদমই ছোটবেলায়। প্রথম স্মৃতির মধ্যে যা আছে, সেটা ছিল কলকাতায় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে। সেখানে বিরাট বড় অনুষ্ঠান, আব্বাকে গান গাইতে হবে। সেই সময় যেহেতু একটু একটু করে আমি গাইতাম, তাই কোথাও গান হলে আব্বা আমাকে বগলদাবা করে নিয়ে যেত। কিছুটা গর্ব হতো, মজা লাগত বোধ হয়! মেয়েকে দিয়েও গাওয়াবেন আরকি। তখন আব্বা আমাকে ও রকম একটা অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলেন। আমি গিয়ে দেখি হলভর্তি লোকে লোকারণ্য। তার মধ্যে আব্বা বলছে, ‘মাগো তোমাকে একটা গান গাইতে হবে।’ আমি বলি, ‘না’, আব্বা বলেন, ‘হ্যাঁ, চল।’  মজা করতে করতে নিয়ে এল স্টেজে। তারপর এল মাইক্রোফোন। তারপরে দেখা গেল যে আব্বা পাশে টেবিলে হারমোনিয়াম নিয়ে বাজাবে আর আমি গাইব। তো আমি গাইব কোনটা? খুব একটা রোমান্টিক গান, ‘শুধু কাঙালের মতো চেয়েছিল তার মালাখানি’। আমি এতটুকুন, মাইক্রোফোন অনেক ওপরে। তখন আরেকটা লোক উইংসের পাশ থেকে টেবিল নিয়ে এল, এসে আমাকে টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর গাইলাম, ‘শুধু কাঙালের মতো চেয়েছিল।’ গানের পরে তালি থামেই না...

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় ফেরদৌসী রহমানের এ গানের পরিবেশনা দিয়েই শুরু হয় বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) যাত্রা
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

সুন্দর অভিষেক হলো শ্রোতাদের ভালোবাসা দিয়ে। প্রথম গান গ্রামোফোন রেকর্ড কত বছর বয়সে হলো?

ফেরদৌসী রহমান: রেকর্ডে গাইলাম ঢাকায় এসে ১৯৫৬ সালে। ম্যাট্রিকের পরে। ’৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করলাম। তারপর একটা ডেলিগেশন গেল করাচিতে...

আনিসুল হক:

১৫ বছর বয়স।

ফেরদৌসী রহমান: তখন বিরাট ডেলিগেশন গেল। শেখ মুজিবও তখন ওখানে ছিলেন। সেই ডেলিগেশনে আমি আর আব্বাসী ভাই ছিলাম। তখন সবচেয়ে ছোট আরকি।  আর বাকি সব বড় শিল্পী। হুসনা বানু...এ রকম সব। তো ওখানে আব্বা লিখে দিয়েছিল যে আমার ছেলে–মেয়ে যাচ্ছে আর কানাইলাল শীল যাচ্ছে। ওদের দুটো করে গান যেন রেকর্ড করা হয়। আমরা কিন্তু অত ভালো জানতাম না।

আনিসুল হক:

এই রেকর্ডটা করাচিতে?

ফেরদৌসী রহমান: করাচিতে। তারপর ওখানে যখন গেলাম তখন কানাই কাকু—কানাইলাল শীল বলছে, ‘মা এখন তো তোমাদের রেকর্ডিং।’ ‘না, কাকু চলেন বাড়ি যাই।’ বলে, ‘না, গান দুটো করে। তোমার আব্বা বলেছে; নইলে মন খারাপ করবে।’ এই তো ওনার কাছে বসে শুরু হলো গান শেখা। আমি দুটো গান শিখলাম। দুটো গান শিখলাম, দুইজন দুটো করে গান। তারপর যখন ফিরে এলাম, তার কয়েক মাস পরে রেকর্ডটা চলে এল। তারপর সেটা শোনা তো আব্বার জন্য বিরাট এক্সাইটমেন্ট আরকি।  ‘কলের গান নিয়ে আসো।’ আব্বার কবি–সাহিত্যিক বন্ধুদের ডাকা হলো, আব্বা তাঁদেরকে বললেন, ‘মির্না মা, তুলু বাবার গান শোনো তোমরা।’  এইটা একটা আমার জীবনে একটা স্মরণীয় ব্যাপার।

আনিসুল হক:

রেডিওতে প্রথম গান গাইলেন কবে?

ফেরদৌসী রহমান: রেডিওতে খেলাঘরে গাইতাম অনেক ছোটবেলায়। ঢাকায় আসার পরপরই ১৯৪৮ সালে...এ রকম সময় খেলাঘরে গাই। কিন্তু বড়দের অনুষ্ঠানে গাইলাম ১৯৫৫ সালে। ছোট ছিলাম। কিন্তু আমার ওই ১৫ বছর বয়সে, ১৪ বছর বয়সে আমাকে ১৮ বছর দেখানো হয়েছিল। কারণ, তখন বড়দের গান গাই, অ্যাডাল্ট প্রোগ্রামে ছোটদের দেওয়ার নিয়ম ছিল না। আমার প্রোগ্রাম শুরু হলো ক্ল্যাসিক্যাল আইটেম দিয়ে। তোড়ি রাগে খেয়াল গেয়েছিলাম আমি, মনে আছে— ক্ল্যাসিক্যাল । তারপর আস্তে আস্তে একটু ভাওয়াইয়া গাই, একটু পল্লিগীতি গাই। তারপর আধুনিক গান, আহাদ চাচা আধুনিক গান শেখালেন, আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা। তখন একটু অন্য লাইনে যেতে শুরু করলাম আরকি।

মা লুৎফুন্নেসা আব্বাসের সঙ্গে মেয়ে ফেরদৌসী রহমান
ছবি : সংগৃহীত
আনিসুল হক:

আপনার স্কুলজীবনের পরীক্ষার ফল...ছোটবেলা থেকে আমাদের বলা হয়েছে, জানো ফেরদৌসী রহমান কিন্তু ম্যাট্রিক স্ট্যান্ড করা, মেয়েদের মধ্যে ফার্স্ট। সেসব কথা মনে পড়ে আপনার?

ফেরদৌসী রহমান: হ্যাঁ, মনে পড়ে। আসলে পড়াশোনা যে খুব করতাম, তা না। একটু ফাঁকিবাজ ছিলাম আমি। আব্বা খালি বলত, ‘মাগো পড়ছ না!’ ‘আব্বা স্কুলে তো পড়েছি।’ আর কনভেন্ট স্কুলের পড়াশোনার সিস্টেমটা ছিল আলাদা। বই কিন্তু বাড়িতে আনতে দিত না। ওই স্কুলে, ওখানে, প্রত্যেকটা বাচ্চার আলাদা আলাদা বক্স ছিল। ওখানে আমাদের বই লক করে আসতে হতো। বই! আব্বা... বই তো দেয়নি। আব্বাকে বোঝাতে হতো যে হোমওয়ার্ক নেই। বলে, ‘সেকি পড়াশোনা করতে হবে না বাড়িতে?’ আমি বলি, ‘না।’ 'তাহলে?'তখন আব্বা চিল্লাত। ‘গান করি!’ এই আরকি! এ রকম ফাঁকিবাজ। তো তার মধ্যে ক্লাসে কী করে হয় ফার্স্ট, না হয় সেকেন্ড হয়ে যেতাম। সেটা একদম ছোটবেলা থেকে। থ্রি থেকে ফোর তো আমি ডাবল প্রমোশন পেয়ে গেলাম ওখানে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। তো ওখানে বাংলা কোনো ব্যাপার নেই।  আমার তো ইংলিশে জ্ঞান কম। আব্বা তখন একটা এত বড় ডাবল সাইজের খাতা বানালেন। রেডিয়েন্ট রিডার ছিল, রেডিয়েন্ট রিডার বইটা থেকে আব্বা প্রতিটি শব্দের বাংলা অর্থ আর ইংরেজি লিখে দিল। ‘আই মানে আমি, উই মানে আমরা’—এ রকম লিখে দিল। বলল মুখস্থ করো, জাস্ট মুখস্থ করো। আমি আব্বার কথামতো সব মুখস্থ করে বসে থাকতাম। ওই করতে করতে ইংলিশটা শেখা হয়ে গেল যে আমি তখন ইংলিশটা জানি। এই করে করে ওই ক্লাস থ্রি থেকে আমাকে তিন মাসের মধ্যে ক্লাস ফোরে দিয়ে দিল।

আনিসুল হক:

ডাবল প্রমোশন দিয়ে।

ফেরদৌসী রহমান: ক্লাস ফোরে চলে গেলাম। তারপর ন্যাচারালি একটু গেইন করলাম। তারপর সবচেয়ে মজা হলো যখন ১৪ বছর হলো। তখন আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। তখন সিস্টাররা বলে, ‘ফেরদৌসী, কল ইয়োর ফাদার।’ আমি বললাম, ‘হোয়াই?’ তখন বলছে যে, ‘উই হ্যাভ টু টক টু হিম’। মনটা ভয়ে থাকল যে কেন আব্বাকে ডাকল। আমি ভয়ে ভয়ে আব্বাকে বললাম, ‘আব্বা, সিস্টার তোমাকে যেতে বলেছে।’ ‘কেন মাগো’, বাবা বলল।  ‘আমি তো জানি না কেন যেতে বলে। তুমি একটু চলো তো।’ আমি বললাম। আব্বা বুঝল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। আব্বা আমাকে সব সময় কিছু হয়নি এ রকম একটা ভাব দেখাত। বলল, চলো। গিয়ে সিস্টারদের সামনে গিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার?’ সিস্টার বলে কী, ‘দেখো, শি ইজ আ ভেরি স্টুডিওস স্টুডেন্ট। কিন্তু  ইংলিশেই একটু উইক। তো সিনিয়র কেমব্রিজ দিতে হলে ওর আরও দুই বছর ওয়েট করতে হবে।’ তখন আব্বা একটু মনটা খারাপ করে বলল, ‘আচ্ছা, ও তো ক্লাস থ্রি থেকে তোমাদের স্কুলেই পড়ে আসছে। ফার্স্ট বা সেকেন্ড স্টুডেন্ট। তাকে তোমরা বলছ শি ইজ উইক ইন ইংলিশ। আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট। তোমরা আমাকে বোঝাও।’ তখন বলছে যে আমাদেরও হয়তো স্ট্যান্ডার্ডটা সিনিয়র কেমব্রিজ স্ট্যান্ডার্ডের নয়। কারণ, বেশ কয়েকটা বাচ্চা আটকে গিয়েছিল। তারপর বাসায় গেলাম। মনটা আমার খারাপ। আব্বারও একটু খারাপ। যে আবার দুটি বছর এখানে স্কুলে। আব্বা বলছে, ‘ঠিক আছে মাগো তুমি চিন্তা করো না। চলো।’ বলে পরের দিন আমাকে বাংলাবাজার স্কুলে নিয়ে গেলেন। ওখানে তখন কিটি আপা ছিলেন প্রিন্সিপাল। গিয়ে বলছে যে, ‘আচ্ছা, ফেরদৌসীকে যদি স্কুলে দিই ও কি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে পারবে? মাত্র পাঁচ মাস বাকি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার।’ তো বলছে, ‘হ্যাঁ, পারব না কেন? ইংলিশে যতটুকু ওখানে করেছে তার থেকে ভালো তো এখানে করবেই।’ বলেই... ওখান থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম পাঁচ মাসে।

১৯৯৮ সালে আব্বাস উদ্দিন সংগীত একাডেমী কার্যালয়ে আবদুল লতিফ (বামে), সুধীন দাশ ও ফেরদৌসী রহমান
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

বাংলাবাজার স্কুল থেকে?

ফেরদৌসী রহমান: বাংলা স্কুল, ইংলিশ মিডিয়ামে কিন্তু বাংলাবাজার স্কুল থেকে। প্রিন্সিপালই আমাদের বেশির ভাগ সময় পড়াতেন। আর আমার সাথে আমার আরেকটা বন্ধু ছিল, এই দুজনে পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট একটু অদ্ভুতই ছিল যে কী করে ফার্স্ট হয়ে গেলাম মেয়েদের মধ্যে। আব্বারও এটা ধারণার বাইরে ছিল।

আনিসুল হক:

আপনার ভালো রেজাল্টের পরে কি এই চিন্তা পরিবারে এসেছিল যে একে ভালো জজ–ব্যারিস্টার বানাতে হবে অথবা ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে অথবা পিএইচডি করাতে হবে?

ফেরদৌসী রহমান: না। আবার আব্বার অনেক স্বপ্ন ছিল। মানে মেয়েটাকে দিয়ে যে কী করাবে। ‘আচ্ছা মাগো শোনো, তুমি যদি সিএসপি অফিসার হও কেমন হয়?’ ‘পারবে তুমি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ পারব আব্বা। কিন্তু সিএসপি অফিসার আমার ভালো লাগবে না।’ ‘কেন?’ ‘বদলির চাকরি, এখানে যাব ওখানে যাব!’ ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক। তো গান হবে না।’ গানটা কিন্তু ব্যাক অব দ্য মাইন্ড ছিল যে ওটা করতেই হবে। তার মেয়েকে সবকিছু করাবে, এই হলো কথা। কিন্তু আলটিমেটলি গানটা করতে হবে এটা তার মাথায় ছিল। এবং সেই জন্য সব রকম চেষ্টা, ওস্তাদ আনা তারপরে বিভিন্ন ধরনের রেকর্ড কিনে দেওয়া। ‘এই গানটা শিখো।’ সন্ধ্যা মুখার্জীর গান আব্বার খুব পছন্দ ছিল। ‘এই গান তোলো।’ তারপর নজরুলসংগীত তুলতে হবে। আব্দুল আহাদ চাচাকে ডেকে এনে বলেন, ‘আহাদ, তুমি দেখো, যেগুলো সবাই গায় না এ রকম কিছু গান দাও।’

অবসরে গান শোনেন ফেরদৌসী রহমান
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

অবিভক্ত বাংলায় মানে ভারত যখন এক দেশ ছিল, তখন তো উনি প্রায় দুই বাংলাতেই  জনপ্রিয়তাই অর্জন করেছিলেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানে এলেন উনি? উনি কী করতেন?

ফেরদৌসী রহমান: আব্বা তখন ছিল অ্যাডিশনাল সং পাবলিসিটি অর্গানাইজার। সরকারি চাকরি।

আনিসুল হক:

উনি বেঁচে ছিলেন কোন সাল পর্যন্ত?

ফেরদৌসী রহমান: ১৯৫৯।

আনিসুল হক:

’৫৯। তখন তো আপনার বয়স তখন বেশি না।

ফেরদৌসী রহমান: না, আমি তো আব্বাকে অনেক ছোটবেলায় হারিয়েছি। মাত্র ইউনিভার্সিটি ঢুকেছি…

আনিসুল হক:

একটা অমূল্য ক্ষতি হয়ে গেল…

ফেরদৌসী রহমান: ওইটুকু সময়ের মধ্যে। আব্বার স্বপ্নের শেষ ছিল না। শুধু আমাকে নিয়ে না, তিন ছেলে–মেয়েকে নিয়ে আব্বার অনেক বড় স্বপ্ন ছিল—ছেলেকে ব্যারিস্টার বানাবে, জানি সে নিজে ব্যারিস্টার হয়নি। আব্বাসীকে নায়ক বানাবে বা ও যা খুশি হতে চায়। কিন্তু আব্বার খুব ফিল্মের দিকে আগ্রহ ছিল, নিজেরও তো খুব নায়ক হওয়ার শখ ছিল।

আনিসুল হক:

দেখতে তো খুবই সুদর্শন ছিলেন।

ফেরদৌসী রহমান: আব্বা ছায়াছবিতে কাজও করেছেন ...

সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

আপনি গানে ভালো করছেন, ফার্স্ট হচ্ছেন, উচ্চাঙ্গ সংগীত ভালো করছেন, আপনি পড়াশোনায় ভালো করছেন। আপনাকে নিয়েই তো স্বপ্ন দেখবে বাবা।

ফেরদৌসী রহমান: অনেক স্বপ্ন! আমার ভাইদের নিয়েও অনেক স্বপ্ন। যেটা বলছিলাম যে কামাল ভাইকে তত দিনে স্কলারশিপ পেয়ে চলে যেতে হলো। কামাল ভাই লন্ডনে চলে গেল ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য। আব্বাসী ভাই তত দিন এমএ পাস করল। ও বাংলা একাডেমিতে জয়েন করল। কিন্তু ওরও শখ ছিল। আব্বা চেয়েছিলেন ও নায়ক হোক। চেয়েছিলেন যদি ও সিনেমায় যায় তাহলে ভালো করতে পারে। ও দেখতে ভালো ছিল।

আনিসুল হক:

আপনার আব্বারও শখ ছিল নায়ক হওয়ার।

ফেরদৌসী রহমান: আব্বারও শখ ছিল। আব্বা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। দু–একটা নাটক মানে সিনেমাতে…

আনিসুল হক:

আপনার আব্বা তো খুব সুদর্শন ছিলেন।

ফেরদৌসী রহমান: খুবই সুন্দর, সুদর্শন ছিলেন। আমার বাবা-চাচারা সবাই খুবই খুবই ভালো দেখতে ছিলেন। আমার মা শ্যামলা ছিলেন। আমার দাদাজির কথা একটু বলি। দাদাজিও খুব রসিক মানুষ ছিলেন এবং উনি ফরসা মানুষ ভালোবাসতেন এবং উনি কালো মানুষ দেখতেই পারতেন না। …ছেলের বড় বউ মানে আমার মা ছিল কালো। তার এক, দুই, তিন সন্তানই ফরসা, মানে আমার তিন ভাই কিন্তু ফরসা। ‘মেয়েটা হতেই হবে কালো।’ ... এই এত সব ফরসা লোকের মাঝে এই মেয়েটা কালো হলো কেন? আর মেয়েটাকে আব্বাস এত ভালোবাসবে কেন?’

আনিসুল হক:

আপনি কালো না, আপনার দাদা বর্ণান্ধ ছিলেন।

ফেরদৌসী রহমান: আচ্ছা এটা গল্প বলি ভালো গল্প—আব্বাস এই মেয়েটাকে ভালোবাসে। আব্বাস কলকাতা থেকে আসলে স্যুটকেসভর্তি জিনিস আনে এই মেয়েটার জন্য।  ‘আব্বাস তো সব সম্পত্তি মেয়েটাকে...’ এই ছিল দাদাজির মনের কষ্টের কথা।  নাতনিকে নিয়ে দাদাজির কষ্ট ছিল। কিন্তু যখন আমি ফার্স্ট হলাম তখন আব্বার মনে কষ্ট এবং আনন্দ দুটোই ছিল। বলতেন, ‘আজকে যদি বাবা বেঁচে থাকত তাহলে মির্না মাকে বাবা মাথায় করে নিয়ে নাচত।’

মানে আমার দাদাজি পড়াশোনা নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন, পড়াশোনার জন্য সবকিছু করতে রাজি ছিলেন। দুলু ভাই যাতে পড়াশোনায় ভালো করে সে জন্য মাকে দাদাজি ১০ টাকা মানি অর্ডার করতেন। তখনকার ১০ টাকা মানে অনেক। আলাদা করে পাঠাতেন মাকে যাতে দুই ভাইকে আলাদা করে ডিম, দুধ, মাখন খাওয়ানো হয়। ওদের ব্রেন যাতে ভালো হয়। সে জন্য তখন আব্বার কষ্ট ছিল যে আমার বাবা কেন বেঁচে নেই, থাকলে আজকে মির্না মাকে নিয়ে গর্ব করতে পারত।

আনিসুল হক:

আপনাদের পুরো ফ্যামিলি তো সফল। আপনার বড় ভাই প্রধান বিচারপতি হলেন। আমরা মুস্তাফা জামান আব্বাসীর কথা, বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগতে তার যে অবদান, সেটা স্মরণ করি, তার যে কালেকশন এই লোকগীতির এবং নিজে যে গানগুলো গেয়েছেন সেসব। আর আপনার যে সাফল্যখ্যাতি, অবদান সব মিলিয়ে... আপনার আব্বা যদি আরও বেঁচে থাকতেন, এটা আপনি মিস করেন না যে আপনার আব্বা যদি...

ফেরদৌসী রহমান: সব সময়। যখনই কোনো পুরস্কার পেয়েছি বা যখনই কোনো রেকগনিশন পেয়েছি, খালি মনে হতো যে আমার আব্বা থাকলে আজকে কত খুশি হতেন। ভালো করলে মনে হয় আমার আব্বা নাই কেন? যখন পাচ্ছি যে আল্লাহ দিয়েছে আমাকে... অবশ্য না চাইতে আল্লাহ দিয়েছে। তখন ন্যাচারালি আমার মনে হতো না যে আমার আব্বা তো এগুলো চেয়েছিলেন। এগুলো আমার একটাও চাওয়া না। এই পাওয়াগুলো কিন্তু আমার কখনো চাওয়া ছিল না। এগুলো আমার আব্বার চাওয়া ছিল—যে আমার মেয়েই করবে।

আনিসুল হক:

আপনার গানগুলো, সিনেমার যে গানগুলো, সবই ওই সময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে যখন ভাওয়াইয়া গানগুলো সিনেমায় ব্যবহৃত হলো, ওগুলোও খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল এবং রেডিওতে প্রায় প্রতিদিন বাজত।

আবার আপনি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। একুশে পদক পেয়েছেন। যত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার, সবই তো পেয়েছেন।

ফেরদৌসী রহমান: তখন আব্বাকে মিস করতাম বেশি।

আনিসুল হক:

আমরা মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার আপনাকে দিতে পেরে সম্মানিত বোধ করেছি।

বাংলাদেশ আমলে এসে রেডিও, টেলিভিশনে আপনি যে ‘এসো গান শিখি’ করলেন, সেটা তো আবার আরেক দফা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে জনপ্রিয়তা পেল। এই প্রজন্মের টেলিভিশন শিল্পীরা প্রায় সবাই আপনার কাছ থেকেই গান শিখেছেন।

ফেরদৌসী রহমান: বলতে গেলে, শুরুটা আমার কাছে। সেটা আমার একটা বিরাট  সৌভাগ্য। সত্যি কথা বলতে, সব যে আমি আমার নিজের ইচ্ছেমতো করেছি—আমি এটা চেয়েছি, আমি এটা করব—এ রকম কিন্তু নয়। এটাই সবচেয়ে মজার যে কোনো কিছু আমি চেয়ে করিনি। এগুলো কিন্তু আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে—গান শেখাতে হবে। আমি একেবারেই করতে চাইনি। যখন শুরু করলাম, তখন মোটেও রাজি ছিলাম না। আমি সবে নিজেই গান শিখছি, ছাত্রী। তখন তো আমি টিভিতে মাত্র প্রথম একটা প্রোগ্রাম করলাম। প্রথম দিন টিভি, ‘আচ্ছা, ফেরদৌসী বেগম গান করবে।’ ফেরদৌসী বেগম গাইল। এর আবার দুদিন পর কেন তাকে ‘এসো গান শিখি’ করতে হবে? ‘করব না আমি, মন্টু ভাই, প্লিজ, আমি করব না।’ (মন্টু ভাই হলেন মুস্তাফা মনোয়ার)।

ফেরদৌসী রহমানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন বাবা
ছবি: প্রথম আলো
আনিসুল হক:

আপনার হাজব্যান্ড রেজাউর রহমান...তিনি পোস্টগ্র্যাজুয়েশন নিয়ে বিলেতে গিয়েছিলেন।

ফেরদৌসী রহমান: পড়াশোনা করতে। ১০ বছর ছিল ওখানে। ইঞ্জিনিয়ারিং করছিল, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করছিল। একটু বাকি ছিল পড়া। সে জন্য আমাকেও যেতে হয়েছিল। এক বছর থাকতে হয়েছিল ওখানে।

আনিসুল হক:

তারপর ফিরে এসে উনি এই...

ফেরদৌসী রহমান: তারপর ফিরে এসে দ্য ইঞ্জিনিয়ার্সে জয়েন করল।

আনিসুল হক:

আচ্ছা। তারপর নিজের ফার্ম দিলেন।

ফেরদৌসী রহমান: ছোটখাটো একটা ইন্ডাস্ট্রির মতো করেছিল। ভালোই চলছিল। পরের দিকে একা হয়ে গেল। দুই ছেলেই বাইরে চলে গেল। আমার দুই ছেলে। বড় ছেলে রুবাইয়াত। ও এমবিএ করে আমেরিকা গিয়েছিল। এমবিএ করে ওখানে সেটেল করে গেছে।

আনিসুল হক:

ছোট ছেলে?

ফেরদৌসী রহমান: ছোট ছেলে রাজিন আইআইটি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছিল। বম্বে আইআইটি থেকে পড়ে আবার মস্কোতে কিছুদিন চাকরি করেছিল।

আনিসুল হক:

এখন কি লন্ডনে?

ফেরদৌসী রহমান: এখন লন্ডনে।

আনিসুল হক:

এখন মোটামুটি বাসায় ঘরে বসেই কাটাচ্ছেন। গুনগুন করে গান করেন?

এখনো গাওয়ার চেষ্টা করেন ফেরদৌসী রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ফেরদৌসী রহমান: চেষ্টা করি। আমি শুধু একটা জিনিসই মিস করি। সেটা হচ্ছে, চিৎকার করে গান করাটা। আগে তো সন্ধ্যায় প্রতিদিনই হারমোনিয়াম নিয়ে বসতাম এবং যে গানগুলো বাইরে গাইতাম না, যেমন রবীন্দ্রসংগীত—নিজের জন্য সেই গানগুলো নিয়মিত গাইতাম।

আনিসুল হক:

আপনার জীবনী পড়ছিলাম। তাতে আছে যে ফাহমিদা খাতুন একবার প্রথম হয়ে যান, আপনি অভিমান করে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি আজ আমাদের যেকোনো একটা রবীন্দ্রসংগীতের দুটি লাইন গেয়ে শোনাবেন?

ফেরদৌসী রহমান: ১০০টা শোনাতে পারি...গলার অবস্থা দেখছেন, কথা বলছি, তাতেই তো গলা উঠছে না।

আনিসুল হক:

আপনি কথা বলছেন আর আমার মনে হচ্ছে, আপনি গান করছেন।

ফেরদৌসী রহমান: শুনে খুশি হলাম। গাইতে পারলে আমি সবচেয়ে খুশি হতাম। যদি আপনাকে দুটি লাইন গেয়ে শোনাতে পারতাম, আমি সবচেয়ে খুশি হতাম। যাঁরা ভারত থেকে এসেছিলেন সে সময়, আব্বা থাকতেই, যেমন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন...তাঁরা সবাই এসেছিলেন। যখন পঙ্কজ কুমার মল্লিক এলেন—বোধ হয় ভারতীয় হাইকমিশনে একটা অনুষ্ঠান ছিল—তখন আমি একটি রবীন্দ্রসংগীত গাইলাম। ন্যাচারালি, তিনি যে কী খুশি! আব্বাকে এসে বলেছিলেন, ‘আপনার মেয়ে এত সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাইবে, এটা তো আমি ভাবতেই পারিনি।’ তো বেশ ভালো লেগেছিল শুনতে যে আমি গেয়েছি। রবীন্দ্রসংগীত খুব খুব মনপ্রাণ দিয়ে গাইতাম তখন। যখন আমাকে সেকেন্ড করা হলো, ওটা একটু কষ্ট ছিল। কিন্তু না অভিমান করলেও পারতাম। কারণ, সব সময় সবার গান যে একদম এক স্তরের হবে, তা তো নয়। তখন বাচ্চা ছিলাম তো, বুঝতে পারিনি যে ফাহমিদা খুব ভালো শিল্পী, খুব উঁচু স্তরের শিল্পী এবং...

আনিসুল হক:

ফাহমিদা খাতুনও আমাদের প্রথম আলোর আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন।

ফেরদৌসী রহমান: হ্যাঁ, ও তো অফকোর্স ডিজার্ভ করে এবং আমিও ওর গানের ভক্ত; সুতরাং আমি আর কী বলব।

আনিসুল হক:

এখন যাঁরা গান করেন, তাঁদের গান কি আপনি শোনেন?

ফেরদৌসী রহমান: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

সারা দিন তো নিশ্চয় আপনি গান শোনেন।

ফেরদৌসী রহমান: শুনি। সারা দিন নয়, কিছুটা সময়।

ফেরদৌসী রহমান মনে করেন গানের আগের সেই মান এখন নেই
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

সাধারণত কার গান ও কোন ধরনের গান শোনেন?

ফেরদৌসী রহমান: এখনকার শিল্পীরা যে গান করছে, শুনি। সত্যি বলতে, খুব মন দিয়ে শোনা হয় না। আমি বলব, গানের মান অনেক ফল করেছে। গানের আগের সেই মান কিন্তু নেই।

আনিসুল হক:

আগের জমানার গানগুলোর সুর, কথা অনেক ভালো ছিল। সেসব গান এখনো নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা গান এবং এখনো ভালো লাগে।

ফেরদৌসী রহমান: এখনকার শিল্পীরাও ভালো আছে, কণ্ঠ খুব ভালো। কিন্তু তারা সেই মানের গান পাচ্ছে না। সেই আবদুল আহাদ, সমর দাস, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, খান আতা, গাজী মাজহারুল আনোয়ার নেই। আর এই কথার মান যদি ভালো না হয়, তাহলে গানের সুরের মানও তেমন ভালো হয় না। আর দুটি তো একসঙ্গে  না হলে হয় না। কথা ভালো হলে একটা সুর অটোমেটিক্যালি ভালো হতে থাকে।

আনিসুল হক:

পুরোনো দিনের বাংলা গান বা রবীন্দ্রসংগীত বা শচীন দেববর্মনের—এ ধরনের গান কি শোনেন?

ফেরদৌসী রহমান: কম শোনা হয়। শচীন দেববর্মন শুনতে হলে শচীন দেববর্মনই শুনি। আমি একটু মিক্সড শুনি। সত্যি বলতে, আমাদের এখনকার বাচ্চাদেরও শুনি, আগের শিল্পীদেরও শুনি, পারলে ক্ল্যাসিক্যাল শুনি। ওটা বেশি।

আনিসুল হক:

আমি তো আপনার আব্বার গানও শুনি।  অনেক সুন্দর সুন্দর গান আছে। ‘কে যাস রে’ যে গানটা আমরা শচীন দেবের কণ্ঠে শুনি, আমার মনে হয়, এটা আপনার আব্বার কণ্ঠেও আছে।

ফেরদৌসী রহমান: থাকতে পারে। আব্বা হয়তো গেয়েছেন; কিন্তু ওটা আমি বলতে পারছি না। ইউটিউবে আব্বার কিছু গানের কোয়ালিটি অব মিউজিক খুব ভালো আছে। আগের রেকর্ডে সারফেস নয়েজ ছিল... সেগুলোর সারফেস নয়েজ কেটে কেটে অনেকে ইউটিউবে ভালো বের করেছে...সেগুলো শোনা যায় অনেক সময়।

আনিসুল হক:

আপনার কি ছোটবেলার ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার কোনো স্মৃতি মনে আছে?

ফেরদৌসী রহমান: ঈদুল ফিতরটাই বেশি মনে আছে। কারণ, সেমাইটা বাড়িতে বানানো হতো। ওটা নিয়ে লড়াই লাগত। এ বলে, ‘আমি বানাব...’, ও বলে, ‘আমি ঘোরাব!’  ভাইবোন, চাচাতো ভাইবোনদের মধ্যে লড়াই লাগত। ওই স্মৃতিগুলো মনটাকে বেশি নাড়া দেয় আরকি।

আনিসুল হক:

এখন যদি আপনাকে টাইম মেশিনে আপনার শৈশবে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, আপনি কি কোচবিহারে যাবেন, কলকাতায় যাবেন, নাকি নারিন্দায়?

ফেরদৌসী রহমান: কোচবিহারে যাব।

আনিসুল হক:

শৈশব! জন্মস্থান!

ফেরদৌসী রহমান: কোচবিহারে যাব। যতবারই বলুন কোথায় যাবেন—কোচবিহারে যাব। বলরামপুর যাব, আমার দাদার বাড়িতে ওই পুকুরে মাছ ধরব। সেই যে বর্ষাকালে জল কেটে দেওয়া হতো আর সব মাঠে মাছ চলে আসত। ওগুলো খুব ছোটবেলার স্মৃতি। কিন্তু এত/ভিভিড স্মৃতি যে ওগুলো হন্ট করে আমাকে। কলকাতা হন্ট করে অন্য রকম। পার্ক সার্কাসে গান করতাম, কামরুল হাসান ভাই ছিল। ওগুলো অন্য রকমের। কিন্তু বলরামপুর বা কোচবিহারের স্মৃতিগুলো একদম ছোটবেলায়। চাচাতো ভাইবোন সব...চাচাতো, ফুফাতো ভাইবোনেরাই বেশি হইচই করেছি। আমরা বাড়িতে বারান্দায় কাপড় দিয়ে স্টেজ বানিয়ে নাটক করেছি, ঈদের নাটক করেছি। আবদুল করিম, আমার চাচা। তাঁর লেখা গান করেছি, তাঁর লেখা নাটক করেছি। এসব স্মৃতি এমন করে জড়িয়ে আছে যে এগুলোর বাইরে আর কিছু....নারিন্দাতে কখনো ফিরে যাই...মানে চট করে যদি আপনি বলেন যে কলকাতা থেকে ঢাকায়...তো ওই স্মৃতিগুলো খুব কষ্টের। ওই সময়ে সব ছেড়ে আসা...কোচবিহার, বলরামপুর, কলকাতা ছেড়ে একদম এখানে ঢাকায় মাসের পর থেকে...স্মৃতিটা একটু অন্য রকম।

সবার মতো শৈশবের স্মৃতি টানে ফেরদৌসী রহমানকে
ছবি: সংগৃহীত
আনিসুল হক:

সবারই তা–ই হয়—শৈশবের স্মৃতি, নাড়ির টান।

ফেরদৌসী রহমান: ওই যে প্রান্তর, গাছপালা, পুকুর, মাছ—এগুলো আমাদেরও খুব টানে, তাই না? ওই যে গরু। এখানে আমরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়তাম। তার মধ্যে কাপড় টাঙিয়ে দিতে হতো। কারণ, পর্দা করতে হতো। রিকশায় বসলে মা, আমি গেলে...রিকশায় আমি সারাক্ষণ শাড়িটা টানতে থাকতাম। আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? ওখানে কেন আমাকে কাপড়ের তলে বসতে হবে? খুব কষ্ট দিত ওটা। ‘আব্বা আব্বা! কোথায় এলাম আমরা?’ এ রকম একটা রিকশায় বসব, তারও চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘেরা। ঘোড়ার গাড়িতে তো চারদিকে ঢাকনা দেওয়া। তারপরও কাপড় দিয়ে এ রকম...।

আনিসুল হক:

আপনার উত্তরসূরিরা—নাশিদ কামাল আপা, আরমিন মুসা—তাঁরা তো বড় আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ডের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন। এসবের জন্য গর্ব হয় না?

ফেরদৌসী রহমান: ওরা ভালো না করলে বোধ হয় অবাক হতাম। কারণ, সব সময় মনে হয় যে পরের জেনারেশন বেটার হবে আরও।

স্বামী রেজাউর রহমান, বড় ছেলে রুবাইয়াৎ রহমান ও তাঁর দুই সন্তানের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমান
ছবি : সংগৃহীত
আনিসুল হক:

কারণ, তিনি আব্বাসউদ্দীনকে পেয়েছেন; ফেরদৌসী রহমান, মোস্তফা আব্বাসীকে পেয়েছেন।

ফেরদৌস রহমান: ওরা যে ওপেনিংটা পাচ্ছে, সেটা তো আমরা অতটা পাইনি এবং ওরা স্বীকৃতি না পেলেই বরং অবাক হতাম যে ওরা পাচ্ছে না। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আশা করি ওরা আরও ভালো করবে—আমাদের শিল্পীরা, সব শিল্পী।

আনিসুল হক:

আপনি আমাদের মাঝে আছেন, আপনি আমাদের মাঝে চিরকাল থাকবেন। আপনার গানগুলো—সেটা ভাওয়াইয়া গানই হোক, ইসলামি গানই হোক বা  আধুনিক গান এবং অবশ্যই সেই যে ‘ঝড় এল এল ঝড়...’। বাংলাদেশে এখনো ঝড় হয়, এখনো কালবৈশাখী হয়, এখনো ঝড় এলেই...কী বলে, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীতে যে রকম হয়...যখনই এটা হয়, তখনই কিন্তু আমরা গেয়ে উঠি, ‘ঝড় এল এল ঝড়...’। ফেরদৌসী আপা, আপনার মূল্যবান সময় আমাদের অনেকটা দিয়েছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ফেরদৌসী রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ। সত্যি বলতে, আমি আজ বলছিলাম যে কত বছর পর রেকর্ডিং। অনেক বছর পর রেকর্ড করলাম। বহুদিন করি না, শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল বলে। আজ করে খুব ভালো লাগছে। মনে হয়, আজ ভালো ঘুম হবে।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, আপনি ভালো থাকবেন এবং আপনার কথা ও অতীতের কথা বললেও তো মানুষের হৃদয়–মন চাঙা হবে, শরীরটাও চাঙা হয়ে যাবে। আপনি ভালো থাকবেন।