পিছিয়ে থাকবে না বাংলাদেশ

শিখো-প্রথম আলো জিপিএ–৫ প্রাপ্ত কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেলফি তুলছেন চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ, পাশে অভিনেত্রী আফসান আরা বিন্দু। গতকাল সাভারের ফ্যান্টাসি কিংডমে
ছবি: জাহিদুল করিম

‘জায়গাটা খুব সুন্দর। আয় ছবি তুলি’ বলেই সাবিহা তাবাসসুম ‘আহসান মঞ্জিলের’ সিঁড়ির ওপর গিয়ে বসল। ছুটে গিয়ে তার সঙ্গে বসল তাইয়েবা সুলতানা, জয়িতা অস্মিতা রায়। মুঠোফোনে তোলা হলো ছবি।

এই চিত্র ঢাকার আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডমের। সেখানে আহসান মঞ্জিলসহ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার অনুকৃতি রয়েছে। ‘শিখো-প্রথম আলো’ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী সংবর্ধনায় এসে তাইয়েবার মতো অনেককেই এমন ছবি তুলতে দেখা গেল সেখানে।

গতকাল মঙ্গলবার সারা দিন সেখানে আনন্দ উৎসব করে নতুন প্রজন্মের কৃতী শিক্ষার্থীরা দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশ আর কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকবে না। দেশকে এগিয়ে নিতে তারা সর্বোচ্চ আত্মশক্তি নিয়োগ করবে। গলা ফাটিয়ে তারা চিৎকার করেছে ‘জয় হবে, বাংলাদেশের জয়’।

আনন্দে মাতামাতি

গতকাল সকাল আটটা থেকে ফ্যান্টাসি কিংডমে শুরু হয় ঢাকার কৃতী শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দিনের সংবর্ধনা উৎসব। এতে অংশ নেয় প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী। সারা দিন কৃতী শিক্ষার্থীরা গান শোনা, ছবি তোলা, রাইডে ওঠা ও ঘোরাঘুরির আনন্দে মেতে ওঠে।

গত সোমবার প্রথম দিনের উৎসবে অংশ নেয় প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী। প্রথম আলো এই আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেছে শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’র পৃষ্ঠপোষকতায়। এতে সহযোগিতা করছে ফ্রেশ, কনকর্ড, এটিএন বাংলা ও প্রথম আলো বন্ধুসভা। চিকিৎসা সহায়তায় ছিল ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল লিমিটেড।

এবার সারা দেশে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের মধ্যে কৃতী সংবর্ধনার জন্য নিবন্ধন করেছে এক লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। এই কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া শুরু হয়েছে গত ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে। শেষ হবে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি। সারা দেশের ৬৪ জেলায় পর্যায়ক্রমে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার এই আয়োজন করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আয়োজিত হলো ঢাকার শিক্ষার্থীদের দুই দিনব্যাপী সংবর্ধনা।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আসা তাবাসসুমের মা জোবায়দা আক্তার ও জয়িতার মা প্রতিমা রায় জানালেন, তাঁদের মেয়েরা সবাই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী। প্রথম শ্রেণি থেকেই ওরা একসঙ্গেই পড়ছে। ওদের ছয়জনের একটি দল। সবাই জিপিএ-৫ পেয়েছে।

তাই সবাই মিলে মাইক্রোবাস ভাড়া করে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছেন। মেয়েদের বাবারা কেউ চাকরি করেন, কেউ ব্যবসায়ী। তাঁদের সময় নেই। মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে এই উৎসবে আনা—সব দায়িত্ব মায়েদেরই। মেয়েদের মতো মায়েরাও পরস্পরের বন্ধু হয়ে গেছেন। মেয়েদের মতো তাঁরাও বেশ আনন্দ করছেন।

অনুষ্ঠানে দল বেঁধে এসেছিল ডেমরার দারুল জান্নাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসার মেরাজ আহমেদসহ ১৪ জন। তারা সবাই এবার দাখিলে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তারা জানাল, সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে ফজর নামাজ আদায় করে ছয়টায় যাত্রা শুরু করেছে। প্রথম এসেছে আবদুল্লাহপুর। সেখান থেকে আবার আরেক বাসে এসেছে আশুলিয়া। সময় লেগেছে প্রায় তিন ঘণ্টা। তবে এখানে এসে তাদের খুব আনন্দ হচ্ছে।

বুথে ভিড়

প্রথম আলো পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের স্টলে ছিল কিশোর আলো ও বিজ্ঞান চিন্তা—এই দুটি ম্যাগাজিনের বিশেষ প্যাকেজ। এই প্যাকেজ ছাড়াও কৃতী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথমা প্রকাশনের স্টলে প্রথমার সব বইয়ে দেওয়া হয় ২৫ শতাংশ ছাড়। এ ছাড়া অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকিতে কৃতী শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল ১৫ দিনের ফ্রি সাবস্ক্রিপশন। সেখানেও দেখা গেল শিক্ষার্থীদের ভিড়।

চাই বাংলাদেশের জয়

দুপুরের খাবারের পর উৎসব মঞ্চের অনুষ্ঠান জমজমাট হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয় শিল্পীদের গান, বিনোদনজগতের তারকাদের কথোপকথন আর অতিথিদের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন। স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের দেশ এগিয়ে যাক, আলোকিত হোক। সে জন্য আগে নিজেদের আলোকিত হতে হবে। নিজেরা নিজেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধে আলোকিত করে তুললেই দেশ আলোকিত হবে।’

আলোচনা পর্বে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) উপাচার্য তানভীর হাসানকে মঞ্চে নিয়ে আসেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ।

রাশেদা কে চৌধূরী শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘তোমরা সফল হয়েছ, কিন্তু তোমাদের বয়সী অনেকেই এখন জীবিকার জন্য কঠিন যুদ্ধ করছে। অনেক বালিকা, কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে স্কুলের পড়া শেষ করার আগেই। তাদের কথাও ভাবতে হবে। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য তোমাদের কিছু করতে হবে। কেবল একার সাফল্য নিয়ে ভাবলে চলবে না।’ শিক্ষার্থীদের তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যে যেখানেই কাজ করো না কেন, কখনো ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হবে না।’

পারভীন হাসান শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘তোমাদের সামনে প্রায় পুরো জীবনটাই পড়ে আছে। জীবনে নতুন কিছু করতে কখনো সংকোচ করবে না। নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে। আর কখনো নকল করবে না, অনুকরণ করবে না। যেটাই করবে, পুরো মন দিয়ে করবে।’

তানভীর হাসান তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘জীবনে যে ক্ষেত্রেই কাজ করো, যা-ই হও না কেন, সব সময় সেই ক্ষেত্রে সেরা হওয়ার চেষ্টা করবে। তবে শুধু কাগজে-কলমে প্রথম হলে চলবে না, মানবিকতাতেও শ্রেষ্ঠ হতে হবে। ব্যর্থতা এলে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখবে জীবন এক শ মিটার দৌড় নয়, এটা এক দীর্ঘ ম্যারাথন। সেই প্রস্তুতি নিয়ে এগোতে হবে।’

সাজ্জাদ শরিফ শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্য বিভিন্ন বিষয়ের বই, পত্রপত্রিকা পড়তে উৎসাহ দেন। তিনি বলেন, ‘দেশের যোগ্য নাগরিক হতে হলে তোমাদের দেশকে ভালো করে জানতে হবে।’

এ পর্বে প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান শিক্ষার্থীদের মাদক, মুখস্থ ও মিথ্যার প্রতি ‘না’ বলার অঙ্গীকার করান। আলোচনায় অংশ নিয়ে উৎসবের সহযোগী ‌‘শিখো’র সহপ্রতিষ্ঠাতা জিসান জাকারিয়া শিক্ষার্থীদের নিয়মানুবর্তী হওয়ার পরামর্শ দেন। কনকর্ডের নির্বাহী পরিচালক অনুপ কুমার সরকার শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান। শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বক্তব্য দেয় সাবিহা জামাল।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা কী চাই?’ সমস্বরে উত্তর এল ‌‘বাংলাদেশর জয়’। তিনি বলেন, ‘শুধু ক্রিকেটে নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে, সর্বসময় আমাদের চাওয়া, আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের জয়। এটা একটা যুদ্ধের মতো। তোমারই দেশের ভবিষ্যৎ, তোমরাই শক্তি। এই যুদ্ধে তোমাদের বিজয়ী হতে হবে। আর যে মা-বাবা, শিক্ষক তোমাদের জন্য অনেক পরিশ্রম, অনেক কষ্ট করেছেন, তাঁদের সব সময় সম্মান করতে হবে। বড় হয়ে তাঁদের পাশে থাকতে হবে।’ তিনি মা-বাবা, শিক্ষক, অভিভাবকদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

জাঁকালো সাংস্কৃতিক আয়োজন

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চে সাংস্কৃতিক আয়োজন আর আলোচনা একই সঙ্গে চলেছে। আলোচনার মাঝেমধ্যে ছিল গান, তারকাদের প্রেরণামূলক কথোপকথন। এরপর শুরু হয়েছিল এ আয়োজনে একসময় নিয়মিত আসা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করে। তাঁর গান ‘বাংলাদেশ’-এর সুর পরিবেশনার পর গানের পালা শুরু করেন শিল্পী ঋতুরাজ ও নন্দিতা ‘আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে’ দিয়ে।

পরে তাঁরা পরিবেশন করেন ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’। এরপরে কোনাল গেয়ে শুনিয়েছেন ‘ভালোবাসার মানুষ তুমি’ ও ‘কমলায় নৃত্য করে’। এরপর মঞ্চে আসেন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী আফসান আরা বিন্দু ও আরিফিন শুভ। কৃতী শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে তাঁরা জানান চরকিতে ১৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাচ্ছে তাঁদের নতুন চলচ্চিত্র উনিশ-বিশ। তাঁরা চলচ্চিত্রটি দেখার আমন্ত্রণ জানান।

অবন্তী সিঁথি গেয়ে শুনিয়েছেন ‘রূপকথার জগতে’। হাওয়া সিনেমার জনপ্রিয় গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গেয়েছেন এরফান মৃধা। শেষে মঞ্চে আসেন চিরকুটের শিল্পীরা। তাঁরা ‌‘কানামাছি’, ‘জাদুর শহর’, ‘আহারে জীবন’, ‘লালে লাল’ গানগুলো গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন। এমন জাঁকালো আনন্দ আয়োজনের স্মৃতি নিয়ে সন্ধ্যায় ফ্যান্টাসি কিংডম থেকে ঘরের পথে ফিরে গেছে দেশের আগামী দিনের কর্ণধারেরা।