পঙ্কজ ভট্টাচার্য: আজীবন অনমনীয় যোদ্ধার প্রয়াণ
পঙ্কজ ভট্টাচার্য চলে গেলেন। গতকাল রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এর ফলে ৮৪ বছরের একটি উজ্জ্বল কর্মময় জীবনে নেমে এল যবনিকা। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষের মেরুদণ্ডধারী শেষ ব্যক্তিদের অন্যতম।
১৭ এপ্রিল শ্বাসতন্ত্রীয় জরুরি সমস্যার কারণে পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। আগে থেকেই তিনি কিছু জটিল রোগে ভুগছিলেন। সেগুলো ছিল শ্বাসতন্ত্রীয় রোগ ব্রঙ্কেইকটেসিস, হৃদ্রোগ (ইশকেমিক হার্ট ডিজিজ), উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি। তিনি কোভিডজনিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। শ্বাসতন্ত্রীয় জটিলতায় তাঁর ফুসফুসের কিছু অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয়। সে জন্য তাঁকে দিনের অধিকাংশ সময় অক্সিজেন নিতে হতো। প্রোস্টেটে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর প্রোস্টেটের অপারেশন করা হয়েছিল।
মলাশয়ের ওপর অংশ বা কোলনে টিউমার ধরা পড়ায় সেখানেও একটি জটিল অপারেশন মাত্র কিছুদিন আগে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে সম্পন্ন করা হয়েছিল। ১৭ এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর ফুসফুসে নিউমোনিয়া এবং শরীরে সেপটিক শক শনাক্ত করা হয়। গত শনিবার সকালে তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। এতে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের সম্মিলিত তত্ত্বাবধানে পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু এবার তাঁকে ধরে রাখা গেল না। চিকিৎসকদের সমস্ত প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে গতকাল তিনি চলে গেলেন।
গত শতাব্দীর ষাটের দশক হচ্ছে বাঙালির ইতিহাসের একটি হিরণ্ময় সময়খণ্ড। সে সময় কিছু তরুণ ছাত্র-রাজনৈতিক কর্মীর উত্থান ঘটে, যাঁদের শরীরজুড়ে ছিল এ দেশের মাটির গন্ধ। দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা দিয়ে তাঁদের মেরুদণ্ড তৈরি হয়েছিল। মানুষের মুক্তির জন্য তাঁরা ছিলেন উৎসর্গকৃত। তাঁদের একজন হলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
১৯৩৯ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে জুলাই মাসে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী এবং নারী অধিকার নেত্রী রাখী দাশ পুরকায়স্থের সঙ্গে তিনি বিয়ের বাঁধনে আবদ্ধ হন। ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল রাখী দাশ পুরকায়স্থ প্রয়াত হন।
স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের উজ্জ্বল সৈনিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে ১৯৬৭ সালে ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হয়। তিনি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের রূপকারদের একজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকদের তিনি। আমৃত্যু তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষের মানুষ। লোভ, লালসা, বিত্ত বা ক্ষমতার কাছে কখনো তিনি মস্তিষ্ক বন্ধক দেননি অথবা শাসকের রক্তচক্ষুর কাছে মাথা নত করেননি। তিনি ছিলেন আজীবন অনমনীয় যোদ্ধা। এটি যেমন রাজনীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাতিঘরসদৃশ মানুষটির জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা, নিরন্তর ভালোবাসা।
লেখক: চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ