খাবারে রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের ব্যবহারই কি ক্যানসার বৃদ্ধির জন্য দায়ী

ক্যানসার সেলরয়টার্স

ক্যানসারকে সাধারণত বয়স্ক মানুষের রোগ বলে ধরা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় উদ্বেগজনক কিছু তথ্য উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, ৫০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ক্যানসারের হার ক্রমেই বাড়ছে।

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার টিভি অনুষ্ঠান ‘এবিসি ফোর কর্নার্স’-এ বলা হয়েছে, খাবারে থাকা রাসায়নিক পদার্থ, এমনকি প্লাস্টিকের অংশবিশেষও কম বয়সীদের মধ্যে ক্যানসারের হার বৃদ্ধির পেছনে সম্ভবত অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

প্রশ্ন হলো, কম বয়সীদের মধ্যে ক্যানসার বৃদ্ধির বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত কী বলছে? আর যদি তা-ই হয়, তবে আমাদের করণীয়ই-বা কী।

ডিএনএ মিউটেশন নিয়ে হরেদরে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। কারণ, বেশির ভাগ ডিএনএ মিউটেশনই ক্ষতিকর নয়।

ক্যানসার ও বয়স্ক মানুষ

আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে ডিএনএর একটি কপি থাকে, যা কোষকে ঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। কিন্তু কখনো কখনো ডিএনএ এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা মিউটেটেড (রূপান্তরিত) হতে পারে, যার ফলে কোষ আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না।

কিছু মিউটেশনের ফলে কোষের আচরণ বদলে যায়। ফলে একটি কোষ অতিরিক্ত হারে নিজের কপি তৈরি করতে শুরু করে ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকে। আবার কিছু মিউটেশন কোষকে স্বাভাবিক মৃত্যু থেকে রক্ষা করে। আর এমন কিছু মিউটেশনও আছে, যেগুলো কোষকে শরীরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে; যেখানে তাদের থাকা উচিত নয়।

ডিএনএ এ ধরনের অস্বাভাবিক মিউটেশন একটার পর একটা হতে থাকলে একপর্যায়ে তা ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।

আমাদের শরীরে যখনই একটি নতুন কোষ তৈরি হয়, তখনই ডিএনএর একটি কপিও নতুন করে তৈরি হয়। এ প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো কাকতালীয়ভাবে ভুল হয়। এমনটি হলে ডিএনএতে জেনেটিক মিউটেশন ঘটে।

বিষয়টি বুঝতে আমরা একটি মূলপাতা বা মূলপৃষ্ঠা থেকে অসংখ্য ফটোকপি করার কথা ভাবতে পারি। যতই করা হোক, প্রতিটি নতুন ফটোকপি কিন্তু মূলটা থেকে সামান্য হলেও আলাদা হয়। তবে ডিএনএ মিউটেশন নিয়ে হরেদরে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। কারণ, বেশির ভাগ ডিএনএ মিউটেশনই ক্ষতিকর নয়।

প্লাস্টিক বর্জ্য
রয়টার্স

সমস্যা হলো, আমাদের শরীরে প্রতিদিনই শত শত কোটি নতুন কোষ তৈরি হচ্ছে। ফলে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের শরীরে ডিএনএর কপিও বাড়তে থাকে। ডিএনএর নতুন কপির সঙ্গে বাড়ে পাল্লা দিয়ে ভুলের শঙ্কাও।

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের শরীর দুর্বলও হয়ে পড়ে। ফলে এর পক্ষে বিপজ্জনক মিউটেশনযুক্ত কোষ চিহ্নিত করে সেগুলো সরিয়ে ফেলার দক্ষতা কমে যায়। আর এ কারণেই বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

প্লাস্টিক মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশ—উভয়ের জন্যই একটি বড়সড় সাধারণ ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কম বয়সীদের মধ্যে ক্যানসার

তরুণদের মধ্যে ক্যানসারের হার বৃদ্ধি নিয়ে নানা ধরনের উদ্বেগ রয়েছে। একটি বড় উদ্বেগের কারণ হলো, এর সঙ্গে এমন কিছু পরিবেশগত কারণ জড়িত থাকার আশঙ্কা রয়েছে, যা গবেষকেরা এখনো ঠিকমতো জানেন না।

পরিবেশগত কারণ বলতে রাসায়নিক পদার্থ, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া, আমরা কতটা শরীরচর্চা করি এবং কী খাই ইত্যাদি বোঝায়।

এসব পরিবেশগত উপাদানের অনেক কিছুই ডিএনএর নতুন কপি তৈরিতে ভুল হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায় কিংবা আমাদের ডিএনএকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।

পরিবেশগত কারণের একটা সুপরিচিত উদাহরণ হলো সূর্যের অতিবেগুনি (ইউভি) রশ্মির বিকিরণ। এর কারণে ত্বকের ক্যানসার হতে পারে। আরেকটি উদাহরণ হলো ধূমপান। এটি ফুসফুসের ক্যানসার ডেকে আনে।

সৌভাগ্যক্রমে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির বিকিরণ থেকে সুরক্ষা নেওয়া ও ধূমপানের বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে অস্ট্রেলিয়ায় ৫০-এর কম বয়সী মানুষের মধ্যে ত্বক ও ফুসফুসের ক্যানসার কমেছে।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় তরুণদের মধ্যে লিভার, অগ্ন্যাশয়, প্রস্রাবথলি (প্রোস্টেট), স্তন ও কিডনির ক্যানসার বেড়েছে। এ প্রবণতা শুধু অস্ট্রেলিয়াতে নয়, ধনী ও পশ্চিমা দেশগুলোতেও বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের ফলে ক্যানসারের সামগ্রিক ঝুঁকি কমে।

রাসায়নিক পদার্থের ভূমিকা

তরুণদের মধ্যে ক্যানসারের হার বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো বের করা যায়নি। এটা নিয়ে নানা গবেষণা চলছে। গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত উপাদান হিসেবে গবেষকেরা এ অনুসন্ধানে রাসায়নিক পদার্থের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন।

আধুনিক যুগে আমরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসি, যেমন বায়ুদূষণের নানা উপকরণ, খাদ্যে ব্যবহৃত কৃত্রিম উপাদান, প্লাস্টিক ইত্যাদি।

যেসব উপাদান ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে এবং আমাদের চারপাশে সহজলভ্য সেগুলোর মধ্যে অ্যালকোহল ও সিগারেটের ধোঁয়া অন্যতম। এসবের বাইরে যেসব রাসায়নিক ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে বলে প্রমাণিত, অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত সেগুলো ব্যবহার করেন না বা সেগুলোর সংস্পর্শে আসেন না। কারণ, এসব রাসায়নিক মূলত শিল্পকারখানার মতো নির্দিষ্ট পরিবেশে সীমাবদ্ধ থাকে।

যেসব রাসায়নিক নিয়ে বেশি উদ্বেগ রয়েছে, প্লাস্টিক সেসবের অন্যতম। এটি এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের প্রায় সবাই প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে প্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসছি।

নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদী
ফাইল ছবি

প্লাস্টিক মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশ—উভয়ের জন্য এক বড় সাধারণ ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু সমস্যা হলো হাজার ধরনের প্লাস্টিক রয়েছে। প্লাস্টিকের প্রকারভেদ এত বেশি যে এর ফলে নির্দিষ্ট কোন প্লাস্টিক কোন রোগ বা সমস্যার জন্য দায়ী, তা সুনির্দিষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্যানসারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট কোন প্লাস্টিক ক্যানসারের জন্য দায়ী, তা শনাক্ত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাণীদের ওপর করা গবেষণাগুলো থেকে অনেক সময় রাসায়নিকের ঝুঁকি সম্পর্কে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কারণ, প্রতিদিনই আমরা হাজারো ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশগত উপাদানের সংস্পর্শে আসি। তাই এটা নিশ্চিতভাবে বলা খুব কঠিন, ‘কোন নির্দিষ্ট উপাদান কোন নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসারের জন্য দায়ী।’ তাই কম বয়সীদের মধ্যে ক্যানসার বৃদ্ধির জন্য একটি নির্দিষ্ট কারণকে স্পষ্ট করে দায়ী করা সম্ভব নয়।

বিষয়টি বোঝাতে আমরা কোলোরেক্টাল বা বাওয়েল ক্যানসারের একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এটি সাধারণ ভাষায় বৃহদন্ত্রের ক্যানসার হিসেবে পরিচিত।

আরও পড়ুন

কম বয়সীদের মধ্যে বাওয়েল ক্যানসার

বয়স্ক মানুষের মধ্যে বাওয়েল ক্যানসারের হার কমছে। এর পেছনে নানা কারণ আছে। একটি কারণ হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও স্ক্রিনিংয়ের উন্নতি, যা ক্যানসারে পরিণত হওয়ার আগেই বিপজ্জনক কোষগুলো শনাক্ত করে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। কিন্তু আশঙ্কার কারণ হলো, কম বয়সীদের মধ্যে এই ক্যানসারের হার বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, প্লাস্টিকের বেশি সংস্পর্শের কারণে এমনটি হয়ে থাকতে পারে। কারণ, আমরা যে খাবার খাই, তার মাধ্যমে পাচনতন্ত্র প্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসে। এর মধ্যে ন্যানো বা মাইক্রো প্লাস্টিক এবং পিএফএএসের মতো প্লাস্টিক থেকে খাবারে ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিক পদার্থ অন্যতম।

তবে আরও কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে, যেমন খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা। মোটা হওয়া ও অ্যালকোহল সেবনের সঙ্গে ক্যানসারের হার বৃদ্ধির সম্পর্ক পাওয়া গেছে।

কম বয়সীদের মধ্যে ক্যানসার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার হাতও থাকতে পারে। আমাদের শরীরের মাইক্রোবায়োমে থাকা ব্যাকটেরিয়ার ধরনগুলো বাওয়েল ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তবে শুধু ব্যাকটেরিয়া থাকার কারণেই নয়; বরং এদের তৈরি করা কিছু বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণেও এমন ক্যানসার হতে পারে।

আরও পড়ুন

করণীয়

কম বয়সীদের মধ্যে ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধির সঙ্গে রাসায়নিকের সরাসরি সম্পর্ক এখনো চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা চলছে। চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া না গেলেও প্লাস্টিক ও রাসায়নিকের ব্যবহার এবং এসবের সংস্পর্শ যতটা সম্ভব কমানোকে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস বলে মনে করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের ফলে ক্যানসারের সামগ্রিক ঝুঁকি কমে।

পরিশেষে বলতে হয়, আমাদের কারও যদি কোনো উদ্বেগের বিষয় থাকে, বিশেষ করে পরিবারে কারও যদি আগে ক্যানসার হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।

আরও পড়ুন