প্রকল্প শেষ হতেই গ্রাম আদালত গতিহীন

প্রকল্পের অধীনে গ্রাম আদালতের মামলার হিসাব রাখা হতো। এখন মামলার হালনাগাদ কোনো তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।

ফাইল ছবি

দেশের ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে (ইউপি) গ্রাম আদালত কার্যকর করতে ২৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। কিন্তু প্রকল্প শেষ হতেই ঝিমিয়ে পড়েছে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম। প্রকল্পের অধীনে গ্রাম আদালতের মামলার হিসাব রাখা হতো। এখন মামলার হালনাগাদ কোনো তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।

দেশে ২০০৬ সালে গ্রাম আদালত আইন হয়। গ্রাম আদালত আইন অনুযায়ী, ছোটখাটো ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিরোধ স্থানীয়ভাবে মীমাংসার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। এই আদালত সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে। চুরি, ঝগড়া, প্রতারণা, ভয়ভীতি দেখানো, নারীর শালীনতাকে অমর্যাদা, পাওনা টাকা আদায়, গবাদিপশুর ক্ষতির মতো বিরোধের নিষ্পত্তি গ্রাম আদালত করতে পারে।

দেশের ৪ হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়নেই গ্রাম আদালত রয়েছে। কিন্তু সব ইউনিয়নে গ্রাম আদালতগুলো সক্রিয় ও কার্যকর নয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশের গ্রাম আদালতব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে একটি প্রকল্প নেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ইউনিয়ন পরিষদে ‘বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ’ শীর্ষক এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়িত হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প শেষ হয়েছে গত জুনে।

অধিকাংশ ইউনিয়নেই গ্রাম আদালত বসে না। আদালত পরিচালনা করার মতো ন্যূনতম প্রশিক্ষণও নেই অধিকাংশ চেয়ারম্যান ও সদস্যের।
সবুর আলী সেখ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম

এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নের গ্রাম আদালতগুলোর কার্যক্রমের নিয়মিত মূল্যায়ন হতো। তবে প্রকল্পের বাইরে থাকা ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে গ্রাম আদালত কার্যক্রমের কোনো তদারকি হয়নি। প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে ‘গ্রাম আদালত সহকারী’ পদে নিয়োগ দেওয়া ব্যক্তিরা গ্রাম আদালতের সব কার্যক্রমে সহায়তা করতেন। প্রকল্প শেষ হওয়ার প্রায় বছরখানেক আগেই তাঁদের বিদায় করা হয়েছে। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরদের গ্রাম আদালতের পেশকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁদের গ্রাম আদালতসংক্রান্ত কোনো প্রশিক্ষণ নেই।

স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ইউনিয়ন পরিষদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্পের অধীনে দেওয়া গ্রাম আদালতের এজলাস এখন অব্যবহৃত থাকছে। গ্রাম আদালত সহকারী না থাকায় মামলা নথিভুক্ত করা, দুই পক্ষকে নোটিশ দেওয়া, সাক্ষ্য ও রায় লেখার কাজ হচ্ছে না। তবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা নিজেদের মতো করে সালিস-মীমাংসা করছেন। সেগুলো গ্রাম আদালতের কার্যক্রম হিসেবে নথিভুক্ত হচ্ছে না।

গ্রাম আদালত সহকারী সমিতির সহসভাপতি বিশ্বজিৎ রায় সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদে কর্মরত ছিলেন। প্রকল্প শেষ হওয়ায় তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প শেষ হতেই অধিকাংশ ইউপিতে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম কমে গেছে।

ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌর ও রমাগঞ্জ ইউনিয়নে আগে নিয়মিত গ্রাম আদালত পরিচালিত হতো। বর্তমানে সেখানে গ্রাম আদালত কার্যক্রম অনিয়মিত। এই বিষয়ে রমাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প শেষ হতেই গ্রাম আদালতের কার্যক্রম ঝিমিয়ে গেছে। হিসাব সহকারী না থাকায় ইউপি সচিবকে পেশকারের কাজ করতে হয়। কিন্তু সচিবের নানা ধরনের কাজ থাকায় গ্রাম আদালতকে গুরুত্ব দিতে পারেন না।

স্থানীয় সরকার বিভাগ ইউনিয়ন পরিষদের হিসাব সহকারীদের গ্রাম আদালতের পেশকারের দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু দেশের অনেক ইউনিয়ন পরিষদে হিসাব সহকারী নেই। যেসব ইউনিয়নে হিসাব সহকারী নেই, সেখানে ইউনিয়ন সচিব গ্রাম আদালতের পেশকারের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু হিসাব সহকারী ও সচিবদের গ্রাম আদালতের কার্যক্রম বিষয়ে যেমন প্রশিক্ষণ নেই, তেমনি গ্রাম আদালতের কাজের জন্য তাঁরা আলাদা কোনো সম্মানীও পান না। ফলে হিসাব সহকারী ও ইউপি সচিবেরা গ্রাম আদালতের বিষয়ে উৎসাহী কম।

গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত প্রকল্পভুক্ত ইউনিয়নগুলোর গ্রাম আদালতে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯১টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৩ শতাংশ মামলা। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে ১৯১ কোটি ২৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সংগঠন বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সবুর আলী সেখ প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ইউনিয়নেই গ্রাম আদালত বসে না। চেয়ারম্যানরা মনে করেন, পাঁচ সদস্যের আদালতের ফলে তাঁদের ক্ষমতা কমে যায়। আদালত পরিচালনা করার মতো ন্যূনতম প্রশিক্ষণও নেই অধিকাংশ চেয়ারম্যান ও সদস্যের।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গ্রাম আদালত সক্রিয়করণে আরেকটি নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। অনুমোদন পেলে আগামী বছর এই প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে।

গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পের পরিচালক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মলয় চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুতই গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায় শুরু করা হবে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী মহসিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানরা সালিস করতে বেশি আগ্রহী। ফলে তাঁরা আন্তরিকভাবে গ্রাম আদালত পরিচালনা করতে চান না। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনেরও প্রভাব থাকছে আদালতের কার্যক্রমে। নতুন প্রকল্প নিয়ে এটি কতটা কার্যকর করা যাবে তা নিশ্চিত নয়। তিনি বলেন, গ্রাম আদালতকে ইউনিয়ন পরিষদের নিয়মিত কাজে পরিণত করতে হবে।