আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস
বিকল্প শ্রমবাজার তৈরিতে জোর
বড় শ্রমবাজার মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া। অদক্ষ কর্মীর চাহিদা মেটাতে কম বেতনে চাকরি নিয়ে যান বাংলাদেশি কর্মীরা।
কয়েক বছর ধরে বিদেশে কর্মী পাঠানো ব্যাপক হারে বেড়েছে। যদিও দক্ষ কর্মী পাঠানোর হার সে তুলনায় বাড়েনি। গত অর্থবছরে উল্টো এটি কমেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর জোর দিয়েছে। জাপান ও ইউরোপের মতো দক্ষ শ্রমবাজারে কর্মী পাঠাতে চুক্তি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর সুফল পেতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।
বিদেশে কর্মী পাঠাতে হলে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে প্রত্যেক কর্মীকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশে মোট কর্মী গেছেন ১১ লাখ ৯৮ হাজার ৯০০ জন। এর মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ ছিলেন দক্ষ কর্মী। আর গত অর্থবছরে (২০২৪–২৫) গেছেন ১০ লাখ ১৫ হাজার ৩১২ জন কর্মী। এর মধ্যে দক্ষ কর্মী ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে গত অর্থবছরে পেশাদার কর্মী গেছেন মাত্র ৩ শতাংশ। দক্ষ আর আধা দক্ষ মিলে কর্মী গেছেন ৩৮ শতাংশ। বিদেশে যাওয়া বাকি ৫৯ শতাংশ কর্মী গেছেন স্বল্প দক্ষ হিসেবে।
এ পটভূমিতে আজ ১৮ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। একই সঙ্গে পালিত হচ্ছে জাতীয় প্রবাসী দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘দক্ষতা নিয়ে যাব বিদেশ, রেমিট্যান্স দিয়ে গড়ব স্বদেশ’।
বিএমইটি) থেকে প্রত্যেক কর্মীকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশে মোট কর্মী গেছেন ১১ লাখ ৯৮ হাজার ৯০০ জন। এর মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ ছিলেন দক্ষ কর্মী। আর গত অর্থবছরে (২০২৪–২৫) গেছেন ১০ লাখ ১৫ হাজার ৩১২ জন কর্মী। এর মধ্যে দক্ষ কর্মী ১৮ শতাংশ।
দিবসটি উদ্যাপনে গতকাল ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠান করে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে প্রবাসী কর্মীদের বিমাসুবিধা, চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তা, ক্ষতিপূরণ এবং প্রবাসীর সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তির চেক বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া প্রবাসীদের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) ও বেশি প্রবাসী আয় আনা ব্যাংকগুলোকে সম্মাননা দেওয়া হয়।
বিদেশে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে যুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়াটি চলে মূলত দালাল বা পরিচিতদের মাধ্যমে। তাই ঘুরেফিরে কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমিত আছে কর্মী পাঠানো। মূলত নির্মাণ অবকাঠামো খাতেই যাচ্ছেন কর্মীরা। এ ক্ষেত্রে কোনো দক্ষতা লাগে না, বেতনও কম। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কয়েকটি দেশ ছাড়া শ্রমবাজার তেমন বিস্তৃত হয়নি। দক্ষ কর্মী তৈরির জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোও গড়া হয়নি।
বেসরকারি খাতে কর্মী পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অদক্ষ কর্মীর চাহিদার ভিত্তিতে সীমিত শ্রমবাজারে আটকে আছে কর্মী পাঠানো। নতুন শ্রমবাজার তৈরি করা যায়নি। মধ্যপ্রাচ্যেও দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে হলে দক্ষ কর্মী পাঠাতে হবে।
তিন বছরে আসবে সাফল্য
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, দক্ষতাভিত্তিক কর্মী পাঠাতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশকে প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘জাপান সেল’ গঠন করে পাঁচ বছরে এক লাখ দক্ষ কর্মীকে দেশটিতে পাঠানোর লক্ষ্য নিয়ে ভাষা ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। মৌসুমি কর্মী পাঠাতে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে এবং কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে। সিজনাল ও নন-সিজনাল কর্মী পাঠাতে বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এ ছাড়া উন্নত দেশগুলোতে কর্মী পাঠাতে প্রবাসী কর্মীদের ছাড়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন এবং সেবা দেওয়া পদ্ধতি বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে দ্রুত সময়ে কর্মী পাঠাতে সত্যায়ন প্রক্রিয়া প্রত্যাহার করা হয়েছে। ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় বা স্বতন্ত্রভাবে জাপান, জার্মানি, ইতালিসহ উচ্চ-চাহিদাসম্পন্ন শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি পাঠাতে বিস্তৃত ভাষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু হয়েছে।
দক্ষ কর্মী পাঠাতে হলে যা যা করা দরকার, সেসব তো করতে হবে আগে। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় কারিগরি শিক্ষার পরিধি বাড়াতে পদক্ষেপ তো দেখা যাচ্ছে না।তাসনিম সিদ্দিকী, ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক, রামরু
সরকারের এসব উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাত্র সূচনা করেছি। মাত্র ছয় মাসে জাপানে ৬ হাজারের বেশি কর্মী পাঠানো হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিক নার্সিং সার্টিফিকেশন প্রস্তুতি কোর্স চালু করে ইউরোপে দক্ষ নার্স পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে আগামী তিন বছরের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসবে।’
বিএমইটির তথ্য বলছে, ১৬৮টি দেশে কর্মী পাঠায় বাংলাদেশ। যদিও এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মী গেছেন ১৪১টি দেশে। এসব দেশে কর্মী গেছেন ১০ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫৯ জন। এর মধ্যে ১৩টি দেশে কর্মী গেছেন মাত্র একজন করে। ১০ হাজারের বেশি কর্মী পাঠানো গেছে মাত্র ৮টি দেশে। আর লাখের বেশি কর্মী গেছেন দুটি দেশে। এর মধ্যে কাতার গেছেন এক লাখ কর্মী আর সৌদি আরব গেছেন ৭ লাখের বেশি কর্মী।
বাড়াতে হবে দক্ষ কর্মী তৈরির পরিধি
অতীতে বেশি হারে কর্মী পাঠানো নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। অনেক কর্মী বিদেশে গিয়ে কাজ পান না, অবৈধ হয়ে পড়েন। পুলিশের হাতে আটক হয়েও দেশে ফিরে আসে একটা অংশ। এ ছাড়া অদক্ষ কর্মী পাঠানোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চক্র কাজ করে। তবে সরকার দক্ষ কর্মী তৈরিতে জোর দিয়েছে। বর্তমানে ৪৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) জাপানি, ইংরেজি, চীনা ও কোরীয় ভাষা কোর্স করানো হচ্ছে। বিএমইটি ও সৌদি আরবের কোম্পানি তাকামোল-এর মধ্যে সই করা চুক্তির অধীনে গত এক বছরে ১৫টি টিটিসি দক্ষতা পরীক্ষা পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করেছে। টিটিসিতে কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণের সুযোগ ছিল না। বিদেশে এর চাহিদা বাড়তে থাকায় এটি যুক্ত করা হয়েছে।
বিএমইটির তথ্য বলছে, ১৬৮টি দেশে কর্মী পাঠায় বাংলাদেশ। যদিও এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মী গেছেন ১৪১টি দেশে। এসব দেশে কর্মী গেছেন ১০ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫৯ জন। এর মধ্যে ১৩টি দেশে কর্মী গেছেন মাত্র একজন করে। ১০ হাজারের বেশি কর্মী পাঠানো গেছে মাত্র ৮টি দেশে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ফিলিপাইন অনেক আগে থেকে দক্ষ কর্মী তৈরির উদ্যোগ নিয়ে সফলতা দেখিয়েছে। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান মূলত মধ্যপ্রাচ্যের অদক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যে একজন কর্মী মাসে গড়ে যে বেতন পান, তার চেয়ে তিন–চার গুণ আয় করা যায় জাপান বা ইউরোপের দেশগুলোতে। এর মধ্যেও দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে গত অর্থবছরে। প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে জাপান-ইউরোপের মতো দেশে দক্ষ শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর দিকে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
দক্ষ কর্মী পাঠাতে হলে যা যা করা দরকার, সেসব তো করতে হবে আগে। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় কারিগরি শিক্ষার পরিধি বাড়াতে পদক্ষেপ তো দেখা যাচ্ছে না। টিটিসি থেকে প্রশিক্ষিতদের দক্ষতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। মানোন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের সনদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করা দরকার।রামরুর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী
অভিবাসন খাতের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও দক্ষ কর্মী তৈরি করতে বিভিন্ন কর্মসূচি চালাচ্ছে। কুমিল্লার পাঁচটি উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নে কার্যক্রম পরিচালনা করছে রামরু (রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট)। এ কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য, প্রশিক্ষিত কর্মীরা যাতে বিদেশে গিয়ে আত্মনির্ভরশীলভাবে কাজ করতে পারেন।
রামরুর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষ কর্মী পাঠাতে হলে যা যা করা দরকার, সেসব তো করতে হবে আগে। স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় কারিগরি শিক্ষার পরিধি বাড়াতে পদক্ষেপ তো দেখা যাচ্ছে না। টিটিসি থেকে প্রশিক্ষিতদের দক্ষতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। মানোন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের সনদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করা দরকার।