‘স্কুলের ওয়াশরুম এত নোংরা, আটকে রাখি’

রাজধানীর একটি হোটেলে আজ সোমবার ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ আয়োজিত ‘নগরীর কিশোর-কিশোরী ও মায়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতি সম্মেলনে’ অতিথিরা
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর আবিদা সুলতানা সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে। স্কুলের শৌচাগারের স্মৃতি তাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। নোংরা শৌচাগারে যেতে না পেরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে প্রস্রাব চেপে রাখতে হতো। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছিল সে আজ সোমবার এক অনুষ্ঠানে।
রাজধানীর একটি হোটেলে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ আয়োজিত ‘নগরীর কিশোর–কিশোরী ও মায়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতি সম্মেলনে’ আবিদা বলে, ‘স্কুলে গিয়ে দীর্ঘ সময় থাকতে হয়। স্কুলের ওয়াশরুম এত নোংরা! ফলে অনেকক্ষণ আটকে রাখি আমরা। যেদিন কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিদর্শনে আসতেন, শুধু সেদিন ওয়াশরুম পরিষ্কার রাখা হতো।’ সেই এক দিনের জন্য নয়, প্রতিদিন যেন শিক্ষার্থীরা পরিচ্ছন্ন শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ পায় সে দাবি জানায়।

খাদিজা রহমান নামে আরেক কিশোরী স্যানিটারি প্যাডের দাম কমানোর দাবি জানায়। অনুষ্ঠানে সে বলে, প্যাডের দাম বেশি হওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক মেয়ে এখনো মাসিকের সময় কাপড় ব্যবহার করে।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, ১০ থেকে ১৯ বছরের মেয়েদের স্কুলের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুল ও কোচিং করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা সময় লাগে। কোনো কোনো স্কুলে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ও পানির অভাব, শৌচাগার নোংরা থাকা ও শৌচাগারের সংখ্যা কম থাকায় মেয়েরা শৌচাগার ব্যবহার করে না। দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব–পায়খানা আটকে রেখে তারা কিছু জটিলতায় ভোগে। মাসিককালীন জরুরি সময়ে বিদ্যালয়ে স্যানিটারি প্যাডসহ মাসিক ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থাই থাকে না।  

অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসকারী ১৩০ জনের ওপর সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরিচালিত একটি গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। ‘রিসার্চ ফাইন্ডিংস অন পলিসি অ্যানালাইসিস ফর সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ সার্ভিসেস অ্যান্ড রাইটস অব আরবান পিপল ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশের শহর এলাকার মানুষের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও অধিকারের ওপর গবেষণা ফলাফল) শিরোনামের গবেষণায় বলা হয়, স্কুলে থাকা অবস্থায় হঠাৎ মাসিক শুরু হলে কিশোরীরা মাসিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ভোগে। শহরের নিম্নবিত্ত বাসিন্দারা খরচ কমাতে অসুস্থতার সময়ে স্থানীয় ওষুধের দোকানের (ফার্মেসি) ওপর বেশি নির্ভর করে।

অনুষ্ঠানে আরও বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে ৬ হাজার মানুষের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫০ হাজার মানুষের জন্য এ ধরনের সেবা রয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা খুব জরুরি বিষয়। এই অভ্যাস বাড়িতে ও স্কুলে চর্চা রাখতে হবে। এসব নিয়ে মানুষকে সচেতন হতে হবে। সবকিছু তো সরকার করে দেবে না।

স্টেশন, অফিস, স্কুল, বাসা অনেক জায়গায় শৌচাগার অপরিষ্কার। এতে এডিস মশাও বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টয়লেট পরিষ্কার রাখা আপনাদের দায়িত্ব। ডেঙ্গুতে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, অসংখ্য মৃত্যু হচ্ছে। এসব দেখে ব্যথিত হই। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কিন্তু আমরা আর কী করতে পারি? জনসচেতনতা ছাড়া উপায় নেই।’

সংসদ সদস্য আবদুল আজিজ বলেন, শহরের বস্তি এলাকায় বসবাসকারী ব্যক্তিরা স্থানীয় আরবান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না গিয়ে বড় সরকারি হাসপাতালে চলে যান। কারণ, বড় হাসপাতালে পৌঁছানো তাদের জন্য সহজ। তিনি বলেন, মাসিকের সময় একটি প্যাড দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করলে সংক্রমণ হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত বিনা মূল্যে স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, জনস্বাস্থ্য ঘরের দুয়ারে এসেও লোকজনের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। মাসিকের সময় স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা নিতে না পারলে জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে।

জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার মধ্যে কাজের সমন্বয় প্রয়োজন। নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে অধ্যায় রয়েছে। সেটা শিক্ষকেরা পড়াতে অস্বস্তিবোধ করেন। শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পড়ে নিতে বলেন। শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ পরিচালক (অপারেশসনস) চন্দন জেড গমেজ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা, ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শফিকুর রহমান প্রমুখ।

অনুষ্ঠানের মিডিয়া অংশীদার ছিল একাত্তর টেলিভিশন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন একাত্তর টিভির প্রধান পরিকল্পনা সম্পাদক নূর সাফা জুলহাস।