ভিন্নমতকে অপরাধ বলায় জাতিসংঘের আপত্তি

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর আইন সংশোধনের যেসব সুপারিশ করেছে, সে বিষয়ে মুখপাত্র।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনপ্রতীকী ছবি

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে যে সুপারিশমালা পেশ করেছে, তা মূলত তিনটি বিষয়ে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানের জবাবে ওএইচসিএইচআর যে তিনটি মূল ইস্যুর কথা উল্লেখ করেছে, সেগুলো হলো ভিন্নমত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, কথিত অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষমতার পরিধির ব্যাপকতা এবং জামিন ছাড়া দীর্ঘ সময়ের বন্দিত্ব।

গত বছরের আগস্ট মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় জানিয়েছিলেন যে তাঁর দপ্তরের মানবাধিকার আইনবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে একটি সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেছেন।

সুপারিশ যা চূড়ান্ত হবে, তা আইনের বিধিতে যদি যুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে সেভাবে করা হবে। তবে আইন সংশোধনের প্রয়োজন হলে তা-ও করা হবে। আমরা সব পথ খোলা রেখেছি।
আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের সহায়তা চেয়ে সুপারিশ পাওয়ার পর প্রায় ছয় মাসেও তা বাস্তবায়নে সরকার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি। যদিও একাধিকবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে আইন সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছিলেন।

সরকার বা ওএইচসিএইচআরের কোনো তরফেই এ সুপারিশমালায় কী আছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। আইন সংশোধনের আশ্বাস পূরণ হবে কি না এবং জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের সুপারিশগুলো প্রকাশ করা হবে কি না, তা জানতে চেয়ে গত বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রীকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

পরে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গত রাতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সুপারিশমালাকে খসড়া অভিহিত করে বলেছেন, এটি চূড়ান্ত হয়নি। সেই সুপারিশ নিয়ে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। খসড়া সুপারিশের ব্যাপারে আলোচনার জন্য একটি তারিখ চেয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরে চিঠি পাঠানোর বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখনো আলোচনার সময় তারা দেয়নি।’

আরও পড়ুন

একই সঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সুপারিশ যা চূড়ান্ত হবে, তা আইনের বিধিতে যদি যুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে সেভাবে করা হবে। তবে আইন সংশোধনের প্রয়োজন হলে তা-ও করা হবে। আমরা সব পথ খোলা রেখেছি।’

আইনমন্ত্রীর দাবি, সরকার ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। সে কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার এবং হয়রানি বন্ধ হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
প্রতীকী ছবি
আরও পড়ুন

সুপারিশমালায় কী আছে, তা জানার জন্য হাইকমিশনারের দপ্তরে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কয়েক দফা যোগাযোগ ও অপেক্ষার পর গত বুধবার হাইকমিশনারের মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স ই-মেইলে জানান, তিনটি মূল বিষয়ে টেকনিক্যাল পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে একটা সামগ্রিক ধারণার বাইরে এ পর্যায়ে নির্দিষ্টভাবে বিস্তারিত জানাতে তাঁরা অপারগ।

যে তিনটি বিষয়ের কথা ওএইচসিএইচআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তার একটি হলো ভিন্নমত প্রকাশের বৈধ মাধ্যমগুলোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সংজ্ঞায়ন এবং তার জন্য কঠোর সাজার বিধান। উদাহরণ হিসেবে বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারার কথা উল্লেখ করা হয়, যাতে ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন তথ্য প্রকাশের জন্য যে কেউ অপরাধী গণ্য হবে।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ‘ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার, ইত্যাদি’ উপশিরোনামে ২৮ নম্বর ধারায় তিনটি উপধারা আছে। এগুলো হচ্ছে:

১.

যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

২.

যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

৩.

যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সুপারিশে পুলিশ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ, ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সিকে (ডিএসএ) যে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার পরিধি নিয়েও মতামত দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে হাইকমিশনারের দপ্তরের মুখপাত্র জানান, আইনের ৮ নম্বর ধারায় ‘ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে, বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে’—এমন পরিধি খুবই বিস্তৃত।

বিদ্যমান আইনে ‘কতিপয় তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার ক্ষমতা’ উপশিরোনামে ৮ নম্বর ধারার প্রথম দুটি উপধারায় এই পরিধি নির্ধারণ করা আছে। এতে বলা আছে:

‘১.

মহাপরিচালকের নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করিলে তিনি উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা, ক্ষেত্রমত, ব্লক করিবার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে, অতঃপর বিটিআরসি বলিয়া উল্লিখিত, অনুরোধ করিতে পারিবেন।

২.

যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে, বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহা হইলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার জন্য, মহাপরিচালকের মাধ্যমে, বিটিআরসিকে অনুরোধ করিতে পারিবে।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের তৃতীয় ক্ষেত্রটি হচ্ছে জামিন-অযোগ্য ধারাগুলো এবং বিচারপূর্ব বন্দিত্ব। মুখপত্রের কথায়, ‘যেসব অপরাধ অজামিনযোগ্য, সেগুলোর মানে হচ্ছে বিচারের আগেই দীর্ঘ বন্দিত্ব।’

‘অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতা’ উপশিরোনামের ৫৩ ধারায় মোট ১৪টি ধারা অজামিনযোগ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করা আছে। এগুলো হচ্ছে: ধারা ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪। আইনটি জারির পর থেকে এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলাই হয়েছে অজামিনযোগ্য ধারায়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত চার বছরে মোট কতগুলো মামলা হয়েছে, কতজন অভিযুক্ত হয়েছেন, কতজন বন্দী আছেন ও কতজন দণ্ডিত বা খালাস হয়েছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশ করা এক হিসাবে ১ হাজার ৭০০–এর বেশি মামলার কথা জানানো হয়। তবে তাতে অভিযুক্তের সংখ্যা ছিল না।

গত বছর দেশে ও বিদেশে তীব্র সমালোচনার মুখে আইন সংশোধন ছাড়াই আইনমন্ত্রীর পরামর্শ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এই ধারার প্রয়োগে ব্যতিক্রম আনা হয়। ফলে কার্যত আইনটি আংশিকভাবে মন্ত্রীদের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রীদের অনেকে এবং ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা বিভিন্ন ফোরামে এই আইনের আবশ্যকতার পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। আইনটির কথিত যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার সমন্বিত প্রচারের কারণে এটি সংশোধনের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।