তিন কলেজের ছয় ছাত্রাবাস বন্ধ বছরের পর বছর

সরকারি কমার্স কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৬ হাজার ৩০৭। ছাত্রাবাসের আসনসংখ্যা প্রায় এক হাজার। 

চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের ছাত্রাবাসে জরাজীর্ণ অবস্থা। সম্প্রতি নগরের আগ্রাবাদে
ছবি: সৌরভ দাশ

জরাজীর্ণ ভবন। ভেঙে পড়েছে দেয়াল। কক্ষের ভেতর ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। পলেস্তারা খসে পড়ছে। ৩৪ বছর ধরে কোনো শিক্ষার্থীর পা পড়েনি চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের শহীদ আব্দুল হামিদ ছাত্রাবাসে। এ কারণে ছাত্রাবাসটিতে গিয়ে এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হবে যে কেউ।

৩৪ বছর আগে বন্ধ হওয়া ছাত্রাবাসটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত। অবশ্য শুধু কমার্স কলেজের এই ছাত্রাবাস নয়, ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা দখল করে নিতে পারেন এবং সংঘাত তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কায় নগরের সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজের পাঁচটি ছাত্রাবাস ও দুটি ছাত্রীনিবাস সাত বছর ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এ কারণে বেশির ভাগ ভবন প্রায় পরিত্যক্ত। চৌকি, চেয়ার, টেবিল, পানির কল, শৌচাগার—সব নষ্ট হয়ে গেছে অযত্নে। তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে এগুলো।

জানা গেছে, সরকারি এই তিন কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৬ হাজার ৩০৭। তিনটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। তিন কলেজের ছয়টি ছাত্রাবাস ও দুটি ছাত্রীনিবাসে আসন রয়েছে এক হাজার। এসব ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করে শহরের বিভিন্ন মেসে থাকতে হচ্ছে।

কিন্তু এসব ছাত্রাবাস কিংবা ছাত্রীনিবাস খুলে দিতে কর্তৃপক্ষ কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ব্যবহারের অযোগ্য হওয়া ছাত্রাবাসের জায়গায় নতুন ভবন তৈরির জন্য চিঠি দেওয়া হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।

সংস্কারযোগ্য ছাত্রাবাসগুলোর বিষয়ে শিগগিরই উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা আপাতত নেই। তবে প্রকৌশলীদের পরামর্শ নিয়ে ছাত্রাবাসগুলো সংস্কার করা যেতে পারে। সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বন্ধ ছাত্রাবাস, বাড়তি খরচ

১৯৬২-৬৩ সালের দিকে নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থিত সরকারি কমার্স কলেজের দক্ষিণ পাশে চারতলার ছাত্রাবাসটি তৈরি করা হয়। ১০০ শিক্ষার্থী এই ছাত্রাবাসে থাকতে পারতেন। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর ছিল এই ছাত্রাবাস। ওই সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় মারা যান তিন ছাত্র। এরপর ১৯৮৯ সালের মে মাসে শহীদ আব্দুল হামিদ ছাত্রাবাসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে বন্ধ হয়ে যায় ১০০ আসনবিশিষ্ট ছাত্রীদের হোস্টেলটিও।

কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ জুবায়েরের বাড়ি রাউজান উপজেলায়। তিনি থাকেন নগরের আগ্রাবাদের একটি মেসে। খাওয়া–থাকা মিলিয়ে তাঁর খরচ হয় ৮–১০ হাজার টাকা। জুবায়ের ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ছাত্রাবাস থাকলে খরচ অনেকটা কমে যেত। থাকার খরচ লাগত না। আবার খাওয়ার খরচও অনেক কমে যেত। চার–পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে মাস চলা যেত। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই। আরেক শিক্ষার্থী আবদুল হালিমকে খরচ চালাতে বাড়তি দুটো টিউশনি করতে হচ্ছে। হালিম বলেন, বাবার পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব হয় না। এ কারণে টিউশনি করে খরচ জোগাড় করেন।

সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ সুসেন কুমার বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস এখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। মেরামত বা সংস্কার করেও কোনো লাভ হবে না। এ কারণে ছাত্রাবাসটি ভেঙে সেই জায়গায় ২০০ আসনের নতুন একটি ভবন তৈরির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। একইভাবে আরেকটি ছাত্রীনিবাস তৈরির জন্য বলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরের অন্য দুটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের পাঁচটি ছাত্রাবাস ও একটি ছাত্রীনিবাস বন্ধ করে দেওয়া হয় ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ওই বছর বিজয় দিবসে চট্টগ্রাম কলেজের শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। এই ঘটনার জেরে ওই দিনই চট্টগ্রাম কলেজের শেরেবাংলা ছাত্রাবাস, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাস, ড. আবদুস সবুর চৌধুরী ছাত্রাবাস ও হজরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.) ছাত্রীনিবাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তিন ছাত্রাবাসে আসন রয়েছে ৫১৬টি ও ছাত্রীনিবাস আছে ১০৮টি।

একই দিনে বন্ধ করে দেওয়া হয় সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের দুটি ছাত্রাবাস। নগরের চকবাজার এলাকায় চট্টগ্রাম কলেজের বিপরীত পাশে মহসিন কলেজের অবস্থান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মহসিন মুসলিম ছাত্রাবাস ও নতুন ছাত্রাবাস নামের দুটি ছাত্রাবাসে ৮০টি করে মোট ১৬০টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে মহসিন মুসলিম ছাত্রাবাসটি নির্মিত হয় ১৯৭০ সালে। এটির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। অন্য ছাত্রাবাসটি নির্মিত হয় ২০০৩ সালে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব কলেজের ছাত্রাবাসগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। ভবনগুলো জরাজীর্ণ। কক্ষের ভেতর ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা। দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংস্কার করা হয়নি। এমনকি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের কাজও হয়নি। অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। কমার্স কলেজের ছাত্রাবাসটির কয়েকটি কক্ষে পরিবার নিয়ে থাকছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ১০–১২ জন কর্মচারী।

সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের আবাসনসংকটের বিষয়টি স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের নির্দেশনায় ছাত্রাবাসগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। আপাতত এসব ছাত্রাবাস খোলার কোনো চিন্তাভাবনা নেই। আর সংস্কার না করে ছাত্রাবাসগুলো চালু করা সম্ভব হবে না। ফলে ছাত্রাবাস সংস্কারের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাঁরা যোগাযোগ করবেন।

এসব কলেজের ১০ শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা দখলে নিতে পারেন, এমন আশঙ্কায় হলগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ কলেজ ক্যাম্পাসে শিবিরের কার্যক্রম এখন অনেকটা গুটিয়ে গেছে। ফলে ব্যবহার অনুপযোগী ছাত্রাবাসগুলো ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করা উচিত, অথবা সংস্কার করে শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া যায়। তবে ছাত্রাবাসগুলোতে পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।