৫০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ খুন

এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা হিসেবে মনে করা হয় সাত খুনকে। একই ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ছিল সেই খুন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এর নেপথ্যে। নিজেকে আড়াল করতে পরদিন খুনের বিচার চেয়ে মিছিলও করেছিলেন তিনি। ৫০ বছর আগে এই এপ্রিল মাসেই ঘটেছিল সেই খুনের ঘটনা। সেদিনের সেই ঘটনার বিবরণই আজকের এই ফিরে দেখা

৫০ বছর আগের কাহিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বড় খুনের ঘটনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া আর কখনো ঘটেনি। নৃশংসতা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, ঘটনায় সারা বাংলাদেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঘটনাটি সেভেন মার্ডার বা সাত খুন নামে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগে সৃষ্টি হয় গভীর ক্ষত।
৪ এপ্রিল, ১৯৭৪ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশাপাশি দুটি হল—মাস্টারদা সূর্য সেন হল ও হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল। আজও যেমন আছে, ৫০ বছর আগেও মোটামুটি তেমনই ছিল। গভীর রাতে সূর্য সেন হলের সাত ছাত্রকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মুহসীন হলে। টিভি রুমের সামনে সাতজনকেই গুলি করে খুন করা হয়। যাঁরা খুনে অংশ নিয়েছিলেন, প্রত্যেকে ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মী। যাঁরা খুন হয়েছিলেন, তাঁরাও প্রত্যেকে ছিলেন ওই সংগঠনের কর্মী বা অনুসারী।

সময়টি ছিল অস্থির। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী ছাত্রদের কাছে ছিল অস্ত্র। আগের বছর, অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে হয়েছে। ক্যাম্পাসের বাইরে ঢাকা শহর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই নিয়মিত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে চলেছে। সাত খুনের ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে ছিলেন। তিনি গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। অন্যদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালও সঙ্গে ছিলেন।

সাত খুনের ঘটনায় বিচার হয়েছিল। বিচার শুরু হয়েছিল পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের আগেই। দোষী ব্যক্তিদের ২২ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে সাজা কমিয়ে ১০ বছর করা হয় এবং কিছুদিনের মধ্যে সবাইকে সাধারণ ক্ষমা দেখিয়ে মুক্ত করে দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে কেউ কেউ জিয়াউর রহমানের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, কেউ তৈরি করেন নতুন রাজনৈতিক দল।

মাস্টারদা সূর্য সেন হল
ছবি–লেখক

কী ঘটেছিল সেদিন

সেদিনের আবহাওয়াও ছিল কিছুটা গরম। রাত ১২টার পরে ২০ থেকে ২৫ জন অস্ত্রধারী সূর্য সেন হলে ঢুকে মূল ফটক বন্ধ করে দেন। তাঁরা প্রথমে ছয়তলার ৬৩৪ নম্বর কক্ষের সামনে দিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে কোহিনুর নামের একজন ছাত্রকে ডাকেন। কক্ষের ভেতর থেকে বলা হয়, কোহিনুর পাশের কক্ষে।

এরপর ৬৩৫ নম্বর কক্ষে টোকা দিলে দরজা খুলে দেন মোহাম্মদ নাজমুল হক কোহিনুর। কোহিনুরসহ চারজনকে অস্ত্রের মুখে বের করে বারান্দার শেষ প্রান্তে আনা হয়। শেষ কক্ষটি ৬৪৮। সেই কক্ষ থেকে আরও চারজনকে বের করা হয়। পুরো বহর সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে।

তিনতলায় আসার পর অস্ত্রধারীরা একটি কক্ষে অন্য একজনকে খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। তখন আটজনের একজন আচমকা লাফিয়ে ক্যানটিনের ছাদের ওপর পড়েন এবং সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাঁর নাম আবদুল্লা আল আবিদ।
সূর্য সেন হলের গেট খুলে অস্ত্রধারীরা মুহসীন হলের দিকে রওনা দেন। আসার সময় সূর্য সেন হলের গেট তাঁরা বন্ধ করে দেন।

সাতজনকে নিয়ে অস্ত্রধারীরা মুহসীন হলে আসেন। হলে ঢুকে গেটে তালা লাগিয়ে দেন। সাতজনকে দাঁড় করানো হয় টেলিভিশন রুমের সামনে। তখন রাত একটা। তখনকার সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, রাত ১টা ১১ মিনিটে তাঁদের ওপর ব্রাশফায়ার করা হয়।

এস এম বাহালুল মজনুন (চুন্নু) তখন মুহসীন হলের ছাত্র, বিভাগ সমাজবিজ্ঞান। তিনি তখন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগেরও সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ৭ জনকে খুন করা হয় রাত ১টা ৪ মিনিট থেকে ১টা ২০ মিনিটের মধ্যে। আমি তখন মুহসীন হলের চারতলার ৪৪৫ নম্বর রুমে ছিলাম। গুলির শব্দ শুনেছি। কথা শুনেছি।’

পরদিনের পত্রিকা
সৌজন্যে: সংগ্রামের নোটবুক

৭ জনের পরিচয়

যে সাতজন খুন হন, তাঁদের পরিচয় ৬ এপ্রিলের সংবাদপত্রে ছাপা হয়। একজন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের।

১) বসির উদ্দীন আহমেদ, পিতা মৃত মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন ভূঁইয়া, ২৯ ডিস্টিলারি রোড, ঢাকা। প্রথম বর্ষ এমকম;

২) সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ (বাব্বন), পিতা সৈয়দ নাসির উদ্দীন মাহমুদ, ৩৪ ঠাকুরদাস লেন, বানিয়ানগর, ঢাকা। বিএ অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ;

৩) আবুল হোসেন, পিতা আবদুস সামাদ অ্যাডভোকেট, পাইকপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা। বিএ অনার্স প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ;

৪) এম এ ইদ্রিস, পিতা মৃত মোহাম্মদ সিদ্দিক, ১১৫ চক মোগলটুলী, ঢাকা। এমকম প্রথম বর্ষ, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ;

৫) মোহাম্মদ নামজুল হক (কোহিনুর), পিতা নুরুদ্দীন আহমদ, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ। এমএ ফাইনাল পার্ট, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ;

৬) সৈয়দ রিজওয়ানুর রব (সোহেল), পিতা ফজলে রব, ৩৯/২ পাঁচ বাই ষাট লেন, নারিন্দা, ঢাকা। বিএ অনার্স প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ; এবং

৭) এবাদ খান, পিতা ইব্রাহিম খান, পাইকপাড়া, ধামরাই, ঢাকা। বিএ অনার্স, প্রথম বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ।

কে কী দেখেছেন, শুনেছেন

এস এম বাহালুল মজনুন বঙ্গবন্ধু সমাজকল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। একসময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ঘটনার দুই দিন আগে চন্দ্রায় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের পিকনিকে গিয়েছিলেন এস এম বাহালুল মজনুন। ঘটনার দিন জ্বর ছিল। থাকতেন ৪৪৫ নম্বর কক্ষে। ওই দিন সন্ধ্যার পর তিনি নিচে নামেননি। তবে কী কী ঘটেছিল, তা দেখেছেন।

এস এম বাহালুল মজনুন
ফেসবুক থেকে নেওয়া

অস্ত্রধারীদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন তখনকার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান। আর ছিলেন মুহসীন হলের ছাত্রলীগের হল শাখা কমিটির ২০ জনের বেশি নেতা-সদস্য। ৫ এপ্রিল ভোরবেলা আওয়ামী লীগের দুজন নেতা মুহসীন হলে এসেছিলেন এবং মৃতদেহগুলো ঢাকা মেডিকেলে পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে যান।

এস এম বাহালুল মজনুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলি দুই দফায় হয়েছিল। প্রথমে প্রত্যেকের মাথায় গুলি করা হয়। তারপর ব্রাশফায়ার করা হয়।’ গুলি শুরুর আগে কোহিনুরের গলা শোনা যায়, তিনি বারবার করে শফিউল আলম প্রধানকে বলছিলেন মাফ করে দিতে। তখন শফিউল আলম প্রধানের হাতে ছিল জ্বলন্ত সিগারেট।

সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন তিনি জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন। অজয় দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ৫ এপ্রিল খুব ভোরে মুহসীন হলের তাঁর দলের একজন ছাত্রনেতা জগন্নাথ হলে আসেন এবং সাতজন ছাত্রের খুনের কথা জানান। তিনি অজয় দাশগুপ্তকে বলেন, তিনি ঘটনার সময় শফিউল হক প্রধানকে দেখেছেন।

তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন মনিরুল হক চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব তখন শেষ, থাকতেন মালিবাগে বাসা ভাড়া করে। একসময় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। এখন কুমিল্লার বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়।

মনিরুল হক চৌধুরী

মনিরুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার দিকে বাসায় টেলিফোন আসে। আমাকে জানানো হয়, সাতজনকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। আমি ঢাকা মেডিকেলে যাই। সেখানে অন্যান্য নেতার সঙ্গে আবদুল কুদ্দুস মাখনের দেখা পাই। মাখন ভাইয়ের মুখে শুনতে পাই সাতজন মারা গেছে। এদের মধ্যে কোহিনুর (মোহাম্মদ নাজমুল হক) মাখন ভাইয়ের কাছের ছিল।’

মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, ওই দিন পোস্টমর্টেম শেষ করে ছাত্রদের মৃতদেহ যাঁর যাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

প্রেসনোট, বিবৃতি, প্রতিক্রিয়া

ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রেসনোট দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, ‘আজ ভোরের দিকে একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলে প্রবেশ করিয়া জোরপূর্বক ৭ জন ছাত্রকে মহসিন হল এলাকায় লইয়া গুলী করিয়া হত্যা করার সংবাদে সরকার গভীরভাবে মর্মাহত হইয়াছে। এই বর্বরোচিত কার্যের সংবাদ পাইয়া পুলিশ অবিলম্বে মহসিন হলে গমন করে এবং ছাত্রদের লাশগুলি উদ্ধার করে। তাহারা সমগ্র এলাকাটি ঘিরিয়া ফেলে এবং অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধের জন্য প্রহরার ব্যবস্থা করে।’

ওই প্রেসনোটে বলা হয়, সরকার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সরকার ঘটনার তদন্তে নির্দেশ দিয়েছে এবং অপরাধীদের ধরার জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরী সংবাদপত্রে পাঠানো বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বিবৃতি দিয়ে ঘটনার নিন্দা জানান। ডাকসুর সহসভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছাত্র হত্যার তীব্র নিন্দা জানান।

এস এম বাহালুল মজনুন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে। মিছিল আর্টস ফ্যাকাল্টির ভেতরে প্রবেশ করলে মিছিলে গ্রেনেড ছোড়া হয়। এতে একজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। এর তিন দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

শফিউল আলম প্রধানের মুক্তির দাবীতে ছয় ছাত্রলীগ কর্মীর অনশন
ছবি–পত্রিকা থেকে নেওয়া

কেন এই হত্যাকাণ্ড

তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী তাঁর বাসায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঘটনার একটি নির্মোহ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘এটা ছিল ইনসিডেন্ট’।

মনিরুল হক চৌধুরী বারবার বলেছেন, এটা কোনো পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল না। তখন ছাত্রলীগের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। সুতরাং এই হত্যাকাণ্ড অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কোনো বহিঃপ্রকাশ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তাহলে কেন এতগুলো প্রাণ গেল? মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, ছাত্রদের একজনের বান্ধবী বা দুটো গ্রুপের কোনো এক গ্রুপের সদস্যের গার্লফ্রেন্ডকে টিজ করার ঘটনা ঘটেছিল। সেখানেই ঘটনার বীজ।

এস এম বাহালুল মজনুন বলেন, ৪ এপ্রিল মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্র নিগৃহীত হন ওই সাতজনের কারও দ্বারা। এর বিচার চান তিনি। শফিউল আলম প্রধান রাত ১০টায় মুহসীন হলে এসে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের জড়ো করেন এবং প্রস্তুত হয়ে আসতে বলেন। এরও আগে কোহিনুরদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ ছিল।
এস এম বাহালুল মজনুন বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে হয়তো একটু বেশি বা কম পছন্দ করতেন। সেটা সব সময় হয়। এখনো তা আছে। তাই বলে বলা যাবে না যে ছাত্রলীগের মধ্যে দুটো ধারা ছিল।
তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদের অনুসারীরা ছাত্রলীগের মধ্যে দুটি ধারা তৈরি করেছিলেন। যাঁরা খুন হয়েছিলেন, তাঁরা একটি ধারার। যাঁরা খুন করেছিলেন, তাঁরা বিপরীত ধারার। তবে এই দুই ধারা কখনো প্রকাশ্য হয়নি।

শফিউল আলম প্রধান গ্রেপ্তার

মনিরুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, একদিন সাদাপোশাকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানকে একটি গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যান।

পুলিশ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, মুহসীন হলে সাত ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় ৮ এপ্রিল তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন শফিউল আলম প্রধান, কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল ও মাহমুদুর রহমান ওরফে বাচ্চু।

শফিউল আলম প্রধান

দলের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী বিবৃতি হয়ে শফিউল আলম প্রধানের মুক্তি দাবি করেন। স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগমন্ত্রী এম মনসুর আলী বার্তা সংস্থা বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শফিউল আলম প্রধানকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিক্ষোভের কোনো অবকাশ নেই।

শফিউল আলম প্রধানের মুক্তির দাবিতে ছাত্রলীগের পাঁচজন নেতা ও একজন নেত্রী আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে অনশন শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং তিন দিনের মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হল ছাড়তে বলা হয়।

বিচার ও মুক্তি

হত্যার ঘটনার বিচার শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগেই। মুহসীন হলে ছাত্রলীগের কমিটিতে ৩৭ জন ছিলেন। তাঁদের ২২ জন এই মামলার আসামি ছিলেন। একজন আসামির নাম ছিল ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী। তিনিসহ চার থেকে পাঁচজন দেশ থেকে পালিয়ে যান।

বিচারে খুনিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এর মধ্যে ঘটে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথমে সাজার মেয়াদ কমিয়ে ১০ বছর করেন। এর কিছুদিনের মধ্যে সবাইকে সাধারণ ক্ষমা দেখিয়ে কারাগার থেকে ছেড়ে দেন।
মুক্ত শফিউল আলম প্রধান মূলত বিএনপির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে রাজনীতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। ১৯৮০ সালে গড়ে তোলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি বা জাগপা নামে নতুন রাজনৈতিক দল। মৃত্যুর আগপর্যন্ত আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি করে গেছেন। তিনি ২০১৭ সালে মারা যান।

একদিন ৬৩৫ ও ৬৪৮ নম্বর কক্ষে

ঘটনার ৫০ বছর পরে ওই কক্ষগুলোয় কারা থাকছেন। তাঁরা কি জানেন কী ঘটেছিল। অথবা মুহসীন হলের টেলিভিশন রুমের সামনের কাহিনি কি কারও মনে পড়ে?
২ এপ্রিল এই প্রতিবেদক প্রথমে যান সূর্য সেন হলের ৬৩৫ নম্বর কক্ষে। ছোট একটি কক্ষ। চারজনের পৃথক পৃথক খাট পাতার কারণে আর কোনো অবশিষ্ট জায়গা নেই। থাকেন চারজন। ওই সময় উপস্থিত ছিলেন রাকিবুল হাসান। লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্র। বাড়ি নরসিংদী।

সেই ৬৩৫ নম্বর কক্ষ
ছবি: লেখক

রাকিবুল হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর এলাকার একজন বড় ভাই জানতে চেয়েছিলেন কোন হলে রাকিবুল উঠেছেন। উত্তর সূর্য সেন হল শোনার পর ওই বড় ভাই বলেছিলেন, ওই হলের সাতজনকে হত্যা করা হয়েছিল। রাকিবুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জানতাম না ঘটনা আমার নিজের রুমের।’
একটি একটি কক্ষ পেরিয়ে এই প্রতিবেদক যান ৬৪৮ নম্বর কক্ষে। চোখে চশমা, ঝকঝকে চেহারার এক শিক্ষার্থী বের হলেন। তিনি কোনো দিন সেভেন মার্ডার বা সাত খুন সম্পর্কে কিছু শোনেননি। প্রতিবেদকের প্রশ্নে তিনি বিস্মিত হন।

সূর্য সেন হল থেকে এই প্রতিবেদক যান মুহসীন হলে, ঠিক যেখানে সাতটি লাশ পড়ে ছিল। দেখা গেল টেলিভিশন কক্ষের সামনের বারান্দার কোণে নিবিষ্ট চিত্তে কাজ করছেন একজন চর্মকার। তিনি কোনো দিন এ কাহিনি শোনেননি যে ওই স্থানেই রক্তপাত হয়েছিল।

স্থানটি দেখিয়ে, ঘটনা বুঝিয়ে বললেন একজন বেয়ারা। তিনি নিজ চোখে লাশগুলো দেখেননি। তবে তাঁর বাবা তখন এই হলে কাজ করতেন। বাবার কাছে গল্প শুনেছেন।
১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করতেন সাখাওয়াত আলী খান। তিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক অধ্যাপক। একটি বড় ঘটনার সংবাদ তৈরির সময় ইন্ট্রো বা সূচনা কীভাবে লিখতে হয়, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের তা শেখানোর জন্য বহু বছর তিনি এই সাত খুনের ঘটনা উল্লেখ করতেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুহসীন হলের টিভি রুমের সামনে সাতটি লাশ। দুই-আড়াই ইঞ্চি পুরু জমাট বাঁধা রক্ত মানুষ দেখেছে।’

মুহসীন হলের টিভি রুমের সামনের বারান্দা, এখানে পড়ে ছিল সাতটি লাশ
ছবি–লেখক

(ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল গভীর রাতে ও ৫ এপ্রিলের প্রথম প্রহরের দিকে। ঘটনাটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল ৬ এপ্রিল। আজ সেই ৬ এপ্রিল।)