বিদেশফেরত নারী শ্রমিকদের মূলধারায় ফেরার প্রতিটি ধাপে জেন্ডার–সংবেদনশীলতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। নারীর চাহিদা ও দক্ষতা যাচাই–বাছাই করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।
‘অভিবাসী নারীর জেন্ডার-সংবেদনশীল টেকসই পুনঃ অন্তর্ভুক্তি’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এ কথা বলেন। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ইউএন উইমেন ও প্রথম আলো এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
বৈঠকের আলোচনায় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের যুগ্ম পরিচালক (অর্থ ও বাজেট এবং কল্যাণ) এ টি এম মাহবুব-উল করিম প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বাস্তবায়িত রিকভারি অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অব ইনফরমাল সেক্টর এমপ্লয়মেন্ট বা রেইজ প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, প্রকল্পটি বিদেশফেরত কর্মীদের পুনর্বাসন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানে কাজ করছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ প্রকল্পের আওতায় বিদেশফেরত ২ লাখ ৫৩ হাজার কর্মীকে নিবন্ধন, কাউন্সেলিং এবং প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এই কর্মীদের মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ৭ শতাংশ।
মাহবুব-উল করিম রেইজ প্রকল্পের অভিজ্ঞতায় বলেন, বিদেশফেরত কর্মীদের চাহিদা, যোগ্যতা, দক্ষতার পাশাপাশি বাজার যাচাই–বাছাই করে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশফেরত প্রত্যেক ব্যক্তিকেই আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে পুনর্বাসনের বিষয়টিতে তিনি গুরুত্ব দেন।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রসঙ্গে মাহবুব-উল করিম বলেন, ২০২০ সালে ৪ লাখের বেশি কর্মী বিদেশ থেকে ফেরত এসেছিলেন। এরপর ২০২৫ সাল পর্যন্ত আরও শ্রমিক ফিরেছেন। প্রকল্পের আওতায় ফেরত আসা সবাইকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি।
আলোচনায় বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, নারী শ্রমিকেরা বিদেশ গেলে আয়ের প্রায় পুরো টাকাটাই দেশে পাঠান। নারী শ্রমিকদের বিদেশে যেতেও টাকা লাগছে না। তবে এই তথ্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়নি।
গোলটেবিল বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে ইউএন উইমেনের ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ নবনীতা সিনহা বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভিবাসী নারী শ্রমিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে তাই না, নারীর জেন্ডার ভূমিকা পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখছে। জেন্ডার ও তথ্যভিত্তিকভাবে নারীর এসব অবদানকে তুলে ধরার বিষয়টিতে তিনি গুরুত্ব দেন।
আলোচনায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাহনুমা সালাম খান বলেন, নারী শ্রমিক যখন দেশে ফেরেন, বিমানবন্দর থেকেই পুনর্বাসনের ধাপ শুরু হয়ে যায়। কাউন্সেলিং, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থানসহ প্রতিটি ধাপেই নারীদের বিশেষ চাহিদার কথা মাথায় রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে, একে যন্ত্রণা হিসেবে মনে করলে হবে না। পদক্ষেপগুলো যাতে টেকসই হয়, তা দেখতে হবে। কাজগুলো একক কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন এনজিও ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে।
অভিবাসী নারীর পুনঃ অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ইউএন উইমেনের প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট মো. ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, অভিবাসন শুরুর প্রথম দিন থেকেই দেশে ফেরত আসার পর পুনর্বাসনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে জর্ডান ও সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা নারী শ্রমিক শাহনাজ বেগম, সাথী আক্তার ও আসমা বেগম আলোচনায় অংশ নেন। তিনজনই বিদেশ থেকে ফেরত আসার পর সমাজে নানান নেতিবাচক কথা শুনেছেন বলে জানান। তিনজনই দালালকে টাকা দিয়েছিলেন বিদেশ যাওয়ার জন্য। সন্তানের চিকিৎসাসহ নানান কাজে টাকা ব্যয় করেছেন তাঁরা। আসমা বেগম জানান, রাজধানীতে তিনি চায়ের দোকান চালাচ্ছেন।
বিদেশফেরত নারী শ্রমিকের বিষয়ে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, নারী শ্রমিক কোন পরিপ্রেক্ষিতে বা কোন অবস্থায় বিদেশ থেকে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন, সেই অনুযায়ী সরকারকে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশে ভালো ভালো অনেক আইন ও নীতি আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে।
শরিফুল হাসান বিদেশে প্রত্যেক নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। বিদেশে যাওয়ার পর সব শ্রমিকের হাতে মুঠোফোন থাকা নিশ্চিত করা, দূতাবাস থেকে ফোন করে নারী শ্রমিকদের খোঁজ রাখা, দেশে ফেরত আসার পর বিমানবন্দরে কোন সংস্থার কী দায়িত্ব, তার গাইডলাইন তৈরি করার সুপারিশ করেন। একইভাবে নারী শ্রমিকেরা হংকং, জর্ডানসহ বিভিন্ন দেশে পোশাকশিল্প, কেয়ারগিভারসহ বিভিন্ন কাজে যাতে যেতে পারেন, সে ধরনের উদ্যোগ বাড়ানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
আলোচনায় অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মেরিনা সুলতানা বলেন, সরকারের ‘প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের জন্য পুনরেকত্রীকরণ নীতিমালা ২০২৪’–এ জেন্ডারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিদেশফেরত নারী শ্রমিকদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সহায়তা করার পাশাপাশি ফেরত আসা এই নারীদের প্রতি যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, তা পরিবর্তনেও সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
বিদেশফেরত কর্মীদের সংগঠন ওয়ারবির চেয়ারপারসন সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, সরকার দেরিতে হলেও বিদেশফেরত কর্মীদের পুনর্বাসনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। তিনি তাঁর সংগঠনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিদেশফেরত নারীরা বিভিন্ন সমিতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, বিদেশফেরত নারী শ্রমিককে একটি সেলাই মেশিন বা দোকান দিয়ে বসিয়ে দিলেই হবে না, ব্যক্তি ধরে ধরে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। শক্তিশালী ‘রেফারাল মেকানিজম’ থাকার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেন তিনি।
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান ইমাম বলেন, বিদেশফেরত নারী শ্রমিকের পুনর্বাসনে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত উদ্যোগে বিদেশফেরত কর্মীদের জন্য ‘ওয়েলফেয়ার সেন্টার’ গড়ে তোলার বিষয়টিতে তিনি গুরুত্ব দেন।
আই সোশ্যালের চেয়ারপারসন অনন্য রায়হান বলেন, বিদেশ থেকে ফেরত আসা কর্মীরা বিমানবন্দরেই যাতে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে কার্ড পূরণ করতে পারেন, সে ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। দরকার হলে এই কার্ডগুলো সংগ্রহ করে প্রবাসীকল্যাণ কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া যায়। বিভিন্ন দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তা কমে যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে নতুন অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বৈঠকে অতিথিদের ধন্যবাদ দেন ইউএন উইমেনের কমিউনিকেশন অ্যানালিস্ট সারারাত ইসলাম। গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।