আমার এমআইটির অভিজ্ঞতা 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে পাঠকের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

লেখককে (বাঁয়ে) সনদ দিচ্ছেন অধ্যাপক জ্যাকোপো বুওনজিয়ার্নো। ১৬ জুন ২০২৩।

বিশ্বসেরা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) পড়াশোনা, গবেষণা কিংবা পড়াতে কে না যেতে চায়? পৃথিবীর সব দেশের সেরা শিক্ষার্থী, বিজ্ঞানী কিংবা শিক্ষক—সবারই পছন্দ এই এমআইটি। আমারও এক অদম্য ইচ্ছা ছিল এমআইটিতে যাব। ইচ্ছাটি পূরণের উপায় খুঁজছিলাম।

অনেকের কাছে শুনেছি, ফুলব্রাইট সিনিয়র ভিজিটিং স্কলার প্রোগ্রামটির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কিংবা গবেষণা করার সুযোগ পাওয়া যায়। এটি বিশ্বব্যাপী একটি মর্যাদাপূর্ণ প্রোগ্রাম। আমার ইচ্ছা ছিল এতে অংশগ্রহণ করার। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ফেসবুকে স্ক্রল করার সময় হঠাৎ দেখি আবেদন করার বিজ্ঞপ্তিটি। হাতে আছে মাত্র চার কার্যদিবস। ফেসবুকে না দেখলে আবেদন করার সুযোগই পেতাম না। এবার প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মাত্র চার দিনের মধ্যে আবেদন করি। আবেদনের শর্ত অনুযায়ী, যাঁরা আমার সম্পর্কে ভালো জানেন, সে রকম তিনজনের সুপারিশপত্র দরকার হয়। সঙ্গে গবেষণার প্রস্তাব এবং যে প্রতিষ্ঠানে যেতে চাই, সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো এক অধ্যাপকের আমন্ত্রণপত্র। নিজ বিভাগের সম্মতিপত্র তো লাগবেই। সংশয় ছিল একটি বিষয়কে ঘিরে, তা হলো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাউকে কখনো ফুলব্রাইট ভিজিটিং স্কলার প্রোগ্রামে যেতে শুনিনি। সাধারণত এই প্রোগ্রামের সিনিয়র ক্যাটাগরিতে সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও কৃষি গবেষণা-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের নেওয়া হয়ে থাকে। প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রচুর আবেদন করা হয়। এই স্কলারশিপ দেওয়া হয় মাত্র চার-পাঁচজনকে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস আবেদনপত্র গ্রহণ, যাচাই-বাছাই ও নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করে থাকে।

দুরু দুরু মন নিয়ে আবেদন করলাম। জানুয়ারি ২০২২-এ একটি ই-মেইল পেলাম। আমি তাদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছি এবং আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দিতে হবে। শূন্যভাগ সম্ভাবনা থেকে পঞ্চাশ ভাগ সম্ভাবনায় বুঝি উন্নীত হলাম। ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে সাক্ষাৎকারটি দিলাম। মনে হলো ভালোই দিলাম। এবার চূড়ান্ত ফলাফলের অপেক্ষা। প্রায় তিন মাস পর হঠাৎ একটি ই-মেইল পেলাম। ই-মেইল পড়ার পর মনে হলো, আমার স্বপ্নের এমআইটিতে যাওয়ার স্বপ্ন বুঝি সফল হতে যাচ্ছে। 

স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান এমআইটির নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পা রাখলাম ১ অক্টোবর ২০২২ তারিখে। আমার অধ্যাপক ড. জ্যাকোপো বুওনজিয়ার্নোর সঙ্গে প্রথম মিটিং হলো। তিনি তাঁর গবেষণা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিলেন। আমাকে কী করতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বিভাগের সব শিক্ষকের সঙ্গে একটি পরিচিতি সভার আয়োজন করলেন। আলোচনায় আমি আমার সম্পর্কে, দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিষয়ে তুলে ধরলাম। আমাদের দেশের জিডিপি এবং রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কে কয়েকজন জানতে চাইলেন। তারপর বিভাগের প্রধান ঘোষণা দিলেন, তাঁরা আমাকে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে পদ ও মর্যাদা দেবেন। এ ক্ষেত্রে একজন অধ্যাপক যা যা করেন, সবকিছুই আমি করতে পারব। সেই দিনটি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন।

আমাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে এভাবে বরণ করে নেওয়া হবে, জীবনেও ভাবিনি। দেশের মাটিতে সেরা শিক্ষার্থীদের পড়ানোর বহু অভিজ্ঞতা থাকলেও বিদেশের মাটিতে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব, তত্ত্বাবধায়ন করব এবং গবেষণা করব—সবই ছিল অত্যন্ত আবেগের। 

এসব একাডেমিক কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে বুঝতে পারলাম শিক্ষার্থীদের মধ্যে জানার প্রচণ্ড আগ্রহ আছে এবং তারা সেরাটা অর্জন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন বিষয়ে শিক্ষক, গবেষক কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে এরা বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চায়। শিক্ষকেরা যে বিষয়ে পারদর্শী, সেই বিষয় ছাড়া তাঁরা কখনো পড়ান না। এমআইটি থেকে স্নাতক-পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করলেও কোনো শিক্ষার্থী সরাসরি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায় না। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পোস্টডক্টরাল গবেষক কিংবা শিক্ষক হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। প্রার্থীদের উপস্থাপন, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, গবেষণার দক্ষতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত মূল্যায়নের ভিত্তিতে এমআইটি শিক্ষক নিয়োগ করে থাকে।

এই প্রতিষ্ঠানে দুই সেমিস্টারের বেশি সময়কাল ধরে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা ও গবেষণা করে দেশে ফিরি গত বছরের জুনে। অভিজ্ঞতা ও সনদ অর্জনের পাশাপাশি ঝুড়িতে যুক্ত হলো গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে নিবন্ধ প্রকাশ। আমার দেশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে ধরার বিষয়টি তো আছেই।

দেশে ফিরে আমার এমআইটির অভিজ্ঞতা ব্যবহার করছি শিক্ষার্থীদের পড়ানো থেকে শুরু করে পরীক্ষাগারে ও গবেষণাতে। কেমব্রিজে চার্লস নদীর তীরে মনোরম ক্যাম্পাস, উন্নত পরীক্ষাগার, ১০০ জনের মতো নোবেলধারী জ্ঞানী-গুণীর চারণভূমি ও সুনিপুণ ব্যবস্থাপনার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান এমআইটিকে কখনো ভোলার নয়। সেরা শিক্ষার্থীদের পড়ানো, তাদের তত্ত্বাবধান করা এবং গবেষণার অভিজ্ঞতার কথা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন।