কোরবানির পশুর হিসাব নিয়ে প্রশ্ন

এক বছরের ব্যবধানে গরু ও মহিষের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ, যা অতীতে দেখা যায়নি।

সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বেড়েছে। এতটাই বেড়েছে যে দেশের খামারিরা এবারের পবিত্র ঈদুল আজহার জন্য যতসংখ্যক কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত করেছেন, এর আগে কখনো তা করতে পারেননি।

এ অবস্থায় ছাগল–ভেড়াসহ কোরবানিযোগ্য অন্যান্য পশু কমলেও এবার বেড়েছে মূলত গরু ও মহিষের সংখ্যা। গতবারের তুলনায় এবার ঈদুল আজহায় গরু ও মহিষের সংখ্যা ৫ লাখ ১৬ হাজার বেশি। অর্থাৎ এবার গরু–মহিষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ (১০.৬৭%), যা সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক বছরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এমন কোনো বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়েনি, যার কারণে গরু–মহিষের সংখ্যা এত বাড়তে পারে। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মনে করছেন তাঁরা।

জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, কোরবানি ছাড়াও সামাজিক অনুষ্ঠানে ছাগলের মতো ছোট আকারের পশুর ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। মূলত করোনার পর থেকে এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে গরু একটু কম বিক্রি হচ্ছে। গরু উদ্বৃত্ত থেকে গেছে। সে জন্য সংখ্যা একটু বেশি হয়েছে। তাঁর মতে, তাদের হিসাব অস্বাভাবিক নয়।

হঠাৎ গরু–মহিষের এত সংখ্যা বৃদ্ধি কেন

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে এই খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)। সংগঠনটির সভাপতি মো. ইমরান হোসেন সম্প্রতি এক সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত বছর ১ কোটি ২৫ লাখ গবাদিপশু মজুত ছিল। তার মধ্যে ১ কোটি ৪০ হাজার গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। কোরবানির পর দেখেছি, অবিক্রীত পশু অনেক সস্তা দামে কসাইয়ের দোকানে মাংস হিসেবে বিক্রি হয়েছে।’

অর্থাৎ কোরবানির জন্য অবিক্রীত পশুর একটি বড় অংশ বছরের বাকি সময় ধরে বিক্রি হয়ে যায় মাংস হিসেবে। ফলে অবিক্রীত থাকায় পশু জমা হওয়ার যে দাবি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক করেছেন, তা অনেকটাই টেকে না।

করোনার পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ গবাদিপশুর দানাদার খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এখনো বাড়তি দামেই দানাদার খাদ্য খাওয়াতে হচ্ছে খামারিদের। পাশাপাশি বিদ্যুৎ, শ্রমিক খরচসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে কোরবানিযোগ্য পশুপালন অনেকটাই ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এসব বিষয় খামারিদের পশুপালন ঝুঁকিতে ফেলেছে।

অবশ্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দাবি করেন, ‘কৃষকদের বলেছি, দানাদার খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের ঘাস খাওয়াতে বলেছি। তা ছাড়া দানাদার খাদ্যে খরচ বাড়ে, মাংস ও দুধের মানও ভালো থাকে না। তিন বছর আমরা এ ধরনের প্রচার চালিয়েছি। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছি।’

তবে কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত করতে আগের মতোই দানাদার খাদ্য খাওয়াচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন খামারিরা। কেরানীগঞ্জের রাবিবা অ্যাগ্রোর কর্ণধার এম এ মাকসুদ রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর খামারে এবার ১০০টির মতো কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। এসব পশুকে আগে যে পরিমাণ ঘাস ও দানাদার খাবার খাওয়াতেন, এখনো তা–ই করছেন।

গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সবচেয়ে বড় প্রকল্পের নাম ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন’। ২০১৯ সাল থেকে দেশের ৬১ উপজেলায় ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, উন্নত খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ, প্রাণিস্বাস্থ্য এবং কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে খামারি পর্যায়ে বিদ্যমান প্রতিটি গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা। অর্থাৎ আকার বাড়িয়ে গবাদিপশুর মাংস বাড়ানো।

অর্থাৎ সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে মাংস উৎপাদনে সরকারের জোর বেশি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অস্বাভাবিক হারে গরু–মহিষের সংখ্যা বেড়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ে কার্যালয় রয়েছে। সেসব কার্যালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা মাঠপর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা নির্ধারণ করেছে অধিদপ্তর। সম্প্রতি প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেন, অধিদপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা ঘরে ঘরে গিয়ে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এই হিসাব তৈরি করেছেন।

এত সংখ্যক গরু–মহিষের সংখ্যা বাড়ল কীভাবে—এমন প্রশ্ন করা হলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা পর্যায় থেকে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা যে তথ্য পাঠান, তা সব সময় সঠিক হয় না। কারণ, এত অল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে এত বৃহৎ তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পক্ষে বড় খামারিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হলেও পারিবারিকভাবে পালন করা গবাদিপশুর সঠিক হিসাব পাওয়া তাঁদের জন্য কঠিন। তা ছাড়া চরে যে প্রচুর গবাদিপশু পালন করা হয়, সেখান থেকেও সঠিক তথ্য আসে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অনুমানভিত্তিক তথ্য আসে।

যদিও কমেছে ছাগল–ভেড়া

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি। এর সবই দেশীয় খামারিদের উৎপাদিত। এতসংখ্যক কোরবানিযোগ্য পশু দেশের খামারিরা এর আগে কখনো উৎপাদন করতে পারেননি।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবার গরু ও মহিষ ছাড়া ছাগল–ভেড়াসহ কোরবানিযোগ্য অন্যান্য পশুর সংখ্যা কমেছে। এবার কোরবানিযোগ্য ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৮০১ যা গত বছর ছিল ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ৮০টি। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় এবার ছাগল–ভেড়া কমেছে ৭২ হাজারের বেশি। আবার দুম্বার মতো অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৫০, যা গত বছর ছিল ২ হাজার ৫৮১টি। এর মানে গত বছরের তুলনায় অন্যান্য পশু কমেছে সাত শর বেশি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেখানে দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর রেকর্ড উৎপাদন, সেখানে ছাগল–ভেড়ার মতো জনপ্রিয় পশুর সংখ্যা কমে যাওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হিসাবেই যেখানে বড় আকারের তুলনায় ছাগল–ভেড়ার মতো ছোট আকারের প্রাণীর চাহিদা বাড়ছে, সেখানে এগুলোর সংখ্যা কমার যৌক্তিক কারণ নেই।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক শেখ আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অধিদপ্তর প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গবাদিপশুর পালনসংক্রান্ত নানা বিষয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা বাড়ানো হয়েছে। ফলে খামারিরা আগ্রহী হয়েছেন। আবার এ কথাও ঠিক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি, যে কারণে এত বৃদ্ধি পাবে। খাবারের দাম কমানোর ক্ষেত্রেও জরুরি পদক্ষেপ দেখা যায়নি।