র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পু্রস্কার

দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, জলবায়ু ও সুশাসন নিয়ে কাজ করছি: করভি রাকসান্দ

বাংলাদেশের জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাকসান্দ এশিয়ার নোবেলখ্যাত র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন। রাজধানীর রায়েরবাজারে ২০০৭ সালে বস্তিতে একটি কক্ষে ১৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে তিনি জাগো ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এই অলাভজনক ফাউন্ডেশন শিক্ষা, যুব উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সুশাসন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুহাদা আফরিন

জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাকসান্দ। র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন তিনি
ছবি: জাগো ফাউন্ডেশনের সৌজন্যে
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: র‍্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশন বলেছে, আপনি মানসম্মত শিক্ষার বিকাশে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। বাংলাদেশে ই–লার্নিং অথবা অনলাইনে দূরশিক্ষণ আপনার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। কীভাবে শুরু হয়?

করভি রাকসান্দ: ঢাকার বাইরে যখন স্কুল প্রতিষ্ঠা করি, তখন দেখি যে বাচ্চাদের ফল ভালো হচ্ছিল না। মূল সমস্যা দক্ষ শিক্ষকের অভাব। বেশি টাকা দিয়ে শিক্ষক ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া বাস্তব কারণে সম্ভব নয়। তখন তো জুম, গুগল মিট ছিল না। স্কাইপ ছিল একমাত্র উপায়। স্কাইপ দিয়ে ২০১১ সালে অনলাইনে পাঠদান শুরু করি আমরা। ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা এতে মজাও পায়। অনলাইনে যারা শিখছে, তারা বেশ স্মার্ট।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কী ধরনের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে জাগো?

করভি রাকসান্দ: দুই ধরনের শিক্ষা নিয়ে আমাদের কাজ। প্রথমত, মূলধারার গুণগত শিক্ষা। দ্বিতীয়ত, শিখনঘাটতি পূরণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পড়ানো। পাশাপাশি কিছু শিক্ষার্থী আছে, যারা পড়াশোনা শেষ করতে পারে না, তাদের দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ করছে জাগো। এখানে বিবেচনায় থাকে, বাজারে কোন দক্ষতার চাহিদা আছে এবং কোন শিক্ষাটা পেলে দ্রুত চাকরির বাজারে ঢুকতে পারবে একজন শিক্ষার্থী। দেশে সনদধারী বেকার বেশি। সনদভিত্তিক আর দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার একটা ফারাক আছে। সেটা পূরণের উদ্দেশ্যে জাগো ৫৫ হাজার তরুণকে দক্ষ করে তুলবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জাগোর এখন কতটি স্কুল এবং কত শিক্ষার্থী?

করভি রাকসান্দ: জাগো ফাউন্ডেশনের নিজস্ব স্কুলে পড়ছে সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থী। আরও কিছু শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। যেমন বান্দরবানে সাড়ে ১৩ হাজার শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছি। ওরা করোনার সময়ে ঝরে পড়ে। এই শিক্ষার্থীদের যার যতুটুকু শিখনঘাটতি রয়েছে, সেটুকু পূরণ করার চেষ্টা করে তাদের নিয়মিত স্কুলগুলোতে ফেরত পাঠানো হয়। সব মিলিয়ে ৩০ হাজার শিক্ষার্থী জাগোতে পড়ছে। এ ছাড়া আমাদের স্কুল থেকে পড়াশোনা করে দেশের বাইরে এখন ৩ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি নিয়ে পড়ছে। দেশের মধ্যে ৩০ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। জাগোতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ রয়েছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও জাগো বৃত্তির মাধ্যমে সহায়তা করছে। বিশেষ করে মেয়েদের এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: মানসম্মত শিক্ষার জন্য জাগো কী করতে চায়?

করভি রাকসান্দ: শিক্ষা পাচ্ছে কিন্তু চাকরি নেই। তাই গুণগত শিক্ষা খুব জরুরি। শুধু বইভিত্তিক পড়াশোনাই নয়। সহশিক্ষা কার্যক্রমকে আমরা গুরুত্ব দিই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জাগোর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অর্থসহায়তা কীভাবে আসে?

করভি রাকসান্দ: যেকোনো দাতা সংস্থার প্রকল্পের একটা শেষ থাকে। কিন্তু শিশুদের যখন পড়াব, স্বপ্ন দেখাব—সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ বছর লেগে যায়। সহায়তা শুরু করে কোনো দাতা যদি মাঝপথে চলে যায়, তখন বিপদে পড়তে হয়। তাই আমরা ব্যক্তিভিত্তিক দাতাদের সহায়তায় পড়াচ্ছি। আমাদের এখানে দুই হাজার টাকা দিয়েই কেউ কোনো শিশুর দায়িত্ব নিতে পারছে। হাজার হাজার মানুষ এভাবে এই শিশুদের সহায়তা করছে।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: স্বেচ্ছাসেবা ও সামাজিক আন্দোলনে তরুণদের যুক্ত করতে আপনি ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ (ভিবিডি) নামে একটি সংগঠনও চালু করেছেন। এই উদ্যোগের শুরু কীভাবে?

করভি রাকসান্দ: ২০০৯ সালে আমরা যখন সর্বজনীন শিশু দিবস উদ্‌যাপনের জন্য শহরের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত তরুণদের রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে পাঠাই, তখন পথশিশুদের কষ্টটা তারা বুঝতে পারে। তরুণেরা বুঝতে পেরেছিল তাদের কিছু করার আছে। পরে ২০১১ সালে ৪০ জন তরুণকে নিয়ে ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ (ভিবিডি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বিভিন্ন জেলার তরুণেরা আগ্রহ প্রকাশ করে। এখন ৬৪টি জেলায় ভিবিডির কার্যক্রম চলছে। প্রতিটি জেলার সদস্যরা নিজেরা ভোট দিয়ে নেতৃত্ব বাছাই করে। এখন ৫০ হাজারের বেশি তরুণ ভিবিডিতে যুক্ত।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জাগো ও ভিবিডি নিয়ে আরও কী কী করতে চান?

করভি রাকসান্দ: জাগো ও ভিবিডি সমস্যা ধরে ধরে কাজ করে। দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার ঘাটতি আছে। তাই আগামী পাঁচ বছর দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সুশাসন ও গণতন্ত্র বিষয়ে কাজ করে যাব।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনার অনুপ্রেরণা কী?

করভি রাকসান্দ: যে শিশুটির আগে রিকশাচালক হতে চাইত, সে এখন পাইলট হতে চায় বা উড়োজাহাজ বানাতে চায়। তরুণেরা যখন ভেবেছিল তাদের কিছু করার নেই, হয়তো কেউ আত্মহত্যার কথা ভাবত। সে এখন কোনো পুরস্কার জিতছে বা সফল হচ্ছে। এগুলোই আমাদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের জায়গা। পুরস্কার তো পায় আসলে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন। কিন্তু এর পেছনে আমার ৬০০ সহকর্মী, ৫০ হাজার তরুণ, আমাদের বিশ্বাস করে শিশুদের যারা দিচ্ছে, যারা দাতা—সবার প্রচেষ্টাতেই জাগো ফাউন্ডেশন এখানে এসেছে। সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
করভি রাকসান্দ: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন