জুলাই অভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ শিশু মুসাকে সঙ্গে নিয়ে সাক্ষ্য দিলেন বাবা

গুলিবিদ্ধ সন্তান বাসিত খান মুসাকে নিয়ে আজ সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন তার বাবা মো. মোস্তাফিজুর রহমানছবি: প্রথম আলো

গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল ছয় বছরের মো. বাসিত খান মুসা। এই শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন তার বাবা মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

মুসা প্রাণে বাঁচলেও মোস্তাফিজুরের মা মায়া ইসলাম তখন মারা গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর বলেছেন, তাঁর মাকে হত্যা এবং তাঁর সন্তানের এই অবস্থা করার জন্য দায়ীদের বিচার চান তিনি।

বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর ও নিশামনি দম্পতির একমাত্র সন্তান বাসিত। গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকায় নিজ বাসার গেটের ভেতর গুলিবিদ্ধ হয় শিশুটি। তার শরীরের এক পাশ এখনো প্যারালাইজড (অবশ)। মাথার এক পাশে খুলি নেই। মুখ দিয়ে খেতে পারে না, কথা বুঝতে পারলেও বলতে পারে না।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলায় দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে আজ সোমবার মোস্তাফিজুর রহমান জবানবন্দি দেন।

সাক্ষ্য দেওয়ার পর বেরিয়ে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে কাঁদতে কাঁদতে মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের কাছে তাঁর দাবি হলো মুসার চিকিৎসায় যেন কোনো রকম অবহেলা করা না হয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারেরর দাবিতে গত বছরের জুলাইয়ে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে কঠোর ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ব্যাপক দমন–পীড়নে কয়েক শ মানুষের মৃত্যু এবং বহু আহত হওয়ার পর তা গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এই অভ্যুত্থানে ৮ শতাধিক নিহত এবং ১৩ হাজারের বেশি আহতের তালিকা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নিহতদের জুলাই শহীদ এবং আহতদের জুলাই যোদ্ধা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

মোস্তাফিজুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার সময় বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি, সঙ্গে ছিল তাঁর মা ও ছেলে বাসিত। বাসার নিচে নামার পর গেটের বাইরে থেকে পুলিশের ছোড়া একটি গুলি তাঁর ছেলের মাথায় লাগে এবং মাথা ভেদ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। তিনি তখন ছেলেকে কোলে করে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিলে ছেলেকে নিয়ে সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তিনি।

তড়িঘড়ি করে গুলিবিদ্ধ ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় তখন মায়ের খোঁজ নেওয়ার সুযোগ পাননি মোস্তাফিজুর রহমান। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, মাকে বারবার ফোন করেও তিনি পাননি। পরে এক প্রতিবেশীকে ফোন করে তাঁর ফ্লাটে মায়ের খোঁজ করতে পাঠিয়েছিলেন। তখন জানতে পারেন, তাঁর ছেলের মাথায় যে গুলিটি লেগেছিল, সেটি মাথা ভেদ করে তাঁর মায়ের পেটে লেগেছে। তাঁর মাকে প্রতিবেশীরা ফরাজী হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরদিন (গত বছরের ২০ জুলাই) ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পথে তাঁর মা মারা যান।

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর বেশ কয়েকটি মামলার বিচার ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আসামি হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রয়েছেন।

মোস্তাফিজুর রহমান যে মামলায় সাক্ষ্য দেন, তাতে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ছাড়াও আসামি রয়েছেন ডিএমপির খিলগাঁও অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মশিউর রহমান, রামপুরা থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ও রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) চঞ্চল চন্দ্র সরকার। এর মধ্যে চঞ্চল চন্দ্র গ্রেপ্তার আছেন। বাকিরা পলাতক। আজ চঞ্চল চন্দ্রকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

জবানবন্দি শেষে সাক্ষী মোস্তাফিজুর রহমানকে জেরা করেন চঞ্চল চন্দ্রের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। জেরায় মোস্তাফিজুর বলেন, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও এলাকার লোকজনের কাছে শুনেছেন, ঘটনাস্থলে চঞ্চল চন্দ্র ছিলেন।

তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী সারওয়ার জাহান প্রশ্ন করেন, ঘটনাস্থলে চঞ্চল চন্দ্র উপস্থিত ছিলেন বলে যাঁদের কাছে শুনেছেন, তাঁদের নাম বলতে পারবেন।

এর জবাবে সাক্ষী মোস্তাফিজুর বলেন, তাঁদের নাম মনে নেই।

চঞ্চল চন্দ্র ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না, তাঁর আইনজীবী এই দাবি করলে সাক্ষী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ কথা সত্য নয়।