স্যার, আমি যেহেতু আপনার সরাসরি ছাত্র ছিলাম, তাই আমাদের ক্লাসের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। স্যার, আপনার মনে আছে একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে একটা বাঁধ দেখতে গেছেন। সেই বাঁধের একদিকে অনেক পানি, অনেকটা বন্যার মতো। আরেক দিকে পানি কম। ইঁদুরের গর্তের কারণে মাটির বাঁধ চুইয়ে পানি বের হচ্ছে। এ সময় বাঁধের যে পাশটায় নদী তার উল্টো দিকে আরেকটা ছোট বাঁধ দিয়ে সেখানে পানি দেওয়া হচ্ছিল। তো প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেই দৃশ্য দেখে বলেছিলেন যে একদিকে তো অনেক পানি, আরেক দিকে পানি অনেক কম, এই দুই পানি কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করবে! আপনার কি সেই গল্পটা মনে আছে?
আইনুন নিশাত: এ ধরনের অনেক ঘটনা আছে এবং অনেক নামকরা অধ্যাপকের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে হয়েছে। পানি যে চাপটা সৃষ্টি করে, তা নির্ভর করে উচ্চতার ওপর। কাজেই এক পাশে পানির ব্যাপ্তি কতটুকু তাতে কিছু আসে-যায় না। এপাশে দুই মাইল চওড়া পানি হতে পারে। এপাশে ১০ ফুট পানি হতে পারে। যদি উচ্চতা সমান হয় তাহলে দুপাশের পানিই কিন্তু বাঁধের ওপরে সমান চাপ সৃষ্টি করে। এই যে পদ্ধতিটা এটাকে বলে রিং বাঁধ। দুই পাশের পানির চাপের পার্থক্যটাকে জিরো করে দিয়ে তখন বাঁধটাকে মেরামত করা যাবে।
এটা কিন্তু বাংলার বহুদিনের পুরোনো প্রযুক্তি। এটা বিদেশ থেকে আনা নয়। বাংলাদেশের মানুষ অনেক আগে থেকে এই টেকনিকটা জানত। বাঁধের এক দিকে যদি পানির উচ্চতা বেশি থাকে; আর এক দিকে যদি পানি না থাকে, তখন পানি চুইয়ে নিচ দিয়ে উঠে আসবে। ধরো বাঁধ থেকে ৫০ ফুট দূরে এক জায়গায় পানি টগবগ করে ফুটছে; তার মানে বুঝতে হবে পানির প্রেশারের গন্ডগোল হচ্ছে। রিং বাঁধ দিয়ে টেকনিক্যালি পানির প্রেশারটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের যে ট্র্যাডিশনাল নলেজ, ফোক উইজডম এটা কিন্তু অনেক আগে থেকেই প্রচলিত আছে এবং কাজ করে চলেছে।
আপনার আব্বা গাজী শামসুর রহমান সাহেব তাঁর আইন আদালত অনুষ্ঠানে আইনের জটিল প্রশ্নগুলো সহজ করে চোখ বন্ধ করে উত্তর দিতেন। তাঁর আইনের বইগুলোও জনপ্রিয় ছিল। আপনার আব্বা ডিস্ট্রিক্ট জাজ ছিলেন...
আইনুন নিশাত: আব্বা ১৯৪৫-৪৬ সালে এমএ পাস করেন। তাঁর শিক্ষকতা করার ইচ্ছা ছিল। কিছুদিন একটি স্কুলের হেডমাস্টারও ছিলেন। পরবর্তীকালে জুডিশিয়ারিতে যোগ দেন। প্রথম ফরমাল পোস্টিং ছিল খুলনায়। প্রবেশন অফিসার। যখন দেশভাগ হয় তখন তিনি মেহেরপুরে পোস্টেড ছিলেন। মেহেরপুর থেকে আসেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। সেখানে আমার জন্ম। তখন আব্বার ডেজিগনেশন ছিল মুনসেফ। এখন যেটা অ্যাসিস্ট্যান্ট জাজ।
আচ্ছা। আমার খুব কৌতূহল ছিল, মুনসেফ মানে কী?
আইনুন নিশাত: মুনসেফ মানে হচ্ছে যিনি ইনসাফ করেন। ইনসাফ শব্দ থেকে মুনসেফ পদবিটা এসেছে। বাজিতপুর থেকে আব্বা আসেন জামালপুরে। দুই থেকে তিন বছর সেখানে থেকে যান মুন্সিগঞ্জে। এরপর একদম উত্তরে—পঞ্চগড়ে।
আপনার শৈশব তাহলে কীভাবে কোথায় কোথায় কাটল?
আইনুন নিশাত: যেসব জায়গার কথা বললাম, সবখানেই আমার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি মিশে আছে। আব্বা সারা জীবন পছন্দ করতেন উত্তরের রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া কিংবা ময়মনসিংহ, সিলেট, নোয়াখালীর অংশে চাকরি করতে। কারণ, তাঁর নিজের বাড়ি খুলনা আর আমার নানাবাড়ি বরিশাল। তাই সব সময় এই দুই অঞ্চল থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে পোস্টিং নিয়েছেন। তাঁর বিচারকাজে যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আপনি কি হলে থাকতেন?
আইনুন নিশাত: আমি আহসানউল্লাহ হলে থাকতাম।
স্যার আপনি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন তখন কি কালচারাল অ্যাকটিভিটিস যেমন ডিবেট, সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ এগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন?
আইনুন নিশাত: অত্যন্ত অ্যাকটিভ ছিলাম, তখন প্রতিটি হলে বাৎসরিক সাহিত্য সপ্তাহ হতো। আমার খুব দখল ছিল বিতর্কে। বাংলা-ইংরেজি দুটোতেই। আর একটি হচ্ছে উপস্থিত বক্তৃতা আর বিতর্কে আমাকে কেউ হারাতে পারত না।
স্যার আপনি কি কবিতা আবৃত্তি করতেন?
আইনুন নিশাত: কবিতা আবৃত্তি করেছি। এবং একটা কবিতা আবৃত্তির কথা মনে পড়ছে। সেই কবিতার শিরোনামে তোমার একটা বইও আছে ‘কখনো আমার মাকে’। তখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি। ১৯৬৯ সাল। তার কয়েক বছর আগে শামসুর রাহমান কবিতাটিকে গ্রন্থিত করেছেন। কবিতাটি পড়ে আমার চোখের পানি এসেছিল। তখন আমরা আমাদের মাকে দেখতে পেতাম কবিতাটিতে। আমার মা ব্রিটিশ আমলের লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে বিএসসি পড়তেন। এবং চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। তাঁর সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিতে লেটার ছিল। যে কারণে স্কুল থেকে তাঁকে মেডেল উপহার দেওয়া হয়। রুপার মেডেলটি আমার সংগ্রহে এখনো আছে।
স্যার আপনার মায়ের নাম?
আইনুন নিশাত: জামালআরা রহমান। তিনি পড়াশোনা শেষ করে আর কিছু করেননি। তিনি মারা গেছেন ১৪-১৫ বছর হয়েছে। আম্মা একটা কাজ সফলতার সঙ্গে করেছেন, তাঁর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াটা ভালোভাবে শিখিয়েছেন।
আপনারা কয় ভাই-বোন?
আইনুন নিশাত: আমরা দুই ভাই, তিন বোন ছিলাম। এক বোন ১৯৭৮ সালে রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। এখন আমরা দুই ভাই, দুই বোন বেঁচে আছি। আমাদের এই চারজনের মধ্যে তিনজন পিএইচডি করা। এবং এই সবকিছু হয়েছে মায়ের জন্য। অঙ্ক হাতে ধরে করিয়েছেন, ইংরেজি শিখিয়েছেন। বাবা অফিসের কাজে বাইরে বাইরে থাকতেন। এর বাইরে তাঁর সাহিত্যচর্চা কিংবা বই লেখার কাজে প্রচুর সময় দিতে হতো। খুব বেশি প্রসিদ্ধ নয়, কিন্তু আব্বার পাঁচ-ছয়টা গল্পের বই আছে।
আপনি তো অনেক বছর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ছিলেন। প্রথম কত সালে যোগ দিলেন?
আইনুন নিশাত: আমি যৌথ নদী কমিশনের অনারারি সদস্য ছিলাম।
কোন সাল থেকে?
আইনুন নিশাত: ডিসেম্বর ১৯৮১ সালে শুরু করে ১৯৯৯ পর্যন্ত ১৮ বছর আমি এই কাজ করেছি সম্পূর্ণ অনারারি ভিত্তিতে। তাই এর মধ্যে কোনো অনার ছিল না।
ওই সময়ের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা আপনি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।
আইনুন নিশাত: যৌথ কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো দুই দেশের আধিকারিকেরা সিদ্ধান্ত নেন। অর্থাৎ এটা ন্যাশনাল পলিসির ব্যাপার। তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী চলে। যেমন গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষর হলো ১৯৯৬ সাল। প্রথমে সেই বছরের জুলাই আগস্টের দিকে আমরা ভারতে যাই। প্রথম ছয়-সাতটা মিটিং হলো। তারপরে ৪ ডিসেম্বর আমরা গেলাম। আট দিনের মধ্যে ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৬, চুক্তি স্বাক্ষর হলো। বিষয়টা হচ্ছে ভারত সরকার তাদের অফিসারদের গাইডলাইন দিয়েছিল। আমরা কিন্তু আমাদের সরকার থেকে এ ধরনের গাইডলাইন পাইনি। যৌথ কমিশনের প্রতিটি মিটিংয়ের আগে আমরা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বসতাম। প্রথম মিটিংয়ে রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাস্টিস সাত্তার। এরপর এরশাদ সাহেব, খালেদা জিয়া হয়ে এলেন শেখ হাসিনা হাসিনা। রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে মিটিং হতো; তাঁরা বলতেন, ‘আপনারা বিশেষজ্ঞ, আপনারা জানেন ঠিক কী করতে হবে।’ এর মধ্যে মনে আছে এরশাদ সাহেবকে; ১৯৮৯-৯০-এর প্রথম দিকে ব্রিফ করা হচ্ছে। হঠাৎ উনি বললেন আমাকে আট বছর আগে এ বিষয়ে অন্য কথা বলেছিলেন। ওই বৈঠকে যাঁরা ছিলেন অন্ততপক্ষে আমি বলতে পারি আট বছর আগে তাঁকে যা বলা হয়েছিল তাঁর মনে আছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই নির্দেশনাটা রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আসত না। প্রথম দিকে ডিজি ছিলেন মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ। তারপর ছিলেন শফি সামী। শফি সামী আমার বুয়েটের শিক্ষক ছিলেন।
শফি সামী আর আমি পাশাপাশি বসে নেগোশিয়েট করতাম। খুব মজা লাগত। কিন্তু এই নীতিনির্ধারকেরা যদি আমাদের কথাটা শুনতেন তাহলে ১৯৯৬ সালের চুক্তি অন্য রকম হতে পারত। যেমন ১৯৯৬ সালের চুক্তি ৩০ বছরের চুক্তি। কেন?
যেমন ধরো আমরা যখন একটা জমি কিনি কিংবা আমার পৈতৃক সম্পত্তি দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করি, সেটা কিন্তু ইটারনিটি পর্যন্ত। তবে দুই ভাই কিন্তু ইচ্ছা করলে আলাপ-আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করতে পারে। আমি যেটা বলছে চাইছি গঙ্গা চুক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে ১৯৭৬ সালে। সেই সময়ে চুক্তিটা হয়েছিল পাঁচ বছরের জন্য। সেটাই ব্লান্ডার হয়েছে। তার দণ্ড এখনো আমরা দিচ্ছি। সামনের বছর বাংলাদেশকে আবার দিতে হবে।
তারা এমনটা কেন করেছিল?
আইনুন নিশাত: ভারত যেটা বুঝিয়েছে, আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। আমি অন রেকর্ড বলছি মিটিংয়ের সময় ভারত যে কথা বলে মিটিং মিনিটস (সভার কার্যবিবরণী) লেখার সময় সেটাই ঘুরে যায়। আবার সেই বিষয়টাই ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে আমাদের পলিটিক্যাল মাস্টারদের বোঝায়। আর সেটা যখন কার্যকর হয়, তখন সেটা আর এক জিনিস দাঁড়ায়।
কিছুদিন আগে একটা যৌথ নদী কমিশনের একটি টেকনিক্যাল দলকে ভারতে পাঠানো হয়েছে…
আইনুন নিশাত: এগুলো অযথা সময় নষ্ট করা। আমি গুরুত্ব দেব যেদিন শুনব প্রফেসর ইউনূস মোদির (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী) সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করছেন। একদম উচ্চপর্যায়ে এবং এই সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে হবে। এটা কিন্তু টেকনিক্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে হতে হবে।
আমার এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। একটি বিষয় যৌথ নদী কমিশন কিন্তু শুধু গঙ্গা তিস্তার ব্যাপার না। দুই দেশের মধ্যে পানিসংক্রান্ত যত অভিযোগ আছে, তা বৈঠকগুলোতে তুলে ধরা হয়। যেমন একটা মিটিংয়ের কথা বলি: আমাদের দর্শনায় অ্যালকোহল প্রডিউস হয়। এর দূষিত বর্জ্যে ভারতের চূর্ণ নদীর জল দূষিত হয়। মাছ মরে যায়। ভারত কমপ্লেন করল। আমরা বললাম যে ঠিক আছে আমরা ইটিপি (বর্জ্য পরিশোধনাগার) করব। দূষিত জল শোধন করে নদীতে ছাড়ব। আমরা ইটিপি করেছি। ভারত কিন্তু এটা নিয়ে এখনো অভিযোগ করে। যদিও সমস্যাটা এখন আর নেই।
এখন নেই?
আইনুন নিশাত: অনেক দিন ইটিপি চালানো হয়নি। এখন চালানো হচ্ছে। এখন আমি বলব, বাংলাদেশের উচিত ভারতকে বলা তোমরা এসে দেখে যাও আমরা কীভাবে চালাচ্ছি। এখন সমস্যাটা নেই। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, মিটিং শেষে সাধারণত কী হয়, মিটিংয়ের আলোচনাগুলো লিখে আমরা প্রথমে ভারতকে পাঠাই। এরপর রিকোয়েস্ট করি তোমরা ফার্স্ট ড্রাফট দাও। ওরাও ফার্স্ট ড্রাফট দিল।
মন্ত্রী সচিব হয়ে ভারতের ড্রাফটা আমার কাছে এল আমাকে বলা হলো দেখত সবকিছু ঠিক আছে কি না। আমি পড়ে বললাম ঠিক আছে। মন্ত্রীকে বললাম যে আপনি ভারতকে বলেন দিস ড্রাফট ইজ ওকে উইথ আস। ফাইনালাইজ ইট। ইটস ফাইনাল। এটা তোমরা প্রসেস করো।
আমিই হয়তোবা কিছুক্ষণ পরে সচিবকে বললাম যে এটা আর কোনো দিনই ফাইনাল হবে না। কারণ, ভারত বলল, আমরা রাজি হয়ে গেলাম। ভারতের সন্দেহ হচ্ছে এটার মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি আছে! দুই বছর তিন বছর লাগাবে এটাকে চূড়ান্ত করতে। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই। ভারতের টেকনিক্যাল লোকদের সঙ্গে যখন ওয়ান-টু-ওয়ান কথা বলেছি তখন আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি। কিন্তু যখনই ওটা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যায়, তখন একটা গোলমাল বাধে।
অন্য একটা কথাও প্রচলিত আছে স্যার, দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোনো একটি বিষয় হয়তো নিষ্পপ্তি করতে চান। কিন্তু ভারতের আমলাতন্ত্র নাকি এ ক্ষেত্রে বাদ সাধে। ভারতের আমলাতন্ত্র খুবই কনজারভেটিভ!
আইনুন নিশাত: কথাটা সত্যি। বাট ওদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, কোনো একটি বিষয় প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যেতে হবে ফরেন মিনিস্ট্রিতে, ফরেন মিনিস্ট্রি অ্যাপ্রুভ করলে যাবে পানি মন্ত্রণালয়ে, তারপরে দুই দেশের পানি মন্ত্রণালয় কাজ করবে, এরপর দেখতে হবে ভারতের রাজ্যভিত্তিক কোনো সমস্যা আছে কি না। রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আমি অন্য দেশের রাজ্যের সঙ্গে কথা বলতে রাজি না। আমি কথা বলব স্টেট টু স্টেট। দেশ থেকে দেশ। এই যে দেখো, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারত কিছুদিন পরপরই বলে যে তোমরা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কথা বলো সিকিমের সঙ্গে কলা বলো। তিস্তার সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ কেন সিকিমের সঙ্গে কথা বলবে। আমাকে অন্ততপক্ষে এই ১৮ বছরে ৩৬ বার স্টেটমেন্ট দিতে হয়েছে—‘বাংলাদেশ উড হ্যান্ডেল ইট উইথ দিল্লি, নট উইথ ক্যালকাটা।’
আচ্ছা স্যার এখন একটু অন্য গল্পের মধ্যে আসি। আপনি আমাদের আপনার জীবনের অনেক মজার অভিজ্ঞতা থেকে সুন্দর সুন্দর গল্প বলতেন। যেমন একবার বলেছিলেন, সুন্দরবনে পশ্চিমের দেশ থেকে এক্সপার্ট এসেছিল। সে জানেই না যে এটা আসলে জোয়ার-ভাটার একটা বন, যেখানে পানি উঠে আবার নেমে যায়।
আইনুন নিশাত: বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা যে মিটিং করে, তাতে একটা ব্লক অফ ডিসকাশন হচ্ছে সুন্দরবনের যৌথ ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এটা নিয়ে কিন্তু অনেক দিন ধরে কথা বলা হচ্ছে। এটা বিশ্বব্যাংক পিকআপ করল তারা অর্থায়ন করবে, ইউএনডিপি পিকআপ করল অর্থায়ন করবে, কলকাতায় মিটিং হলো, বাংলাদেশ দলে আমাকে নেওয়া হলো। পৃথিবীর বিখ্যাত বাঘসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ভারতের কিংবা আমাদের দেশের বাঘবিশেষজ্ঞরা কেউ ছিল না। বাঘের ওপরে আমার একটা বই আছে। মিটিংয়ে কথা উঠল, বাংলাদেশে থেকে আমরা বললাম যে স্পিডবোর্ড কিংবা দ্রুত নৌকা এই জাতীয় জিনিস লাগবে সুন্দরবন সুপারভাইজ করার জন্য। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা আমার ওপরে খেপে গেলেন। নৌকা কী করবে? উই নিড জিপ। জিপ দিয়ে কী করবে? হ্যাঁ জিপ। কারণ, ওদের মধ্যভারতের যেসব অংশে বাঘের অভয় আশ্রমগুলো আছে, সেখানে জিপ ব্যবহৃত হয়!
আমি তাকে বোঝাতে পারলাম না যে এটা একটা ‘ওয়েটল্যান্ড’। তাই না? আর জোয়ার–ভাটার ব্যাপারটা নাই–বা বললাম।
আমাদের বিশেষজ্ঞরাও ভুল করেন। সুন্দরবন তো এখন টোটালি লবণাক্ত। বাট এখন থেকে ২০-৩০ বছর আগে যখন লবণাক্ততাটা ততটা শক্তিশালী নয়, তখনো সুন্দরবনে দেখেছি গাছ লাগিয়েছে মিঠাপানির গাছ।
আবার হাওর অঞ্চলে গিয়ে দেখেছি লাগিয়েছে স্বাভাবিক গাছ। আমি যেটা বলতে চেষ্টা করছি যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে যদি কারিগরি বিষয় আসে তাহলে প্রপার কারিগরি এক্সপার্টের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
স্যার আরেকটা গল্প একবার করলেন আপনি। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে…
আইনুন নিশাত: আমাকে চার-পাঁচ বছর আগে শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর নিজে ফোন করলেন। আমাকে বললেন বিশ্বভারতীর সাবেক অধ্যাপক আর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর দুজন আসছেন। একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হবে। স্যার আপনি আসেন। একটা পেপার পড়তে হবে আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে যেটা দাঁড় করালাম, তার টাইটেল ছিল—আজকে রবি ঠাকুর বেঁচে থাকলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তাঁর যে বিড়ম্বনা হতো।
রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বেশি গান আছে বর্ষার ওপরে। সবচেয়ে কম বোধ হয় শীত নিয়ে। ছয় ঋতুর কিন্তু আলাদা আলাদা গান আছে। প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ গান ডাউনলোড করে দেখালাম যে একটা গানের বর্ণনাও আর বর্তমানে টিকবে না। ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে।’ এখন তো আর নীল নবঘন নাই, ফকফকা আকাশ দেখা যায়। তাই না?
‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে।’ এবার শীতে তো ঠান্ডাই পড়ল না। আর সবচেয়ে দুর্গতি হচ্ছে হেমন্ত আর বসন্তকাল নিয়ে। এই দুটোর অস্তিত্ব আর ২০-২৫ বছর পর থাকবে না। এবং শরৎ যে এসেছে, এটা দেখার জন্য পদ্মা নদীর পাড়ে যেতে হয়। অথবা কাশবন দেখতে যেতে হয় উত্তরা। এই যে পরিবর্তন আমি রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন ধরে ধরে প্রতিটিতে কী কী পরিবর্তন হয়েছে তার বর্ণনা করলাম। দুজন ভাইস চ্যান্সেলরই আমাকে বললেন যে ভাই এইভাবে তো আমরা কখনো চিন্তা করিনি।
তারপরের বছর আবার ডাক পড়ল। এবারের বক্তৃতার বিষয় ছিল—রবীন্দ্রনাথ ও নদী।
কবিগুরুর একটা কবিতা আছে, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে আমার কাছে যখন কোনো সাংবাদিক আসে নদীসংক্রান্ত প্রশ্ন করতে, আমি তখন বলি—‘নদী আপনি বোঝেন’। না বুঝলে তো আমার কথা বুঝবেন না।
হ্যাঁ স্যার আমরা বুঝি। বুঝব না কেন!
ঠিক আছে, আমাদের ছোট নদী রবীন্দ্রনাথের এইটা যদি আবৃত্তি করতে পারেন, আপনাকে এমন তথ্য দেব যে সম্পাদক আপনাকে বাহবা দেবে। আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি।
আমাদের ছোট নদী কবিতায় শেষ চারটা স্তবক হচ্ছে শীতকালের নদীর বর্ণনা আর পঞ্চমটা হচ্ছে বর্ষাকালের। নদী পাক খেয়ে ঘুরে ঘুরে চলে, নদীর দুই পাশে শিয়ালের ডাক। আমার কাছে কপি করা আছে। আমি কপিটা বের করে দিয়ে বললাম এই কবিতাটা যদি আমাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন তাহলে রিভার মেকানিকস বোঝা হয়ে যাবে।
আর দ্বিতীয় কবিতাটা হচ্ছে আঠারো পৃষ্ঠার লম্বা কবিতা। এটা রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ কবিতা। নদী। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের বিয়ে উপলক্ষে উপহার হিসেবে কবিতাটি উপহার দিয়েছিলেন। কবিতাটিতে পাহাড় থেকে উৎক্ষিপ্ত নদী কীভাবে প্লাবনভূমিতে এল আলটিমেটলি সমুদ্রে গেল, তার বর্ণনা আছে। কবিতাটিতে নদী পাহাড় থেকে উৎক্ষিপ্ত হলো প্রচণ্ড শক্তিতে, চঞ্চল পথ বেয়ে প্লাবনভূমিতে এসে নদী ধীরস্থির হলো। দুই পাড়ে গ্রামাঞ্চল গড়ে তুলল। আর দক্ষিণে সে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে—নোনা অর্থাৎ তার স্বাদ হয়ে গেল নোনা।
নীল হয়ে আসে জলধারা,
মুখে লাগে যেন নুন-পারা।
এই যে বর্ণনা আমি যখন বুয়েটে পোস্টগ্র্যাজুয়েট লেভেলে রিভার মেকানিকস পড়াতাম এই দুইটা কবিতা পড়া ছিল বাধ্যতামূলক।
আচ্ছা ১৫-২০ বছর আগে বলা হতো ৪০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ পানির নিচে ডুবে যাবে, এখন তো মনে হয় আরও ২০ বছর। বাস্তবতা কত দূর স্যার?
আইনুন নিশাত: এই শতাব্দীর শেষে, ৮০ বছরের মাথায়। ২০ বছর না ৮০ বছরের মাথায়। আস্তে আস্তে কিন্তু সমুদ্র এগিয়ে আসছে। সমুদ্রের অবস্থান হবে—আমি যদি যশোর থেকে একটা লাইন গোপালগঞ্জে অব্দি টানি সে ক্ষেত্রে গোপালগঞ্জ থেকে চাঁদপুর, চাঁদপুর থেকে ফেনীর দক্ষিণ অংশ সমুদ্রের অংশ হয়ে যাবে। ৩ ফুটের মতো বাড়লে এই অবস্থানে চলে আসবে।
আমাদের উপকূলজুড়ে উপকূলীয় বাঁধ আছে। সেখানে সমুদ্রের পানি উচ্চতার থেকেও বেশি ভয় হচ্ছে জলোচ্ছ্বাস। আমরা ১২ ফুট জলোচ্ছ্বাসের জন্য প্রস্তুত। আমাদের ১৫ ফুট বেড়িবাঁধ আছে। এটাকে এখন ২০ ফুট করছে। কিন্তু ওই যে বললাম ৩০-৪০ বছরের মধ্যে নদীর পানি লবণাক্ত হবে। ভেতরটা হয়তো ভালো থাকবে। যেমন: এখন খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনার দক্ষিণের উপজেলাগুলো লবণাক্ত হয়ে গেছে। সেখানে খাওয়ার পানি নেই। নদীও লবণাক্ত হয়েছে। এখনো ডুবে যাচ্ছে না। কিন্তু আর ২০-৩০ বছর পরে কিন্তু ডুবে যাবে। ডুবে গেলে সেডিমেন্ট জমা হয়ে গোটা অঞ্চলটা আবার উঁচু হবে। কিন্তু অঞ্চলটি মানুষের বসবাসযোগ্যতা হারাবে।
হ্যাঁ। এটাও তো শোনা যায় যে পলি পড়ে পড়ে আমাদের সমুদ্রসীমা বাড়ছে। মানে আয়তন বাড়ছে বাংলাদেশের।
আইনুন নিশাত: কথাটা একই সঙ্গে হ্যাঁ, আবার না। কারণ, যতটা পলি জমে আবার অন্য জায়গায় নদীটা ভাঙছে। কাজেই ভাঙাগড়ার হিসাব নিলে খুব বেশি যে গড়ছে, তা কিন্তু নয়। এটি ১ নম্বর পয়েন্ট। ২ নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে এখন থেকে যদি আমি ১০ হাজার বছর পরে আসি তাহলে দেখব হাতিয়ার সন্দীপের মধ্যখানটা ভরে গেছে। সন্দীপ নোয়াখালীর মধ্যখানে একটা চ্যানেল থাকবে। বাকিটা ভরে গেছে। তবে বিরাট অংশ সেডিমেন্টেড হয়ে যাবে। ১০ হাজার, ২০ হাজার বছর পর কিংবা এক লাখ বছর পরে। অর্থাৎ এই সময়টা এই ঘটনাটাই হচ্ছে টাইম স্কেল।
কিন্তু কী ঘটছে? এটা আমি যদি বাংলাদেশের ম্যাপের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বলে একটা ক্যানিয়ান আছে। পুব দিকের নদীগুলো সব পশ্চিমমুখী। আর পশ্চিম দিকের নদীগুলো সব পূর্বমুখী। অর্থাৎ যে বিপুল পলি আসে তা বঙ্গোপসাগরে চলে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার কাছাকাছি জায়গায় ভারত মহাসাগরে একটা দ্বীপ গড়ে উঠছে। ঠিকঠাক গড়ে উঠতে লক্ষ বছর সময় লাগবে। এই দ্বীপটার শেপটা হচ্ছে হাতপাখার মতো। এটাকে যেন বলা হয় বেঙ্গল ফ্যান। তো এটা আসতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এক লাখ বছরের চিন্তা করে তো লাভ নেই।
এটা কি স্যার ভূমিকম্পের কারণে হয়েছে? আগ্রার তাজমহল থেকে ভূমিকম্পের কারণে যমুনা নদী আমাদের এদিকে এল। এদিকে ব্রহ্মপুত্র সুরমা-কুশিয়ারা হয়ে মেঘনা; সব কটি এসে আমাদের এখানেই মিলিত হলো। তার মানে কি স্যার বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে?
আইনুন নিশাত: খুব বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে। আসলে ভূমিকম্পগুলো হয় টেকটোনিক প্লেট যেখানে সেখানে। তার মানে অস্ট্রেলিয়া থেকে এসে ইন্দোনেশিয়ার মধ্যখান থেকে আন্দামানের ওপর দিয়ে মিয়ানমার দিয়ে ভারতের ভেতর দিয়ে চীনে চলে গেছে। আর এর কিছু ব্রাঞ্চ আছে। একটা ব্রাঞ্চের নাম হচ্ছে শিলং প্লেট। শিলং জায়গাটা ওখানে গেলে দেখবে, যে একেবারে খাড়া এটা নেমে গেছে। এই রকম টেকটোনিক প্লেট যেখানে আছে সেগুলো নড়াচড়া করছে। যেমন এখন প্রচুর হিল ট্র্যাক্টসে এবং মিয়ানমারে চীনের ওই অংশে অনেক ভূমিকম্প হয়। এখন ভূমিকম্পের মাত্রা যদি খুব বেশি হয় তখন নদী একটা জায়গায় উঠে গেল নদীটা শিফট হয়ে আসতে পারে।
যেমন আজকে যমুনা যেখান থেকে প্রবাহিত হয় এটা বড়জোর ২০০-২৫০ বছরের পুরোনো খাত। ১৭০০ থেকে এবং ১৮৫০ সাল পর্যন্ত যমুনা দেওয়ানগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে আসত। কিন্তু ওই জায়গাটা সরে গিয়ে প্রবাহটা এখন দক্ষিণ দিকে চলে এসেছে। কাজেই এ রকম উল্টাপাল্টা নদীর ব্যবহার সেডিমেন্ট মুভমেন্টের ফলে হতে পারে। বড় ভূমিকম্প মানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প।
আপনি বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের সরকারের নীতিনির্ধারকদের জন্য পাঁচটা করণীয় বলেন—এই পাঁচটা জিনিসের একটা হচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জ। একটা হচ্ছে ভূমিকম্প সতর্কতা। আর আমাদের গ্রাউন্ড ওয়াটার যদি শেষ হয়ে যায়—ভূগর্ভস্থ পানি, তাহলে আমরা কী করব? সারফেস ওয়াটারের ব্যবহার এসব নিয়ে যদি কিছু বলতেন…
আইনুন নিশাত: একদম প্রথম জিনিস হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনটা সিরিয়াসলি নেওয়া। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ‘থ্রি জিরো’ বলে একটা বই লিখেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। ২০১৭-১৮ সালে দিকে প্রচার পেয়েছে। হঠাৎ করে। এর তৃতীয় জিরোটা হচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জসংক্রান্ত। কিন্তু ক্লাইমেট চেঞ্জ বিষয়ে ওনার থার্ড জিরোতে আমি অ্যাগ্রি করি না। অর্থাৎ গ্রিনহাউস গ্যাসকে জিরো করে ফেলা। এটা বাংলাদেশের কাজ নয়। বাংলাদেশ তো গ্রিনহাউস গ্যাস প্রডিউস করে দশমিক ভাগ। পৃথিবী থেকে গ্রিনহাউস গ্যাসকে জিরো করা প্রায় অসম্ভব। কাজেই ওটার দিকে আমার তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। আমাকে যেটা করতে হবে অ্যাডাপ্টেশন। বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছিলেন, ‘তোমরা অ্যাডাপ্ট করো। তোমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করো।’ আমাদের একসময় ৫ হাজার প্রজাতির ধান ছিল। কেন ছিল? বিভিন্ন আবহাওয়ায় বিভিন্ন পরিবেশে তৈরি হতো। বেগুন ছিল। এত বড় তাল বেগুন ছিল। গেল কই? আমাদের এগুলো রক্ষা করতে হবে। ফেরাতে হবে। তাহলে প্রথম জিনিস হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে যা করতে হবে তার দুটো ন্যাশনাল ডকুমেন্ট আছে। একটার নাম হচ্ছে ন্যাপ। আরেকটা হচ্ছে এনডিসি ন্যাশনাল ডিটারমিন কমিটমেন্ট। এই দুটো সিরিয়াসলি বাস্তবায়নের কাজ করতে হবে। এখানে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আন্তমন্ত্রণালয় সংযোগ এবং সহযোগিতা। আমাদের কোনো কো–অর্ডিনেশন নেই। আমাদের লোকাল গভর্নমেন্ট প্রকৃতি-পরিবেশের সর্বনাশ করছে। রাস্তাঘাটে এলোপাতাড়ি বানাচ্ছে, নদী ভরাট করছে। এটা হচ্ছে প্রথম।
দ্বিতীয় হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তার দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের এখানে ’৫০–এর দশকে বিঘাপ্রতি আধা মণ ধান হতো। এখন আমরা বিঘাপ্রতি ২০ থেকে ২৫ মণ ধান উৎপাদন করতে পারি। ভিয়েতনাম তার ডাবল করে। কাজেই পানি ব্যবস্থাপনাটাকে উন্নত করতে হবে। যেমন আমরা ধানখেতটাকে পানি দিয়ে ডুবিয়ে রাখি। কোনো দরকার নেই। আমি ডুবিয়ে রাখলাম। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করি, বাংলাদেশে ল্যান্ড ইউজের ক্ষেত্রে আরবান প্ল্যানিং কিংবা রুরাল প্ল্যানিং বলে কিছু নেই। এক মন্ত্রণালয় মনে করল রাস্তা বানাল। আর এক মন্ত্রণালয় আর এক জায়গায় ফ্যাক্টরি বসাল। কাজেই পুরো বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যদি আমরা একটা ল্যান্ড ইউজ প্লান, আরবানাইজেশন প্লান খুব দ্রুত না করি তাহলে এমন এমন ঘটনা ঘটবে যেটা ঠিক করা যাবে না। আমাদের এই ফিজিক্যাল প্ল্যানিং কিন্তু নেই।
এরপরে আমি যেটা বলতে চেষ্টা করব, সেটি হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো। আমরা কোয়ান্টিটির দিকে নজর দিয়েছি। কয়েক লাখ ছেলে পাস করে। কিন্তু কোয়ালিটির দিকে একটু নজর দেওয়ার প্রয়োজন আছে। মোটামুটি পরিবারের সাইজ কমে এসেছে। গড় ফ্যামিলি সাইজ বোধ হয় এখন ১ দশমিক ১ থেকে ১ দশমিক ৫। আর দূষণটা কমাতে হবে। আমাদের বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, নদীদূষণে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, এটা কিন্তু যেহেতু এটা লং টাইমে ভোগাবে। দেশের বায়ুদূষণটা কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বায়ুদূষণে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা।
কাজেই প্রতিটির ব্যাপারে মহাপরিকল্পনা আছে কিন্তু পরিকল্পনা শেলফে থাকে। কোনো কাজে আসে না। ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষেত্রেও তাই। আমরা ভূগর্ভস্থ পানির টার্মিনোলজি তো বুঝি না। ডিপ টিউবওয়েল, শ্যালো টিউবওয়েলের তফাত বুঝি না।
ডিপ টিউবওয়েল হচ্ছে যেটা ফোর্স মোডে পানি তোলে আর শ্যালো টিউবওয়েল সাকশন মোডে। একটা হ্যান্ড টিউবওয়েল যখন চাপ দিই পিস্টনটা ওপরে ওঠে একটা ভ্যাকুয়াম ক্রিয়েটেড হয় যেটা ওই যে স্কুলে পড়েছিলাম। ৭৮ মিলিমিটার অব মার্কারি অথবা ৩২ ফুট ফিট অব ওয়াটার। এখন পানির লেভেল তার থেকে অনেক নিচে নেমে গেছে। গ্রামের কৃষকেরা ইচ্ছেমতো পাম্প বসিয়ে পানি তুলছেন। এটার একটা নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। রিচার্জের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে এবং পানির গুণগত মান লক্ষ করতে হবে। আমাদের দেশের পানির ক্ষেত্রে শুধু যে সালফার ডেফিশিয়েন্সি হচ্ছে, তা নয়, রংপুর এলাকায় বোরন ডেফিশিয়েন্সি হচ্ছে। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। কাজেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা যেভাবে চলে আসছি এখনো সেইভাবেই চলব, এটা হবে না। আমাদের প্রশাসন কিন্তু এখনো বদলায়নি। ব্রিটিশ আমলে আইসিএস অফিসাররা দাপটের সঙ্গে চালাতেন। পাকিস্তান আমলে সিএসপিরাও তা–ই করতেন। আমাদের এখনকার অ্যাডমিন ক্যাডারও কিন্তু একই কাজ করছে। এটা সঠিক না। আমি একটা আর্টিকেলে কদিন আগে লিখেছিলাম যে আমাদের এমপি সাহেবরা উপজেলা চেয়ারম্যান হতে চেষ্টা করে। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে যে টাকা যায় এটা বিতরণ তাদের কাজ না জাতীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকার কাজ করতে চায়।
এখন একটু সফট প্রশ্নে আসি, স্যার আপনি গল্প, কবিতা, উপন্যাস তো পড়েন। আপনার প্রিয় লেখক কে? প্রিয় কবি, গান শোনেন কি না, শুনলে কার গান?
আইনুন নিশাত: প্রচুর গান শুনি। রবীন্দ্রনাথ শুনি, নজরুলের গান শুনি আর হেমন্তের গান শুনি প্রচুর। আমাদের সময় অদ্ভুত অদ্ভুত গায়ক ছিলেন। যাঁদের এখন প্রচলন নেই। যেমন অমল মুখার্জী। অনেকের গান শুনি পুরোনো দিনের হিন্দি গান শোনারও অভ্যাস আছে।
কী ধরনের বই পড়েন?
আইনুন নিশাত: এই চার–পাঁচ বছর ধরে ইতিহাসমুখী বই পড়ার নেশাটা বেড়েছে। এ মুহূর্তে যেটা পড়ছি এটা মানবজাতির ইতিহাস। লিখেছে আমার এক সহপাঠী। ইঞ্জিনিয়ার। একটা ফ্যান্টাস্টিক বই লিখেছে। এর আগে যেটা পড়েছিলাম হোমো সেপিয়েন্স। সিনেমাও দেখি প্রচুর।
এখনো ইতিহাসভিত্তিক সিনেমা বেশি এনজয় করি। কারণ, আমাদের ইতিহাস তো আমরা জানি না। তুরস্কে যে একসময় মুসলমানের অগ্রযাত্রা ছিল, এগুলো তো আমরা জানি না। কবিতা একসময় প্রচুর পড়েছি। আবৃত্তি করতাম। এখন আর ওই দিকে অতটা সময় হয় না।
যদি জিজ্ঞাসা করো যে আজকে কী পড়েছি? ভবিষ্যতে কী পড়বেন কিংবা গতকাল কী পড়েছেন, তাহলে বলব সৈয়দ মুজতবা আলী। পড়তে খুবই মজা লাগে।
স্যার আপনার স্ত্রী সামিনা সুলতানা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি কেমন আছেন?
আইনুন নিশাত: ভালোই আছেন। একটু বয়স হয়ে গেছে। যে কারণে তার মুভমেন্টে একটু প্রবলেম আছে। আমরা দুজন সমবয়সী বাট তার তুলনায় আমি এখনো বেশ চলেফিরে বেড়াই। এখনো এদিক-ওদিক যাই ট্রাভেল করি। উনি এই দিক থেকে খুব লিমিটেড হয়ে গেছে। তবে উনি প্রচুর সময় কাটান ইতিহাসভিত্তিক গবেষণায় এবং অন্যদের গবেষণার পদ্ধতি শেখানোর জন্য। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর তত্ত্বাবধানে একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হয় ঢাকায়। ভারত থেকে ১৫০ থেকে ২০০ জনের একটি প্রতিনিধিদল আসে। এই দুর্যোগের মধ্যেও ৫০-৬০ জন এসেছে।
প্রতিবছর ৩০০ থেকে ৪০০টি আর্টিকেল জমা পড়ে। তাঁর একটা টিম আছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সিনিয়র শিক্ষকেরা তাঁকে হেল্প করেন। সেখান থেকে হয়তো ৫০টি আর্টিকেল গুণগত মানে ভালো পাওয়া যায়। সেগুলোকে আরও গ্রহণযোগ্য মানে কীভাবে নেওয়া যায় এই এডিটিংয়ের কাজটা উনি নিজে করেন।
আনিসুল হক: আমরা শেষ করব স্যার। আপনাকে ধন্যবাদ।
আইনুন নিশাত: তোমাকে ও প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।