বিদেশে কর্মী গেছে দ্বিগুণ, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির গতি কম

মাসে এক লাখ করে কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন, যা সাধারণ সময়ের প্রায় দ্বিগুণ। সে অনুযায়ী বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়ছে না। 

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী যাওয়া দ্রুত বাড়ছে। গত ১৫ মাসে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গেছেন কর্মসংস্থানের জন্য, যা সাধারণ সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। যদিও দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাঁচটি কারণে বাংলাদেশিরা বেশি হারে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। সে অনুযায়ী প্রবাসী আয় না বাড়ার একটি কারণ হলো, বৈধ পথে অনেকেই তাঁদের আয় পাঠাতে আগ্রহী নন। ব্যাংকব্যবস্থার বাইরে অবৈধ পথ তথা হুন্ডিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ভালো পাওয়া যায়। 

অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, প্রবাসী আয় আগামী মাসগুলোতে বেশি হারে বাড়বে। কারণ, বিদেশে কর্মীরা যাওয়ার পর তাঁরা কয়েক মাস সময় নেন টাকা পাঠাতে। 

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত একজন কর্মী বিদেশে যাওয়ার পর দেশে টাকা পাঠাতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগে। গত বছরের শেষ থেকে নতুন কর্মীদের প্রবাসী আয় আসতে শুরু করেছে। এ বছর প্রবাসী আয় আরও বাড়বে। তিনি বলেন, বিদেশে কর্মী পাঠানোর জন্য আমলাতান্ত্রিক বাধা দূর করে জনমুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে কর্মীবান্ধব প্রক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ফলে বিদেশে কর্মী যাওয়া বাড়ছে। 

পাঁচ কারণ

২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে সাত লাখের মতো কর্মী বিদেশে যান কাজের জন্য। করোনাকালে, অর্থাৎ ২০২০ সালে সংখ্যাটি ২ লাখ ১৮ হাজারে নেমে আসে। এর পর থেকে বিদেশে যাওয়া বাড়ছে। ২০২১ সালে গেছেন ৬ লাখের বেশি মানুষ। 

বিএমইটির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে যান প্রায় ১১ লাখ ৩৬ হাজার জন। দেশের ইতিহাসে এক বছরে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি রেকর্ড। এর আগে ২০১৭ সালে বিদেশে যান ১০ লাখের কিছু বেশি কর্মী। এদিকে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বিদেশে গেছেন ৩ লাখ ২৩ হাজার জন। 

প্রবাসী আয়

■ ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ১,৬০৩ কোটি ডলার

■ প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫%

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিদেশে যাওয়ার হার বৃদ্ধির যে পাঁচটি কারণ বলছেন, তা হলো: ১. দ্রুত প্রবাসী কর্মীদের করোনার টিকা নিশ্চিত করা হয়েছে। ২. গন্তব্য দেশ থেকে অনেক কর্মী করোনার সময় দেশে ফিরে গেছেন। তাঁরা আর ফেরেননি। ফলে ওই সব দেশে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানির বাড়তি দামের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা রয়েছে। এতে বাড়তি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ৩. করোনার সময় দেশে এসে আটকা পড়েছিলেন প্রায় তিন লাখ কর্মী। তাঁরা আবার বিদেশে গেছেন। ৪. মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের যাওয়া শুরু হওয়া, ওমানের কোটা প্রত্যাহার, ইউরোপে নতুন কিছু শ্রমবাজার তৈরির সুযোগ তৈরি করেছে। ৫. কর্মীদের নিবন্ধন এখন অনলাইনেই করা যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ নেওয়া যায় জেলায় জেলায়। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের ঋণের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ থেকে গত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন সৌদি আরবে (৩৮ শতাংশ)। এর পরে রয়েছে মালয়েশিয়া (২৬ শতাংশ), ওমান (১৪ শতাংশ), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৮ শতাংশ) ও সিঙ্গাপুর (৪ শতাংশ)। 

বিদেশে যাওয়ার হার যেমন বেড়েছে, তেমনি বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগও আসছে। কেউ কেউ গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না। নিয়মিত ফিরে আসছেন অনেকে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোতে সহজে ভিসা পাওয়া যায় বলে সেখানে মানব পাচারের শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ। দেশে ফিরে কেউ কেউ মানব পাচার আইনে মামলাও করেছেন। বিদেশে বাংলাদেশিদের জিম্মি করে চাঁদা আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পিছিয়ে ছিল। সে বিষয়েও উন্নতি নেই। 

অভিবাসন খাত নিয়ে প্রতিবছর একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরে এ খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরু। গত ৩০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনের গতিপ্রকৃতি ২০২২: অর্জন ও চ্যালেঞ্জ’ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বলা হয়, প্রতিবছর একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী বিদেশে যাওয়ার সময় প্রতারিত হন। বিদেশে গিয়েও তাঁরা সঠিক চাকরি পান না। তাঁদের অনেকের দেশে ফিরে আসতে বাড়ি থেকে টাকা নিতে হয়। 

অবশ্য বিএমইটি বলছে, গত ১৪ বছরে বিভিন্ন দেশে ৮৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার সংখ্যা সে তুলনায় তেমন বেশি নয়। এ কারণে বিদেশে যেতে ব্যাপক উৎসাহ। 

এবার পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে প্রথমবারের মতো বাড়িফেরা প্রবাসীদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে বিএমইটি ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। ‘মাতৃভূমিতে স্বাগতম’ ব্যানার নিয়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন বিএমইটি ও কল্যাণ বোর্ডের দুই মহাপরিচালক। তাঁরা প্রবাসীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। 

সরকারের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে রামরু। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। কর্মী বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করেছে। বেশি হারে কর্মী যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তিনি বলেন, ঈদে বাড়ি ফেরা কর্মীদের স্বাগত জানানোটা প্রবাসী কর্মীদের সম্মান বাড়াবে, এটি দারুণ দৃষ্টান্ত। এরপর থেকে বিমানবন্দরে কর্মরতরাও নিশ্চয়ই বাড়িফেরা প্রবাসীদের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করবে।

প্রবাসী আয়ে গতি কম

বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ে সাধারণত দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি থাকে। ২০১৯–২০ অর্থবছরে এই আয় বেড়েছিল ১১ শতাংশ। ২০২০–২১ অর্থবছরে বৃদ্ধির হার ৩৬ শতাংশ। অবশ্য পরের অর্থবছরে (২০২১–২২) করোনার ধাক্কায় প্রবাসী আয়ে ধস নামে। কমে যায় ১৫ শতাংশ। 

চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই–মার্চ) প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলারের মতো, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি। অবশ্য সর্বশেষ মার্চ মাসের হিসাবে, ওই মাসে প্রবাসীরা বৈধ পথে ২০১ কোটি ৭৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন, যা আগের মাসের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি। সাধারণত পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে প্রবাসী আয় বেশি আসে। এবারও সেটাই হচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে বৈধ পথে প্রবাসী আয়ে গতি কম। 

সংযুক্ত আরব আমিরাতে কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলে জানা যায়, সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বাসস্থানের আশপাশে হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা আছে। বিনিময় হারও ব্যাংকব্যবস্থার চেয়ে ভালো। সরকার আড়াই শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়ার পরও হুন্ডিতে পাঠালে বেশি টাকা পাওয়া যায়। অন্যদিকে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে দূরে যেতে হয়। উল্লেখ্য, এখন ব্যাংকগুলো ডলারের দাম ১০৭ টাকা ধরে প্রবাসী আয় আনতে পারে। 

 প্রবাসী আয় যে পথেই আসুক না কেন, তা দেশে থাকা প্রবাসীদের স্বজনদের সংসারের ব্যয় মেটাতে ভূমিকা রাখে। গ্রামের অর্থনীতিতে টাকার সরবরাহ বাড়ায়। অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। তবে অবৈধভাবে প্রবাসী আয়ের যে অংশটুকু আসে, তা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখে না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১১৮ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪ হাজার ৪১৬ কোটি ডলার। উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে থাকায় ডলারের দাম বাড়ছে। গত বছর মে মাসে যে ডলার ৮৬ টাকা ছিল, তা এখন ১০৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সরকার নানাভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলারের মজুত ধরে রাখার চেষ্টা করছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের পণ্য আমদানিতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে, যা দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

বাংলাদেশিদের কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়ার হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া, কিন্তু সে অনুযায়ী প্রবাসী আয় না বাড়ার কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ তুলে ধরেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা একটি বড় কারণ। আবার প্রবাসী কর্মীরা বিদেশ যাওয়ার কয়েক মাস পর থেকে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। নতুন যাঁরা গেছেন, তাঁরা হয়তো পরে টাকা পাঠাতে শুরু করবেন। এতে আগামী মাসগুলোয় প্রবাসী আয় বাড়বে বলে আশা করা যায়। 

গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, অবৈধ পথে প্রবাসী আয় এলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ে না। ডলার–সংকটের সমাধানেও তা ভূমিকা রাখে না। তাই বৈধ পথে আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকব্যবস্থার বিনিময় হার ও হুন্ডির বিনিময় হারের পার্থক্য কমিয়ে আনা দরকার।