ক্যাঙারুর দেশে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের ৬৬তম আসরের উদ্বোধন

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ দলছবি: প্রথম আলো

অস্ট্রেলিয়া মানেই যেন ক্যাঙারুর দেশ। সিডনির অপেরা হাউস কিংবা ক্রিকেটার ডন ব্রাডম্যান–শেন ওয়ার্নের দেশও অস্ট্রেলিয়া। ৬৬তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের আসর বসেছে এই অস্ট্রেলিয়ার উপকূলীয় শহর সানশাইন কোস্টে। আজ সোমবার অলিম্পিয়াডের উদ্বোধন হয়েছে। বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রায় ৬০০–এর বেশি খুদে গণিতবিদ যোগ দিয়েছে এই অলিম্পিয়াডে।

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তরুণ গণিতবিদদের পদচারণে মুখর সানশাইন কোস্ট কনভেনশন সেন্টার ও তার আশপাশ। হোটেল থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। সকালের হালকা শীত উপেক্ষা করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন সবাই। সূর্যের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বোধনী আয়োজন যেন উৎসবমুখর হয়ে উঠছিল। সবার চোখেমুখে ছিল গণিতের প্রতি ভালোবাসা।

১৯৮৮ সালের পর আবারও এই মর্যাদাপূর্ণ আয়োজনের স্বাগতিক দেশ হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। এবার ভিন্ন এক প্রথা দেখা যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। সাধারণত দেশগুলো ইংরেজি বর্ণানুক্রমিকভাবে মঞ্চে আসে, কিন্তু এবার দীর্ঘতম পথ পাড়ি দেওয়া দেশগুলো পেল সবার আগে মঞ্চে যাওয়ার সম্মান। আর এই সম্মান প্রথম পেল আফ্রিকার দেশ মরক্কো, যারা দীর্ঘতম পথ পাড়ি দিয়ে এই গণিত উৎসবে যোগ দিতে এসেছে। এরপর একে একে পর্তুগাল, স্পেন, আলজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা মঞ্চে আসে।

স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলে বেলা প্রায় পৌনে একটা পর্যন্ত।

চারপাশের প্রকৃতিও যেন এই উৎসবের সঙ্গী হয়েছে। খুদে গণিতবিদেরা যে হোটেলে অবস্থান করছে, সেখানে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ছিল ক্যাঙারুর আনাগোনা, যা অনন্য পরিবেশকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে আর্জেন্টিনা গণিত দল আর আর্জেন্টিনার পতাকা হাতে বাংলাদেশ দল। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড শুধু প্রতিযোগিতা নয়, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনও
ছবি: প্রথম আলো

গণিত অলিম্পিয়াডের মতো বড় আয়োজন শুধু প্রতিযোগিতা নয়, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনকেও তুলে ধরে। এই যেমন বাংলাদেশ ও ব্রাজিল দল একে অপরের দেশের জাতীয় পতাকা হতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল, কুশল বিনিময় করল। একইভাবে ছবি তোলা ও কুশল বিনিময় হলো আর্জেন্টিনার গণিত দলের সঙ্গেও। নিজ নিজ দেশের জাতীয় পতাকা হাতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলল বাংলাদেশ, ইরান ও পাকিস্তানের গণিত দল।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়ান ম্যাথ ট্রাস্টের চেয়ার ড. জেফ্রি শিউট্রিম সবাইকে উষ্ণ আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে গণিতবিদেরা এখানে এসেছেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন লিবিয়ার কথা, যারা এবার প্রথম পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছে। বলেন কাতারের কথাও, যারা প্রথমবারের মতো ছয় সদস্যের পূর্ণাঙ্গ দল পাঠিয়েছে।

আইএমও প্রেসিডেন্ট গ্রেগর ডলিনার বলেন, সবচেয়ে বড় পুরোনো আর সম্মানের বিজ্ঞানবিষয়ক এমন প্রতিযোগিতায় সবাইকে আমন্ত্রণ। তিনি সবাইকে মূল্যবোধচর্চার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়। এই বৈশ্বিক গণিত মেলায় গণিতপ্রেমী তরুণেরা তাদের মেধা, পরিশ্রম ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রেরণা পায়।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে ব্রাজিলের গণিত দল আর ব্রাজিলের পতাকা হাতে বাংলাদেশ দল
ছবি: প্রথম আলো

মিলনায়তনের এক পাশে ছিলেন নানা দেশের দলনেতারা। সেখানে বাংলাদেশ দলের দলনেতা মাহবুব মজুমদারকেও দেখা যায়। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের দূর থেকে হাত নাড়িয়ে শুভকামনা জানান। আগামী দুই দিন পরীক্ষার সময় দলনেতা সব শিক্ষার্থীদের থেকে দূরে থাকবেন।

এর আগে ১২ জুলাই রাতে বাংলাদেশ গণিত দল অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টার যাত্রা শেষ করে ১৩ জুলাই রাতে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছায়। বাংলাদেশ দলে রয়েছে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী মনামী জামান, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী জাওয়াদ হামীম চৌধুরী, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী এম জামিউল হোসেন, চট্টগ্রাম বাকলিয়া সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জিতেন্দ্র বড়ুয়া, চট্টগ্রাম কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. রায়হান সিদ্দিকী এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী তাহসিন খান। এ ছাড়া আছেন বাংলাদেশ গণিত দলের উপদলনেতা এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান এবং পর্যবেক্ষক বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সমন্বয়ক বায়েজিদ ভূঁইয়া।

নিজ নিজ দেশের জাতীয় পতাকা হাতে (ডান থেকে) বাংলাদেশ, ইরান ও পাকিস্তানের গণিত দল। অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যোগ দিয়েছে তারা
ছবি: প্রথম আলো

১৫ ও ১৬ জুলাই ২ দিন পরীক্ষা পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। পরপর দুই দিনে ছয়টি অঙ্ক করতে দেওয়া হয়। এই ছয়টি অঙ্ক হয় একেবারে মৌলিক ও নতুন। ১৯ জুলাই সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফল প্রকাশ করা হবে।

বিজয়ীদের মেধা অনুসারে সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জের মেডেল দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের সদস্যপদ পায়। বাংলাদেশ দল এবার ২১তম বারের মতো আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে এখন পর্যন্ত ১টি স্বর্ণ, ৭টি রৌপ্যপদক, ৩৭টি ব্রোঞ্জপদক ও ৪৪টি সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করেছে বাংলাদেশ।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দেশব্যাপী গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে ৬৬তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য ছয় সদস্যের বাংলাদেশ গণিত দল নির্বাচন করা হয়। দল নির্বাচন ও এর আনুষঙ্গিক আয়োজন করেছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।