চট্টগ্রামে ‘আয়নাবাজি’, ধরা পড়েছে আঙুলের ছাপে

‘আয়নাবাজি’র কথা মনে আছে? এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র শরাফত করিম আয়না (চঞ্চল চৌধুরী) জাহাজে বাবুর্চির কাজ করেন। মাঝেমধ্যে দুই-তিন মাসের জন্য হাওয়া হয়ে যান তিনি। কোথায় যান? আসলে এ সময় তিনি সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের হয়ে টাকার বিনিময়ে জেল খাটেন। এমন ঘটনা শুধু সিনেমায়ই নয়, বাস্তবে ঘটেছে চট্টগ্রামেও।

চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও এলাকায় ফুটপাতের চা–বিক্রেতা মজিবুর রহমান। তিনি কোনো মামলার আসামি নন। কিন্তু চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এক আসামির পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান। বিনিময়ে পান তিন হাজার টাকা। অবশ্য বেশি দিন কারাবাস করতে পারেননি মজিবুর। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীদের নেওয়া আঙুলের ছাপে ধরা পড়ে যান। ঘটনাটি গত ১৩ মার্চের।
সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামির নাম নাছির আহমদ। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। আর টাকার বিনিময়ে নাছির সেজে আত্মসমর্পণ করে কারাবন্দী হন সাভারের মজিবুর।

শুধু মজিবুর নন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে এভাবে আত্মসমর্পণ করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আসা ১২ জনকে আঙুলের ছাপে শনাক্ত করা হয়। অন্য ১১ জন হলেন বাঁশখালীর মো. ইউসুফের পরিচয়ে শহিদুল ইসলাম, বগুড়ার নজরুল ইসলামের পরিচয়ে আরিফুল ইসলাম, পিরোজপুরের শফিকুল হাওলাদারের পরিচয়ে রফিকুল আহমেদ, রাঙামাটির মিনু মারমার পরিচয়ে পাইন্রপ্রু মারমা, কক্সবাজারের নাছিমা আক্তারের পরিচয়ে খতিজা বেগম, দিদারুল আলমের হয়ে কামাল হোসেন, মো. ছালামের পরিবর্তে চন্দনাইশের মো. আলম ও ছেনুয়ারা বেগমের বদলে টেকনাফের মনিরা বেগম, নগরের ইপিজেডের সেলিম উদ্দিনের পরিবর্তে বাঁশখালীর আবু নেছার, রাউজানের আবদুল করিমের পরিচয়ে আবদুল কাদের ও বাঁশখালীর মো. বাবুলের হয়ে সাইফ উদ্দিন। শেষ ১৩ অক্টোবর আঙুলের ছাপে ধরা পড়েন মাদকের মামলায় কক্সবাজারের ছেনুয়ারার হয়ে কারাগারে আসা মনিরা বেগম। ১২ জনের মধ্যে আলম ও মনিরা এখনো কারাবন্দী। বাকিরা জামিনে বেরিয়ে গেছেন।

কারা সূত্র জানায়, তাঁরা সবাই ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে স্বেচ্ছায় অন্যের হয়ে কারাগারে যান। মামলাগুলোর মধ্যে পাঁচটি মাদকের, তিনটি ডাকাতির, দুটি চেক প্রত্যাখ্যানের, একটি অর্থঋণ আদালতের, আরেকটি সরকারি কর্মচারীকে মারধরের।
জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজে (তথ্যভান্ডার) ভোটারদের আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত আছে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ।

জামিনে থাকা মজিবুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো মামলার আসামি ছিলাম না। প্রকৃত আসামি নাছির আহমদের পক্ষে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছি স্বেচ্ছায়। বিনিময়ে নাছিরের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নিয়েছি। তিনি আমার দোকানে চা খেতে আসতেন, তখন পরিচয়।’

আদালত সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মীর আহমেদ নামের এক ব্যক্তি নাছির আহমেদের বিরুদ্ধে ২০ হাজার টাকার চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা করেন। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই আদালত নাছিরকে ২ মাসের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। পরে নাছির এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আদালত দুই মাসের পরিবর্তে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু জামিনে গিয়ে পলাতক হয়ে যাওয়ায় আদালত আসামি নাছিরের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করেন।

এই সাজা থেকে নিজেকে বাঁচাতে নাছির চা–বিক্রেতা মজিবুরের সঙ্গে চুক্তি করেন। ১৩ মার্চ নাছির সেজে তৃতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন মজিবুর। আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আসামিকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। পরদিন আঙুলের ছাপ নিতে গিয়ে ধরা পড়েন তিনি।

সরকারি কৌঁসুলি নাছরিন আক্তার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মজিবুর যেহেতু চেক প্রত্যাখ্যানের মামলার আসামি নন, তাই তাঁকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। তবে আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করায় তাঁর বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশে মামলা হয়েছে।

মজিবুরের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামি নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে জাতীয় পরিচয়পত্রও নিয়ে আসেন। পরে জানতে পারি, প্রকৃত আসামির পরিবর্তে আরেকজন আত্মসমর্পণ করেছেন। পরে ওকালতনামা প্রত্যাহার করে নিয়েছি।’

আরও কারসাজি

চেক প্রত্যাখ্যানের একটি মামলায় এক বছরের সাজা হয় বগুড়ার নজরুল ইসলামের। তাঁর পক্ষে একই এলাকার আরিফুল ইসলাম ১২ জুলাই আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান। পরদিনই আঙুলের ছাপে বিষয়টি ধরা পড়লে আদালতের নির্দেশে আরিফুলের বিরুদ্ধে মামলা হয়। দুজনই জামিনে রয়েছেন। আরিফুল আদালতকে জানান, ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি স্বেচ্ছায় কারাগারে গিয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, নকল আসামি আঙুলের ছাপে ধরা না পড়লেও নানা ঝামেলায় পড়তে পারেন। তিনি যদি কোনো কারণে কারাগারে মারা যান, তাহলে আসল–নকল দুজনেরই পরিবার ঝামেলায় পড়বে। মৃত্যুসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ যাবতীয় নথিতে কাগজে–কলমে আসল আসামি মৃত হিসেবে থাকবেন। বাস্তবে আসল আসামি জীবিত। কিন্তু নথিতে মৃত হিসেবে থাকায় ব্যাংক হিসাব, পারিবারিক সম্পত্তিসহ নানা কাজে তিনি ঝামেলায় পড়বেন। আর নকল আসামি যিনি কারাগারে মারা যাবেন, বাস্তবে কাগজে–কলমে তিনি জীবিত। ফলে তাঁর মৃত্যুসনদ নিতে পারবে না পরিবার।

টাকার বিনিময়ে কারাবাসের ঘটনা নতুন নয়

একজনের হয়ে আরেকজনের কারাবাস চট্টগ্রামে নতুন ঘটনা নয়। নগরের কোতোয়ালি থানার একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমা আক্তারের পরিবর্তে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই কারাগারে যান মিনু আক্তার। মর্জিনা আক্তার নামের পূর্বপরিচিত এক নারী তাঁকে টাকা দেওয়ার কথা বলে কারাগারে যেতে বলেন। তিনি কুলসুমাকে চেনেন না। তাঁর সন্তানদের দেখভালের জন্য মাসে মাসে টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু শেষের দিকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় মিনু কারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান।

২০২১ সালের ১৬ জুন তিন বছর পর মুক্তি পান মিনু। ওই সময় কারাগারে আঙুলের ছাপ চালু ছিল না। পরে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। গ্রেপ্তার হন কুলসুমা। এভাবে চট্টগ্রামে কারামুক্ত থাকতে অনেক আসামি প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। তাঁরা চুক্তিতে নিজের বদলে অন্য ব্যক্তিকে আসামি সাজিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে আঙুলের ছাপে পরিচয় শনাক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে একজনের হয়ে আরেকজনের কারাবাস শনাক্ত করা সম্ভব না–ও হতে পারে। ভবঘুরে ও ছিন্নমূল অনেক মানুষ এখনো জাতীয় পরিচয়পত্রের আওতায় আসেননি। এ ছাড়া শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ হাতের সাহায্যে কঠোর পরিশ্রম করে। অনেক সময় তাঁদের আঙুলের ছাপ মেলে না। এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে আইনজীবীদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সত্যায়িত পরিচয়পত্র দেওয়ার নির্দেশনা

নগরের কোতোয়ালি মোড়ে অবস্থিত চট্টগ্রাম আদালত ভবনে ৭৬টি আদালত রয়েছে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ আসামি আত্মসমর্পণ করেন। জালিয়াতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নিজ নিজ আদালতে তিন বছর আগে আসামির আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সত্যায়িত পরিচয়পত্র দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সত্যায়ন করবেন যেকোনো আইনজীবী। চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মক্কেলের উপকার করতে গিয়ে তাড়াহুড়োর মধ্যে কিছু আইনজীবী সরল বিশ্বাসে যাচাই না করেই সত্যায়ন করে দেন। এ ব্যাপারে আইনজীবীদের আরও সতর্ক হতে হবে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম বলেন, আইনজীবী কোনো অবস্থায়ই দায় এড়াতে পারেন না। আইনজীবী নিজেই আত্মসমর্পণকারী আসামিকে শনাক্ত করেছেন। সঠিক পরিচয় জেনে খুবই সতর্কতার সঙ্গে কাজটি করা উচিত, যাতে পেশার মান সমুন্নত থাকে।