৫% কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে গরমে

  • প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের মাধ্যমে শূন্য জ্বালানিনির্ভর ভবন নির্মাণ করা সম্ভব।

  • প্রাকৃতিক উপায়ে উত্তাপ ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো যেতে পারে।

  • শুধু এসিনির্ভর হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে।

  • কারখানা নির্মাণের সময়েই উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে।

মুজিবুল হক, শহিদুল্লাহ আজিম, মোহাম্মদ হাতেম ও মাসুম উল আলম

পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা অতিরিক্ত গরমের কারণে শারীরিকভাবে অস্বস্তিতে ভোগেন। তাঁদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে এই নষ্ট হওয়া কর্মঘণ্টার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫ শতাংশ। অথচ পরিবেশবান্ধব উপায়ে পোশাক কারখানাগুলোতে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণের (হিট কন্ট্রোল) বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

‘পোশাকশিল্প শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নিজেদের কার্যালয়ে বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো। এতে সহযোগিতা করেছে গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি (অস্ট্রেলিয়া), বিএমটি, দ্য ইউনিভার্সিটি অব সিডনি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলকাম।

বৈঠকের প্রধান অতিথি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক বলেন, কয়েক বছর আগেও কারখানার নিরাপত্তা, শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো নতুন ছিল। সেগুলো ধীরে ধীরে নিশ্চিত করা হয়েছে। উত্তাপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নতুন। সরকার, দাতাগোষ্ঠী, মালিক ও শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা মিলে উদ্যোগ নিলে বিষয়টিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। তিনি কয়েকটি কারখানায় পরীক্ষামূলকভাবে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন।

২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মঘণ্টার এই ক্ষতি হবে। পোশাক কারখানায় পরিবেশবান্ধব উপায়ে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ।

প্রাকৃতিক উপায়ে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম। তিনি বলেন, উত্তাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অংশীজনদের নিয়ে কর্মশালা করতে হবে। কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাক খাতে সফলতার গল্প রয়েছে। উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি অর্থায়নের প্রয়োজন হবে না, দরকার সচেতনতা।

পোশাক কারখানায় উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে আরও বিস্তারিত সুপারিশ প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল বাংলাদেশের পোশাক খাত। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব কারখানার দেশ বাংলাদেশ। তিনি বলেন, শুধু কারখানার ভেতরের পরিবেশ নিয়ে ভাবলে হবে না, শ্রমিকেরা কারখানার বাইরে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা থাকেন, সেখানকার পরিবেশও মানসম্মত হতে হবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রোগ্রাম অফিসার (আরএমজি-২) এ কে এম মাসুম উল আলম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তাপ বেড়ে যাওয়া পেশাগত সমস্যার অংশ। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন নীতিতে উত্তাপের বিষয়টি কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে উত্তাপ বৃদ্ধি এবং শ্রমিকদের ওপর সেটির প্রভাবের বিষয়ে একটি গবেষণা প্রকল্প চলছে। ওয়েলকামের সহায়তায় গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি, বুয়েট ও আইসিডিডিআরবি যৌথভাবে তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

বৈঠকে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন গবেষণা দলের সদস্য বিএমটির সহযোগী প্রধান প্রকৌশলী ও গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির রিসার্চ ফেলো ফাহিম তন্ময়, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির ক্লাইমেট সায়েন্সের অধ্যাপক জিন পলটিকফ, ইউনিভার্সিটি অব সিডনির হিট অ্যান্ড হেলথের অধ্যাপক অলি জে, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো এরন ব্যাক এবং গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক ফারজানা ইয়াসমিন।

ধারণাপত্রে বলা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তখন দাবদাহ হবে নিয়মিত ঘটনা। পরিস্থিতি সামলাতে কারখানাগুলো শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বেশি ব্যবহার করবে। এগুলো জ্বালানি হিসেবে কয়লা ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি বেশি ব্যবহার করবে, ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কিন্তু প্রাকৃতিক উপায়ে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি উদ্যোগ নিলে তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি কমানো সম্ভব। এতে উৎপাদন খাতের কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে না। শ্রমিকদের অস্বস্তি কমবে।

বিএমটির সহযোগী প্রধান প্রকৌশলী ফাহিম তন্ময় বলেন, শুধু শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লাগানোই সমাধান না। কারখানাগুলোতে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

কারখানাগুলোয় প্রাকৃতিক উপায়ে আলো-বাতাস চলাচলের সুযোগ না থাকায় জ্বালানি বেশি খরচ হয় বলে মন্তব্য করেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক মো. আশিকুর রহমান জোয়ার্দ্দার। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে শূন্য জ্বালানি ভবন নির্মাণ করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের উত্তাপ কমাতে যেসব সুপারিশ এসেছে, সেগুলো নিয়ে পাইলট প্রকল্প করা যায়।

বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোয় পরিবেশবান্ধব উপায়ে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন আইসিডিডিআরবির পুষ্টি ও ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের বিজ্ঞানী ফাহমিদা তোফায়েল। তিনি বলেন, উত্তাপ শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। ক্লান্তি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতার সঙ্গে উত্তাপের সম্পর্ক রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, পোশাক খাতের বেশির ভাগ শ্রমিক নারী। কারখানার ভেতরে ও বাইরে তাঁদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। পোশাকশ্রমিকদের চাহিদাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন করতে হলে নারী শ্রমিকদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাও এর বাইরে নয়। ন্যায্যতাভিত্তিক পৃথিবী গড়ার দিকে নজর দিতে হবে। ধনী দেশগুলোর উষ্ণায়নের প্রভাবে ছোট দেশগুলোকে যেন ডুবতে না হয়।

ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) অকুপেশনাল সেফটি বোর্ডের চেয়ারপারসন মো. হাফিজুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের উত্তাপ পরিস্থিতি ভিন্ন। মেট্রোরেল চালু হলে রাজধানীর উত্তাপ পরিস্থিতি এমনটা না–ও থাকতে পারে। নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।

ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কারের সভাপতি চায়না রহমান বলেন, কারখানাগুলোতে উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে সরকার ও মালিকপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। কারখানার ভবন নিরাপত্তায় জোর দেওয়া হলেও শ্রমিকদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে।

পোশাক কারখানা নির্মাণের সময়েই উত্তাপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মাথায় রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাসটেইনিবিলিটি সেক্রেটারি নাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, কারখানা নির্মাণের সময় পেশাজীবীদের সহায়তা নিতে হবে। পোশাক খাতের সংগঠনগুলোর সঙ্গে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের সংগঠনগুলো একত্রে কাজ করতে পারে।

গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী