দুর্নীতি কার্পেটের নিচে রেখে মূল্যবৃদ্ধি নয়: ক্যাব

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ যাচাই করছে না আইএমএফ। তারা শুধু মূল্যবৃদ্ধির পরামর্শ দিচ্ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)ফাইল ছবি

ভর্তুকি সমন্বয়ের নামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কঠোর সমালোচনা করেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। তারা বলছে, ভর্তুকি সমন্বয়ের দুটি উপায় আছে। এর একটি খরচ কমানো। অন্যটি মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও সরকার চায় মূল্যবৃদ্ধি। অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতি কার্পেটের নিচে রেখে মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তার প্রতি সুবিচার নয়।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে ক্যাবের উদোগে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

‘অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা সুরক্ষায় মূল্যবৃদ্ধি নয়; জ্বালানির সুবিচার চাই’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে মূল্যবৃদ্ধির বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংস্কারে ১৩টি দাবি তুলে ধরেছে ক্যাব।

সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’–এর কারণে বিদ্যুৎ খাতে অস্বচ্ছতা বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে এই খাতে প্রতিযোগিতাকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির আগে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা খুঁজে বের করতে হবে। দুর্নীতি কার্পেটের নিচে রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই ভোক্তার প্রতি সুবিচার নয়।

উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ‘দায়মুক্তি’ আইন হিসেবে পরিচিত। এই আইনের আওতায় দরপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিভিন্ন চুক্তি করা হয়েছে। এসব চুক্তি নিয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগ ওই আইনের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি রোধ করার পরও যদি ঘাটতি (উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বিক্রি মূল্য কম) থাকে, তাহলে মূল্যবৃদ্ধির চিন্তা করা যেতে পারে বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তবে তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি হতে হবে স্বচ্ছ। এই কাজ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে করতে হবে।

দুর্নীতি কার্পেটের নিচে রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই ভোক্তার প্রতি সুবিচার নয়।
গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

ক্যাবের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতি যখন খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে, তখন ঋণসহায়তা নিয়ে এসেছে আইএমএফ। তারা কিস্তিতে টাকা ছাড়া করছে, তবে প্রতিবার বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ যাচাই করছে না আইএমএফ। তারা শুধু মূল্যবৃদ্ধির পরামর্শ দিচ্ছে।

‘স্বচ্ছতার জায়গায় নেই সরকার’

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কৌশলগত পণ্য। তাই সামাজিক প্রভাব বিচার করে দাম নির্ধারণ করতে হয়, বাণিজ্যিকভাবে নয়। আর এ কারণেই বিইআরসি তৈরি করা হয়েছিল। আইএমএফের পরামর্শে মূল্যবৃদ্ধি করে যদি ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়, তা হবে সংবিধানবিরোধী।

মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে সরকার স্বচ্ছতার জায়গা থেকে সরে গেছে বলে মনে করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জ্বালানির ব্যবস্থা না করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কেন করা হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। বিশ্বের কোথাও তরল জ্বালানি থেকে ৫ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় না। দেশে এখনো ৩০ শতাংশ উৎপাদন করা হচ্ছে তেল থেকে। সরকারের কাছে এখন টাকাও নেই, ডলারও নেই। তাই প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে। আবার জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের নামে সরকার মুনাফা করছে।

‘লুণ্ঠনমূলক মুনাফা’

সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, পর্যাপ্ত উৎপাদনসক্ষমতা থাকার পরও প্রতিবছর গরমে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছে ভোক্তারা। এ লোডশেডিং সমতাভিত্তিক না হওয়ায় গ্রামের মানুষ দিনে গড়ে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের মধ্যে থাকে। জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা এখন বলির পাঁঠা। সরকার ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের জন্য দিশাহারা হয়ে আইএমএফের পেছনে দৌড়াচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি থেকে সরে আসতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ক্যাব। মূল্যবৃদ্ধি না করে তিন বছরের মধ্য ভর্তুকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে ক্যাবের পেশ করা দাবিতে বলা হয়, প্রতিযোগিতাহীন যেকোনো ধরনের বিনিয়োগ আইনে নিষিদ্ধ করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর ক্ষমতা রহিত করে এটি আবার বিইআরসির কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

লিখিত বক্তব্য বলা হয়, সরকার মুনাফার ভাগ নেয়, আবার করপোরেট কর নেয়। এতে খরচ আরও বাড়ে। সরকার যদি মুনাফা না নিয়ে শুধু খরচ উশুল করত, তাহলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসেবার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকত। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিনিয়োগকারীদের অসাধু ব্যবসার শিকার হতো না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় খেয়াল খুশিমতো চুক্তি করে ‘লুণ্ঠনমূলক মুনাফা’ করার সুযোগ পাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। এ কারণেই ঘাটতি পূরণে মূল্য ও ভর্তুকি দুটিই বাড়ছে।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে এখনো কমবেশি ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি আছে। অপচয়, তছরুপ, আত্মসাৎ তথা লুণ্ঠন না হলে এই ঘাটতি হতো না। পরবর্তী বছরগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে, লুণ্ঠনমূলক মুনাফা বাড়বে, ঘাটতিও বাড়বে। মূল্যবৃদ্ধি করে সেই ঘাটতি সমন্বয় অসম্ভব হলেও সেই চেষ্টা চলছে। এই ঘাটতির দায় কোনোভাবেই জনগণের নয়, বিষয়টি আইএমএফ ও সরকার যে বোঝে না, এমনও নয়।