বাজারে একসঙ্গে সব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। অথচ সবাই বলছে, এবার উৎপাদন ভালো হয়েছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?
মোস্তফা কে মুজেরী: হ্যাঁ, চালের উৎপাদন ভালো হয়েছে। এ কারণে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের তুলনায় চালের দাম তুলনামূলক কম বেড়েছে। গমের দামও মোটামুটি স্থিতিশীল। কিন্তু ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চিনি থেকে শুরু করে শীতকালীন সবজির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আবার ডিম ও আলু আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর এই দুই পণ্যের দাম দ্রুত কিছুটা কমেছে। এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে সমস্যাটা পণ্যের জোগান বা উৎপাদন খরচের নয়। মূলত বাজারে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ছে।
আলু ও ডিম ব্যবসায়ীরা যখন অস্বাভাবিক মুনাফা তুলে নিচ্ছেন, তখন পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরাও সুযোগ নিচ্ছেন। তাঁদের দেখাদেখি সবজি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বাজারে একের পর এক পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শীতকালীন সবজির মতো মৌসুমি পণ্যের দামও ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁরাও সুযোগ নিচ্ছেন। এমনিতে শীতকালীন সবজি বাজারে এলে শুরুতে দাম একটু বেশি থাকে। কিন্তু এবার অন্যান্য পণ্যের দাম বেশি দেখে টমেটো, ফুলকপির মতো পণ্যের দামও ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিকভাবে বাড়াচ্ছেন।
বাজারে শৃঙ্খলা নষ্ট হলো কেন?
মোস্তফা কে মুজেরী: আমরা প্রথমে দেখলাম আলু ও ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ল। এতে সরকারি দু-একটি সংস্থা উচ্চবাচ্য করল। কিন্তু কী কারণে এত দাম বাড়ল, কারা এ জন্য দায়ী—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমরা পেলাম না। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা হলো না। দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে একটা পক্ষ বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ জন্য কোনো জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হয় না তাদের, শাস্তি হয় না। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য সুযোগসন্ধানী আরেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিল। যারা পেঁয়াজের ব্যবসা করে, তারা সুযোগ নিল। এখন আবার চিনির ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে সব মিলিয়ে বাজারের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে গেল। এ অবস্থায় সরকারকে আমরা বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে দেখছি না।
কিন্তু চাল ও গমের দাম তো তুলনামূলক কম বেড়েছে। এটা কেন ঘটল?
মোস্তফা কে মুজেরী: দেশে চাল ও গমের ব্যবসা অনেক বেশি সংগঠিত। এখানে অনেক বড় কোম্পানি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। সুতরাং কেউ চাইলেই ৫০ টাকার চাল এক সপ্তাহের মধ্যে ১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারছে না। আর এই বাজারের সঙ্গে বড় চালকল, ব্যাপারী, ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা যুক্ত আছেন। সরকার নিজেও চাল-গম সংগ্রহ ও মজুত করে। ফলে সরকারের পক্ষে এই বাজারে তদারকি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে হস্তক্ষেপের সুযোগ আছে। এ কারণে চাল বা আটার দাম হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে না। এ ছাড়া দেশের গণমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সংগঠনগুলো চাল-গমের দামের দিকে নিয়মিত নজর রাখছে। ফলে এই দুই পণ্যের দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল আছে।
খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের তো অনেক সংস্থা ও আইন আছে।
মোস্তফা কে মুজেরী: হ্যাঁ, তা আছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তো স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিক্রি করে। খাদ্য অধিদপ্তর কম দামে ও অনেক ক্ষেত্রে বিনা মূল্যে চাল-গম দেয়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বাজার তদারকির দায়িত্বে আছে। ভোগ্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তা ও কৃষকের স্বার্থ দেখা তো তাদের দায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতে তারা যে ঠিকমতো কাজ করছে না, তা তো বাজারে পণ্যের দাম দেখে বোঝা যাচ্ছে। সরকার অসহায়ের মতো বাজারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ডিম ও আলু আমদানির অনুমতি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। এতে দাম কিছুটা কমেছে ঠিকই। কিন্তু এখনো তো স্বাভাবিক হয়নি।
কিন্তু বাজারে কোন পণ্যের উৎপাদন খরচ কত, কত দামে তা বিক্রি হচ্ছে, কার কাছে কত মজুত আছে। এসব তথ্য তো সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে থাকার কথা। তারা কোথাও কোনো অসংগতি দেখলে ব্যবস্থা নেবে। একসঙ্গে এতগুলো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার পরও তাদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের অবস্থা পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলেছে।
তাহলে কি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না? সরকারের অগ্রাধিকারে নেই?
মোস্তফা কে মুজেরী: সরকারের অগ্রাধিকারে এক নম্বরে এখন রাজনীতি ও নির্বাচন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের লোকজন বেশি ব্যস্ত। দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সময় দেওয়ার মতো হয়তো সময়ও তাদের নেই।
কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে না এলে তার প্রভাব রাজনীতিতেও পড়বে? এটা কি সরকার বুঝতে পারছে না?
মোস্তফা কে মুজেরী: এটা অবশ্যই ঠিক। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হলে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাজনীতিতে পড়বে। সামনে নির্বাচন, রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অস্থিতিশীল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে কেউ নানা সুযোগ নিতে পারে। সেই সুযোগ কেউ কেউ হয়তো নিচ্ছেও। আবার যারা বাড়তি দামে এসব পণ্য বিক্রি করছে, তাদের অনেকের সঙ্গে সরকারের কারও কারও আঁতাত থাকতে পারে। পারস্পরিক যোগসাজশে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাজার অস্থিতিশীল হয়। সেটা শেষ পর্যন্ত সরকারের জন্য আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। যত দ্রুত সম্ভব সরকারের উচিত এ ধরনের পরিস্থিতিকে আর বাড়তে না দেওয়া।
দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করলে কখন ও কীভাবে সরকারের লাগাম টানার উদ্যোগ নেওয়া উচিত?
মোস্তফা কে মুজেরী: দেশে নিত্যপণ্যের চাহিদা ও জোগান পরিস্থিতির প্রয়োজনীয় তথ্য সরকারের কাছে থাকতে হবে। সেটা না থাকলে সরকারের পক্ষে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। আর কোনো পণ্যের মজুত, আমদানি ও উৎপাদন যথেষ্ট ভালো হওয়া সত্ত্বেও দাম বাড়লে শুরুতেই সরকারের উচিত কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া। এবার সরকারকে আমরা তা করতে দেখলাম না। এ কারণে দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সবার আগে সরকারকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকার অগ্রাধিকার দিলে রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এগোবে।
আমরা যদি দেখি, বাজারে যে এক কেজি টমেটো ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তার উৎপাদন খরচ কত, কৃষক মাঠ থেকে পাইকারের কাছে কত দামে বিক্রি করছেন। পরিবহন ও সংরক্ষণে কত খরচ পড়ছে। আর ভোক্তাদের কাছে তা কত দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি জানার সুযোগ আছে। আমরা ব্যবসায়ীদের মুনাফার বিরোধিতা করছি না। কিন্তু কেউ যদি ২০ টাকার পণ্য ২০০ টাকায় বিক্রি করে, তাহলে কোন হাতে গিয়ে ওই পণ্যের দাম ২০০ টাকা হলো, তা জানতে হবে। এ ধরনের অযৌক্তিক মুনাফা বন্ধ করতে হবে। সেই দায়িত্ব ভোক্তার পক্ষে পালন করা সম্ভব না, সরকারকে তা করতে হবে।
খাদ্যপণ্যের দাম দীর্ঘদিন ধরে বেশি থাকলে, তার প্রভাব কী হতে পারে? জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও বলছে, দেশে এবার খাদ্যের উৎপাদন ভালো হয়েছে। তারপরও সোয়া কোটি মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে আছে।
মোস্তফা কে মুজেরী: সেই ২০২০ সালে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে দেশে খাদপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার সমস্যার শুরু হয়। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম, চাল ও ভোজ্যতেলের দাম ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এতে দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী খাদ্যসংকটে পড়ে যায়। এখন বিশ্বজুড়ে প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। কিন্তু আমাদের দেশে ডলার-সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছেই। এ পরিস্থিতিতে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাবে।
কারণ, আমরা দেখছি যেসব খাবার থেকে গরিব মানুষের সস্তায় পুষ্টির জোগান আসত, সেগুলোর দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ পুষ্টি সমস্যায় পড়লে তাদের মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে, যা দেশের মানবসম্পদের উন্নতির পথে বড় সমস্যা। আর আমাদের এখানে সরকারের একটি প্রবণতা হচ্ছে, খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে কোনো দেশি বা আন্তর্জাতিক সংস্থা কোনো তথ্য দিলে তা শুরুতেই অস্বীকার করা। এটা তো স্বীকার-অস্বীকারের বিষয় নয়। এ ধরনের তথ্য বা প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়িয়েছে। এটা খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কতটা কার্যকর?
মোস্তফা কে মুজেরী: সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আমরা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মূলত চাল ও গম দিই। টিসিবির মাধ্যমে আরও কিছু পণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি করা হয়। কিন্তু মানুষ তো শুধু চাল, আটা, চিনি ও তেল খায় না। তারা সবজি, মাছ, দুধ, ডিম ও মাংস খায়। এসব পণ্য তো সরকার কয়েক কোটি মানুষের কাছে কম দামে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় পৌঁছাতে পারবে না। সেই সুযোগও নেই। আর সবার পক্ষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব পণ্য কেনার সময় ও সামাজিক অবস্থাও নেই। আবার আমরা ধরেই নিচ্ছি, শুধু শহর ও গ্রামের অতিদরিদ্ররা এসব পণ্যের ক্রেতা। এটা ঠিক নয়। মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ খাদপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কষ্টে আছে। তাদের পক্ষে এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনা সম্ভব হচ্ছে না।
বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে যারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ব্যবসায়ীদের থামানো কঠিন হয়ে যাবে। সব সময় রাজনৈতিক সংকটকালে এ ধরনের সুযোগসন্ধানীরা তৎপর হয়, এটা খুবই জানা কথা। সরকারের উচিত তাদের থামানো ও নিয়ন্ত্রণ করা।
খাদ্যপণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে আনা ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো যাবে না। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থানের উদ্যোগ বাড়াতে হবে। বাজারে দাম কমানো ও মানুষের আয় বাড়ানো ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে উন্নতির কোনো উপায় নেই।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তফা কে মুজেরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।