কিছু বই উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলাম। এর মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা আবদুল মান্নান সৈয়দের শুদ্ধতম কবি। আরেকটি নিউজপ্রিন্টের কাগজে ছাপানো অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম। সেই কিশোরবেলায় পড়ে ফেলি বই দুটি। সেই থেকে বাসন্তী–অনন্তদের কথা মনে গেঁথে আছে।
চাচার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে। দেশ স্বাধীনের পর একবার সেখানে বেড়াতে গিয়ে স্বাধীনতা দিবসে তিতাস নদে নৌকাবাইচ দেখি। থাকি কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায়। খেলাঘর করি। একদিন সিনেমা ম্যাগাজিন চিত্রালীতে খবর বেরোল, পরিচালক ঋত্বিক ঘটক তিতাস একটি নদীর নাম নিয়ে চলচ্চিত্র বানাবেন। সেই কাজে কুমিল্লায় আসবেন। থাকবেন তাঁর যমজ বোন প্রতীতি দেবীর বাসায়। কিছুদিন পর কান্দিরপাড় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, খেলাঘরের আনিস ভাই আমাকে বললেন, ‘ওই যে লম্বা লোকটা, সিনেমা বানায়, ঋত্বিক কুমার ঘটক।’
আমি অবাক হয়ে দেখি দীর্ঘদেহী লোকটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন, সঙ্গে আরও কিছু লোক, তাঁরা প্রায় দৌড়াচ্ছেন। শুটিং শুরু হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসপাড়ে। কুমিল্লার নাটকের লোকেরা কেউ কেউ অভিনয় করছেন। ট্রেনে করে দলে দলে লোকজন যাচ্ছে শুটিং দেখতে। সাত-আট মাস পর শহরের এক দেয়ালে দেখি তিতাস একটি নদীর নাম-এর পোস্টার। সাদামাটা দুই রঙের পোস্টার। সেটা ১৯৭৩ সাল। সিনেমাটা লিবার্টি হলে চলছে। বহু কষ্টে দেড় টাকা সংগ্রহ করি। টিকিট কেটে হলে ঢুকি। হল প্রায় ফাঁকা। দশ-বারোজন লোক বসে আছেন।
অনেক দিন তিতাস একটি নদীর নাম–এর লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও পরিচালক ঋত্বিক ঘটক গেঁথে থাকে মাথায়। পরে নব্বই সালে খবর পাই, আমার খালু শাহ আফতাব উদ্দীন আহমেদ ও অদ্বৈত মল্লবর্মণ সহপাঠী। অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে খালুর সঙ্গে কথা হয় তাঁর মেয়ে বুলবুল আপার রাজধানীর বাসাবোর আহমেদ বাগের বাসায়।
অনেক পরের কথা। বছর ১৫ আগে প্রথম আলোর ‘ঢাকায় থাকি’ বিভাগের তায়েব মিল্লাত ও আমি যাই অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছোটবেলার বন্ধু শাহ আফতাব উদ্দীনের ছেলে শাহ মুতাসিম বিল্লাহর কাঁঠালবাগানের বাসায়। মিল্লাত, আমি ও বিল্লাহ—তিনজনে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে শাহ আফতাব উদ্দীনকে নানা প্রশ্ন করি। তিনি স্মৃতি হাতড়ে উত্তর দেন। আমরা তাঁর কথা রেকর্ড করি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন প্রথম বিভাগে। খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। খুবই দরিদ্র মালো পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। স্কুলে বেতন দিতে পারতেন না। প্রায়ই না খেয়ে স্কুলে যেতেন। তাঁর বাড়ি ছিল গোকর্ণ ঘাটের জেলেপাড়ায়। সেখান থেকে স্কুলে আসার পথে গামছা পরে আসতেন। রাস্তা ভাঙাচোরা, কোমরসমান পানি। বর্ষাকালে পানি আরও বেড়ে গলাসমান হতো। ধুতি, বই মাথার ওপর ধরে পানি ভেঙে আসতে হতো।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও শাহ আফতাব উদ্দীন দুজনেই গল্প-কবিতা লিখতেন। কয়েকবার অদ্বৈত মল্লবর্মণের বাড়ি গোকর্ণ ঘাটের মালোপাড়ায় গিয়েছেন শাহ আফতাব উদ্দীন। সবুজপত্র নামে একটি দেয়ালপত্রিকা বের করতেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও শাহ আফতাব উদ্দীন। সাত–আটটি সংখ্যা বের করেছিলেন তাঁরা। তা ছাড়া অদ্বৈত মল্লবর্মণ কুমিল্লা ও আগরতলার লিটলম্যাগে গল্প লিখতেন।
ম্যাট্রিক পাসের পর অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও শাহ আফতাব উদ্দীন দুজনই ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ার পালবাড়িতে লজিং থেকেছেন কিছুদিন। আর্থিক সংকটে লেখাপড়া চালাতে পারছিলেন না। হঠাৎ ওই বছরই তিনি কলকাতায় চলে যান।
শাহ আফতাব উদ্দীন জানান, কলকাতায় লেখালেখি করছেন, অসুবিধায় আছেন—সেসব খবর পেয়েছেন। অদ্বৈতের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন অনেক পরে।
এই চিত্রকরের জলরঙে আঁকা অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি ছবি এই লেখার সঙ্গে ছাপা হচ্ছে। মূল ছবিটি কুমিল্লায় কলেজে পড়ার সময় তোলা।
আরেকটি স্কেচ সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহ আফতাব উদ্দীন বলেছিলেন, ‘স্কেচটা মনে হয় তাঁর ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সের। এটা অদ্বৈতরই স্কেচ। ছত্রিশ বছর বয়সে তো অদ্বৈত মারাই গেল।’