প্রতিরক্ষানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে জুলাইয়ের চেতনায় স্বাধীন ও শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে হবে। ভূরাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে কৌশলগত দূরদর্শিতা দেখাতে হবে। প্রয়োজনে ভারতকে ছাড়াই দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট সার্ককে এগিয়ে নিতে হবে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘টুয়ার্ডস আ কমপ্রিহেন্সিভ ফরেন পলিসি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন বক্তারা। ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামের একটি চিন্তন প্রতিষ্ঠান এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের একটা অবস্থান নেওয়ার সময় এসেছে। সার্ককে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে ভারত যদি সঙ্গে থাকে দারুণ। আর যদি তারা গোঁ ধরে থাকে, তখন এগিয়ে যেতে হবে। দুনিয়া তো কারও জন্য বসে থাকবে না।’
বাংলাদেশের আত্মপ্রত্যয়ী পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োজন মন্তব্য করে সাবেক এই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য আমি একজন ডিপ্লোম্যাটকে (কূটনীতিককে) ছয় মাস রেখে বদলি করে দিলাম, এভাবে দক্ষ ডিপ্লোম্যাট তৈরি হয় না। ভারত দক্ষ ডিপ্লোম্যাট তৈরি করতে পেরেছে, পেশাদারত্ব বজায় রাখতে পেরেছে।’
এ সময় আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিবিদদের নানা বিষয়ে ঝগড়া–বিবাদ থাকবে। তবে জাতীয় স্বার্থে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি সে বার্তা দিতে হবে বাইরে। আপনি ভারতকে দেখেন; তাদের মধ্যে বিবাদ থাকলেও জাতীয় স্বার্থে তারা ঐক্যবদ্ধ।’
পররাষ্ট্রনীতির কাঠামো বদলে যাবে
আলোচনা অনুষ্ঠানে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে তার সিটিজেনসদের গ্রাউন্ডিংয়ের (নাগরিকদের বোঝাপড়া) যে দরকারটা বা ওনারশিপটা (মালিকানা) যে দরকার, আনফরচুনেটলিট (দুর্ভাগ্যজনকভাবে) আমরা সেটা তৈরি করতে পারিনি।’
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা ফরেন পলিসিটা (পররাষ্ট্রনীতি) করি বাইরের জন্য। ১৯২টি দেশ; এসব দেশের মধ্যে কার ভূরাজনীতি কেমন হচ্ছে, কার আঞ্চলিক রাজনীতি কেমন হচ্ছে—এসব গভীরভাবে বুঝতে হবে। নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ বোঝার মতো দূরদর্শিতা থাকতে হবে।’
এ জন্য পেশাদারত্ব অর্জনের বিকল্প নেই জানিয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ডিপ্লোমেটিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (কূটনৈতিক) করার জন্য যেটুকু পলিসি সাপোর্ট (নীতি সমর্থন) দরকার, যেটুকু পাবলিক সাপোর্ট (জনসমর্থন) দরকার, যেটুকু ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট (আর্থিক সহযোগিতা) দরকার, বাংলাদেশে কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেটা নেই।’
আমাদের রাজনীতিবিদদের নানা বিষয়ে ঝগড়া–বিবাদ থাকবে। তবে জাতীয় স্বার্থে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি, সে বার্তা দিতে হবে বাইরে। আপনি ভারতকে দেখেন; তাদের মধ্যে বিবাদ থাকলেও জাতীয় স্বার্থে তাঁঁরা ঐক্যবদ্ধ
গত ৫৪ বছরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে ধরনের সম্পর্ক বাংলাদেশ বজায় রেখেছিল, সেটার কাঠামো পাল্টে যাবে বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের আকঙ্ক্ষো ও নেক্সট গ্র্যাজুয়েশন (স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে যাত্রা) চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে আমাদের জন্য। গত ৫৪ বছর ধরে আমরা ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) সঙ্গে যেই ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় রেখেছি, সেই ভিত্তিটাই চেঞ্জ হয়ে যাবে। আমাদের এই পুরো কাঠামোটা বদলে যাবে।’
সে জন্য ব্যাপক আকারে অভ্যন্তরীণ সংস্কার করতে হবে জানিয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ম্যাসিভ স্কেলে (ব্যাপকভাবে) আমাকে ডমেস্টিক রিফর্ম (অভ্যন্তরীণ সংস্কার) করতে হবে।’
ক্ষমতায় থাকতে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি
গত ১৭ বছরে ক্ষমতায় থাকার জন্য পররাষ্ট্রনীতিকে নতজানু করে রাখা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) শামা ওবায়েদ। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ইস্যু থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু—এসব পরবর্তী সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রোহিঙ্গাদের দুইবার প্রত্যাবাসন করতে পেরেছিলেন। বিএনপি সে অভিজ্ঞতার আলোকে রোহিঙ্গা ইস্যু মোকাবিলা করবে।
ফাউন্ডেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুতা—এ পররাষ্ট্রনীতি একটা অবাস্তব ও কাব্যিক নীতি। বিগত আমলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে রূপান্তর করা হয়েছিল, যা ছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য লজ্জা।’
আওয়ামী লীগের আমলে ১১টি প্রতিরক্ষা চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এমন একটা সংসদ ছিল তখন, যেখানে একটা চুক্তিও কখনো প্রকাশ করা হয়নি, আলোচনা করা হয়নি। প্রতিরক্ষানীতি ও পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে ভারসাম্য ও সমন্বয় করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এয়ার ভাইস মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) মাহমুদ হোসাইন বলেন, ‘প্রতিরক্ষানীতি ছাড়া কোনো দেশেরই পররাষ্ট্রনীতি তৈরি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে যে রাষ্ট্রদূতদের সময়কাল শেষ হয়ে যায়, তাঁরা সামরিক বাহিনীর কাছে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আমাদের সে চর্চা নাই।’
আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ঠিক থাকলেই কেবল পররাষ্ট্রনীতি একটা দেশকে সঠিক পথ দেখাতে পারে।
বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম বলেন, ‘অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতির পাশাপাশি আমাদের জলবায়ু ডিপ্লোমেসিকে (কূটনীতিকে) কাজে লাগাতে হবে।’
আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এয়ার কমোডর এম শফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান আলী আশরাফ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো রাজিয়া সুলতানা, ঢাকা ফোরাম ইনিশিয়েটিভের আশফাক জামান প্রমুখ।