ডাকসু নির্বাচন: কেউ ‘আহত’, কেউ ‘সন্তুষ্ট’
আলোচিত স্বতন্ত্রদের কেউ কেউ ভালো ভোট পেয়েছেন। আবার সেভাবে আলোচনায় না থেকেও অনেক ভোট পেয়েছেন এক প্রার্থী।
চাকরির প্রস্তুতির জন্য ইউটিউব বা ফেসবুকের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যেসব শিক্ষার্থী ইংরেজি শেখেন, তাঁদের কাছে শামীম হোসেন বেশ জনপ্রিয়। নিজের এই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে ডাকসুর ভিপি পদে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁর কথা বলার ধরন ও আবৃত্তির ভিডিও শিক্ষার্থীদের অনেকে পছন্দ করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইংরেজি ভাষার জনপ্রিয় এই শিক্ষক গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে জিততে না পারলেও ভোটের হিসাবে তৃতীয় হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৮৩ ভোট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তরের এই ছাত্র গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের আগে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো শুরু হয়। এটি তাঁকে মানসিকভাবে আহত করেছে। তবে ভোট শেষে আবার পড়ার টেবিলে ফিরে গেছেন তিনি।
শামীম হোসেন বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, রাজনীতিতে এথিকসের (নৈতিকতা) বিষয়টি পুরোপুরি মিসিং (হারিয়ে যাওয়া) হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে আমার পড়াশোনায় ফিরে যাওয়া উচিত এবং যত দ্রুত সম্ভব দেশ ছাড়া উচিত। আমি ভবিষ্যতে এডুকেশন সাইকোলজি বা এ ধরনের বিষয়ে কাজ করতে চাই।’
শামীমসহ ডাকসুর ভিপি (সহসভাপতি) পদে নির্বাচন করেছেন ৪৫ জন। আর জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে প্রার্থী ছিলেন ১৯ জন।
জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন আইন বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র আরাফাত চৌধুরী। গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’ নামে ফেসবুকভিত্তিক একটি গ্রুপ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এই মঞ্চ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটে পাশে থাকার চেষ্টা করত। যে কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁর মোটামুটি পরিচিতি ছিল।
তবে ডাকসু নির্বাচনের প্রচারে খুব বেশি আলোচনায় আসেননি আরাফাত। কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, জিএস পদে ৪ হাজার ৪৪ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন তিনি।
আমার কাছে মনে হয়েছে, রাজনীতিতে এথিকসের (নৈতিকতা) বিষয়টি পুরোপুরি মিসিং (হারিয়ে যাওয়া) হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে আমার পড়াশোনায় ফিরে যাওয়া উচিত এবং যত দ্রুত সম্ভব দেশ ছাড়া উচিত। আমি ভবিষ্যতে এডুকেশন সাইকোলজি বা এ ধরনের বিষয়ে কাজ করতে চাই।ডাকসুর ভিপি পদে পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী
ভোটের ফলাফলে ‘একপক্ষীয়ভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং’ করা হয়েছে বলে প্রশ্ন আরাফাত চৌধুরীর। তাঁর সঙ্গে গতকাল কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমি বেশ কিছু অসংগতি চিহ্নিত করেছি। সংখ্যাগত দিক থেকে কারচুপিটা করা হয়েছে। এসব নিয়ে আমি আগামীকাল (আজ শনিবার) প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ জমা দেব। ভোট প্রদানের সংখ্যা, পূর্ণাঙ্গ তালিকা এবং ভোটকেন্দ্রের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ২৮টি পদের ২৩টিতেই জিতেছে ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’। ক্যাম্পাসে আলোচনা আছে, সম্পাদকীয় দুটি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়া দুজনের প্রতিও শিবিরের ‘সমর্থন’ ছিল। ওই দুজন হলেন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে জয়ী হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ (৭ হাজার ৭৮২ ভোট) এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবাইর বিন নেছারী (৭ হাজার ৬০৮ ভোট)। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন তাঁরা।
ডাকসু নির্বাচনের প্রচার শুরুর প্রাক্কালে গত ২৬ আগস্ট মধ্যরাতে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে নিজের রুমমেটকে মারধর ও ভাঙা টিউবলাইট দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করার অভিযোগ ওঠে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী জালাল আহমদের বিরুদ্ধে। সেই রাতেই তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
প্রবীণতম প্রার্থী পেলেন ১০ ভোট
ডাকসুর ভিপি পদে প্রবীণতম প্রার্থী ছিলেন মুহাম্মাদ আবু তৈয়ব হাবিলদার। ৪৫ বছর বয়সী এই স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোট পেয়েছেন মাত্র ১০টি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলতে চাননি।
ডাকসু নির্বাচনের প্রচার শুরুর প্রাক্কালে গত ২৬ আগস্ট মধ্যরাতে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে নিজের রুমমেটকে মারধর ও ভাঙা টিউবলাইট দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করার অভিযোগ ওঠে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী জালাল আহমদের বিরুদ্ধে। সেই রাতেই তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ডাকসু নির্বাচনের দুই দিন পর গত বৃহস্পতিবার জালাল জামিন পেয়েছেন। তবে জেলে বসেই ভিপি পদে ৮ ভোট পেয়েছেন তিনি।
গবেষণাকাজে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সে জন্য ডাকসু নির্বাচনে সচেতনভাবেই গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলাম। নির্বাচনী প্রচারে আমি শিক্ষার্থীদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীই আমার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখেছে। সে জন্যই আমি ভোটে জিততে পেরেছি। কিছু প্যানেল আমাকে নির্বাচনে সমর্থন জানিয়েছিল। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।সানজিদা আহমেদ, ডাকসু নির্বাচনে গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে প্রার্থী
স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজিদা পেলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছিলেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের ছাত্রী সানজিদা আহমেদ (তন্বি)। তাঁর রক্তাক্ত মুখমণ্ডলের ছবি অভ্যুত্থানের অন্যতম ‘আইকনে’ পরিণত হয়। সানজিদা ডাকসু নির্বাচনে গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদসহ কয়েকটি প্যানেল তাঁকে সমর্থন জানিয়ে এই পদে প্রার্থী দেয়নি।
ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ১১ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সানজিদা। এবারের ডাকসু নির্বাচনে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট। সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে ভিপি হয়েছেন শিবিরের প্রার্থী মো. আবু সাদিক কায়েম।
সানজিদা আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণাকাজে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সে জন্য ডাকসু নির্বাচনে সচেতনভাবেই গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলাম। নির্বাচনী প্রচারে আমি শিক্ষার্থীদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীই আমার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখেছে। সে জন্যই আমি ভোটে জিততে পেরেছি। কিছু প্যানেল আমাকে নির্বাচনে সমর্থন জানিয়েছিল। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।’
সানজিদা জানান, এখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য নিজের কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভোটের মর্যাদা রক্ষা করা। তাঁর সঙ্গে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাঁদের ইশতেহারের বাস্তবায়নযোগ্য ও ভালো বিষয়গুলো তিনি গ্রহণ করবেন। এ ছাড়া অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষের পরামর্শ নিয়ে কাজ করবেন।
ডাকসুর সদস্য পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী উম্মা উসওয়াতুন রাফিয়ার বিভিন্ন বক্তব্যের একাধিক ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। তাঁর বাচনভঙ্গি ও চিন্তার প্রশংসা করেছেন অনেকে। সেই রাফিয়া ৪ হাজার ২০৯ ভোট পেয়ে ডাকসুর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
সেই ছবির ওপর লেখা ছিল, ‘ডাকসুতে দাঁড়াইছে সবাই, বসে আছে একজনই।’ এই ব্যতিক্রমী প্রচারকৌশলে অল্প সময়েই আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।
‘দাঁড়াইছে সবাই, বসে আছে একজনই’
প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা এক তরুণের চোখে সানগ্লাস, হাতে লাইটার আর ঠোঁটে সিগারেট—ফেসবুকে এমন একটি ছবি দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন ডাকসুর জিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আশিকুর রহমান। সেই ছবির ওপর লেখা ছিল, ‘ডাকসুতে দাঁড়াইছে সবাই, বসে আছে একজনই।’ এই ব্যতিক্রমী প্রচারকৌশলে অল্প সময়েই আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।
কিন্তু আশিকুর রহমান সেভাবে ভোট টানতে পারেননি, পেয়েছেন ৫২৬ ভোট। অবশ্য তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হলো, তিনি যথেষ্ট ভোট পেয়েছেন।
আশিকুর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তুমি তো জুনিয়র, তুমি কেন দাঁড়াইছ, তোমার যোগ্যতা কী—ভাইভা দেওয়ার মতো করে অনেক শিক্ষার্থীর এ রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে আমাকে। প্রতিটি হল ঘুরে ২০-৩০টি করে ভোট ম্যানেজ করেছি। আমি যে পরিশ্রম করেছি, সে অনুযায়ী আমার প্রাপ্ত ভোট ঠিক আছে। তবে আমার এক্সপেক্টেশন (প্রত্যাশা) ছিল এক হাজার ভোট পাব।’