চট্টগ্রামে মৌসুমি চামড়া সংগ্রহকারীদের আক্ষেপ

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন চামড়া সংগ্রহকারীদের কাছে। চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকা, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম
ছবি: জুয়েল শীল

বংশপরম্পরায় কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত সালাউদ্দিন দুলাল। লোকজনের কাছ থেকে চামড়া কিনে তা আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন। কোরবানির দিন দুপুরের পর শুরু হয়ে যায় তাঁর ব্যস্ততা। প্রতিবছরের মতো এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। চেয়ার-টেবিল নিয়ে রাস্তার পাশে বসে গেছেন লোকজন নিয়ে।

কিছুক্ষণ পরপর কেউ পিকআপ ভ্যান, কেউ রিকশায় করে, কেউ ভ্যানে করে নিয়ে আসছেন গরুর চামড়া। তাঁদের সঙ্গে দফায় দফায় দরদাম চলছে। কখনো তিনি নিজে, কখনো তাঁর লোকজন দরদামে ব্যস্ত। দরে মিললে কিনে নিচ্ছেন, না হলে ফেরত দিচ্ছেন।

কোরবানির চামড়া নিয়ে এই বেচাবিক্রির দৃশ্য দেখা যায় চট্টগ্রাম নগরের চৌমুহনী এলাকায়। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরের পর এখানে চামড়া নিয়ে আসতে শুরু করেন লোকজন। আর সালাউদ্দিন দুলালের মতো মৌসুমি চামড়া সংগ্রহকারীরা চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসেছেন।

চট্টগ্রাম নগরে খুচরা পর্যায়ে চামড়া বিক্রির সবচেয়ে বড় হাট বসে এই চৌমুহনী এলাকায়। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন। এরপর তাঁরা নগরের চৌমুহনীর বাজারে নিয়ে যান। চৌমুহনী এলাকায় চামড়া সংগ্রহকারীরা জানান, চামড়া বেচাকেনার সঙ্গে তাঁরা ১০-১২ জন যুক্ত। এবার ১৫–২০ হাজার চামড়া সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা আছে। তবে একসময় ৪০-৫০ হাজার চামড়া সংগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু দাম না থাকায় এখন মানুষ চামড়া বিক্রি করতে তাঁদের কাছে আগের মতো আসেন না।

এ ছাড়া নগরের বহদ্দারহাট, অলংকার মোড়, সিটি গেটসহ বিভিন্ন এলাকায়ও হাট বসে। এসব হাটে সংগ্রহ করা চামড়া চলে যায় চট্টগ্রাম নগরের আতুরার ডিপোর আড়ত কিংবা ঢাকার ট্যানারিগুলোতে।

পুরোনো সুদিন নিয়ে আক্ষেপ

আজ বেলা আড়াইটায় চামড়া সংগ্রহের এক ফাঁকে কথা হয় সালাউদ্দিন দুলালের সঙ্গে। চামড়ার বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন চৌমুহনী এলাকার এই স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি বলেন, ১০-১৫ বছর আগে এই সময়ে দম ফেলার ফুরসত ছিল না। ট্রাকে ট্রাকে চামড়া আসত। মানুষের কাছ থেকে একেকটি চামড়া নিতেন চার-পাঁচ হাজার টাকায়। এখন আর সেই দিন নেই। ব্যবসা কমে গেছে। বংশপরম্পরার কারণে এই ব্যবসাও ছেড়ে যেতে পারছেন না।

চামড়া সংগ্রহকারীদের আক্ষেপ আগে মানুষের কাছ থেকে একেকটি চামড়া নিতেন চার-পাঁচ হাজার টাকায়। এখন আর সেই দিন নেই্চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকা, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম
ছবি: প্রথম আলো

এবার প্রায় পাঁচ হাজার চামড়া সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে বলে জানান সালাউদ্দিন দুলাল। তিনি বলেন, এবার বড় গরুর চামড়া কিনছেন ৪৫০–৬০০ টাকায়। আর মাঝারি গরুর চামড়া ৩৫০–৪০০ টাকায়। শেষ পর্যন্ত এই দামে আড়তদারদের কাছে এসব চামড়া বিক্রি করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে বলে জানান তিনি।

সালাউদ্দিন দুলালের মতো চামড়ার ব্যবসার পুরোনো দিনগুলোর কথা ভেবে আক্ষেপ করলেন মো. ইয়াছিন ও মো. আলম সওদাগর। তাঁরা বলেন, চামড়া ব্যবসার সেই সুদিন আর নেই। একসময় প্রচুর চাহিদা ছিল। কোরবানিদাতারা যেমন ভালো দাম পেতেন, তাঁরাও বিক্রি করে ভালো লাভ করতেন।

এই দুই মৌসুমি চামড়া সংগ্রহকারী বলেন, চামড়ার দাম অনেক সস্তা হয়ে গেছে। আগে যেখানে ৪-৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো, এখন হয় ৪০০-৫০০ টাকায়। এখন লবণের দাম ও শ্রমিকের মজুরিও বেড়ে গেছে। তাই আগের মতো লাভ নেই।

ব্যবসায়ী রুবেলও কোরবানির সময় মৌসুমি চামড়া সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে চামড়া কিনে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন। ১৫ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রুবেল বলেন, চামড়ার ব্যবসায়ও সিন্ডিকেট হয়েছে। তাই দাম পড়ে গেছে। সরকারি দর অনুযায়ী বড় গরুর চামড়ার দাম ৩০০ টাকাও হয় না। চক্ষুলজ্জায় এত অল্প টাকা দেওয়া যায় না। তাই ৫০০-৬০০ টাকা দেন। বাড়তি দামে কিনলেও কিছু টাকা লাভ থাকবে বলে জানান তিনি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার কোরবানির পশুর লবণযুক্ত চামড়ার দর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

দাম না পেয়ে হতাশ মৌসুমি চামড়া সংগ্রহকারী

কেউ পিকআপ ভ্যান, কেউ রিকশায় করে, কেউ ভ্যানে করে নিয়ে আসছেন গরুর চামড়া। চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকা, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামে চার লাখ কোরবানির কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিয়েছেন আড়তদারেরা। চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণ সংগ্রহের পাশাপাশি শ্রমিকও নিয়োগ করেছেন তাঁরা। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে খরচ বাড়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বেশি দামে চামড়া কেনায় সতর্ক করেছেন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা।

আড়তদারদের মতে, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করার সময়ই বেশি দাম দিয়ে দেন। পরে তাঁরা সমস্যায় পড়েন।

নগরের হালিশহরের সবুজবাগ এলাকা থেকে সংগ্রহ করা ৪০টি চামড়া বিক্রি করতে চৌমুহনী এলাকায় আসেন মৌসুমি ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন। প্রতিটি চামড়ার দাম চান ৮০০ টাকা। কিন্তু এ দাম দিতে রাজি হননি ইয়াছিন সওদাগর। তিনি অর্ধেক দামে দিতে চান। পরে সাড়ে ৫০০ টাকা করে চামড়াগুলো কিনে নেন আমজাদের কাছ থেকে।

প্রত্যাশিত দর না পেয়ে হতাশ আমজাদ বলেন, কয়েক জায়গায় চেষ্টা করেছেন ৮০০ টাকা করে বিক্রি করতে। কিন্তু কেউই ৫০০ টাকার বেশি রাজি হননি। পরে যা পেয়েছেন, তা দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। বাসার আশপাশের মানুষের কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে কেনেন বলে জানান তিনি।

আমজাদ হোসেন বিক্রি করলেও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. আলামিন ১৫২টি চামড়া বিক্রি করেননি। তিনি ৬০০ টাকা করে চাইলেও সংগ্রহকারীরা ৪০০ টাকার বেশি দিতে রাজি হননি। কাঙ্ক্ষিত দর না পেয়ে যে গাড়িতে করে চামড়াগুলো আনেন, সেটি নিয়ে ফিরে যান।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সহসভাপতি আবদুল কাদের বলেন, ‘আমাদের চামড়া বেচাকেনা ঢাকানির্ভর। এবার আমরা ব্যবসায়ী কম। তারপরও সব চামড়া সংগ্রহ করার প্রস্তুতি রয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলব, চামড়া কেনার ক্ষেত্রে তাঁরা যেন হিসাব-নিকাশ করে কেনেন।’