উন্মুক্ত খাল–নালা, ঝুঁকি নিয়ে চলেন হাজারো মানুষ
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের নতুন চান্দগাঁও থানার মোড়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষের চলাচল। মোড়ের এক পাশে উন্মুক্ত নালা। নেই কোনো স্ল্যাব। ভারী বৃষ্টিতে নালা আর সড়ক পানিতে একাকার হয়ে যায়। তখন সড়ক-নালা কোনোটিই আলাদা করার সুযোগ থাকে না। ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় নগরবাসীকে।
চট্টগ্রাম নগরের উন্মুক্ত নালা-খালে পড়ে শিশুসহ অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয় ২০২১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ পা পিছলে মুরাদপুরের চশমা খালে পড়ে তলিয়ে যান। ওই ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। তাঁকে এখনো পাওয়া যায়নি। এরপরও নগরের বেশ কিছু এলাকার নালা উন্মুক্ত থেকে গেছে। আবার খালের পাশেও বসেনি নিরাপত্তাবেষ্টনী।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লালখান বাজার সড়কের এক পাশে নালার খোলা অংশের মুখে থাকা রডে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী নামের এক তরুণ। এরপর তিনি ভারসাম্য রাখতে না পেরে ছিটকে নালায় গিয়ে পড়েন। গুরুতর আহত অবস্থায় ইমরুল চট্টগ্রামের বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ইমরুলের পরিবার জানিয়েছে, রড তাঁর পেটে ঢুকে গেছে। ভেঙেছে পাঁজরের দুটি হাড়। কিডনির কিছু অংশেও ক্ষত হয়েছে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার লালখান বাজার সড়কের এক পাশে নালার খোলা অংশের মুখে থাকা রডে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী নামের এক তরুণ। এরপর তিনি ভারসাম্য রাখতে না পেরে ছিটকে নালায় গিয়ে পড়েন। রড তাঁর পেটে ঢুকে গেছে। ভেঙেছে পাঁজরের দুটি হাড়। কিডনির কিছু অংশেও ক্ষত হয়েছে।
ইমরুল আহত হওয়ার পর গতকাল শনিবার সকালে উন্মুক্ত নালার বিভিন্ন অংশে ঢাকনা দেওয়া হয়েছে। দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নালা সম্প্রসারণের নির্মাণকাজ চলছে সেপ্টেম্বর থেকে। কাজ প্রায় শেষের দিকে বলে নিরাপত্তার জন্য থাকা টিন খুলে ফেলেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যাংকন গ্রুপ। তবে রড বসানো নালার কিছু অংশ উন্মুক্ত ছিল।
শ্রমিক মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসাইন বলেন, শুক্রবারও কিছু কিছু অংশে ঢাকনা ছিল না। শনিবার সকালে বসানো হয়েছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে থানা মোড়ের সড়ক ধরে হাঁটছিলেন মোহাম্মদ ইসলাম মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নগরের বিভিন্ন সড়কের নালা উন্মুক্ত। ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। পথচারীর মৃত্যু হলেও কারও টনক নড়ে না।
তদারকি সংস্থাগুলো মানুষের জীবনকে গুরুত্বহীন ভাবছে। এ কারণে নজরদারি ও তদারকি দেখা যাচ্ছে না। নির্মাণকাজ হলে নিরাপত্তাবিধি শতভাগ মানা হয় না। আগের ঘটনাগুলোর কারণে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমনটা শোনা যায়নি।দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাবেক জাতীয় পর্ষদ সদস্য
অরক্ষিত খাল-নালায় ঝুঁকি
গতকাল নগরের মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, মেহেদিবাগ, চটেশ্বরী মোড়, ২ নম্বর গেট, রহমান নগর, মেয়র গলি, আলফালাহ গলি ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার নালার বেশির ভাগ অংশে এখনো স্ল্যাব বসানো হয়নি। খালে নেই নিরাপত্তাবেষ্টনী।
বহদ্দারহাটে নালার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন খলিলুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাল-নালায় তলিয়ে মানুষ মারা যায়, আহত হয়। রাস্তার কোথাও নিরাপত্তা নেই। পথ চলতে হয় ভয় নিয়ে।’
এর আগে ২০২১ সালের ৩০ জুন মেয়রগলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। ২৫ আগস্ট নগরের মুরাদপুরে চশমা খালে পা পিছলে পড়ে তলিয়ে যান সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ। ৬ ডিসেম্বর একই খালে তলিয়ে যায় শিশু মো. কামাল উদ্দিন। তিন দিন পর নগরের মির্জা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনাস্থল থেকে শুরু করে খালটির বিভিন্ন স্থানে এখনো নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া হয়নি।
এ ছাড়া ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় ফুটপাত থেকে পা পিছলে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার। তাঁর মৃত্যুর পর নালার ওই অংশে স্ল্যাব বসানো হয়েছে।
দায় কার
উন্মুক্ত নালা-খালে পড়ে একাধিক মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)—কেউ এসবের দায় নেয়নি। লোকজনের মৃত্যুর জন্য উল্টো পরস্পরকে দায়ী করে আসছে সংস্থা দুটি। তাদের ভূমিকায় নগরবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এমন মৃত্যুর জন্য দুটি সংস্থার গাফিলতিকে দায়ী করা হয়েছে।
সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, পথচারীদের নিরাপদে চলাচল করার জন্য গত তিন বছরে প্রায় ৩০ হাজার বর্গফুট স্ল্যাব মেরামত ও নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ খালের পাড়ে ১৭ থেকে ১৮ হাজার বর্গফুট রক্ষাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এখনো ৪১টি ওয়ার্ডের নালা-নর্দমায় অন্তত ৩ হাজার মরণফাঁদ রয়েছে। আর পথচারীদের চলাচল নিরাপদ করতে খালের পাড়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী দরকার প্রায় ২০ হাজার মিটার। তালিকা তৈরি হলেও এখন পর্যন্ত নালা-নর্দমা ও খালের পাড় ঝুঁকিমুক্ত করার কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন।
জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, স্ল্যাব মেরামত ও নির্মাণ ধারাবাহিকভাবে করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানের খালেও বেষ্টনী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী বর্ষার আগেই গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর নালায় স্ল্যাব নির্মাণ শেষ হবে।
মানুষের প্রাণ যাওয়ার পরও খাল-নালা ঝুঁকিমুক্ত না হওয়ায় সিডিএ ও সিটি করপোরেশনের গাফিলতিকে দায়ী করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাবেক জাতীয় পর্ষদ সদস্য ও প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তদারকি সংস্থাগুলো মানুষের জীবনকে গুরুত্বহীন ভাবছে। এ কারণে নজরদারি ও তদারকি দেখা যাচ্ছে না। নির্মাণকাজ হলে নিরাপত্তাবিধি শতভাগ মানা হয় না। আগের ঘটনাগুলোর কারণে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—এমনটা শোনা যায়নি।