বাংলাদেশের দুগ্ধশিল্পে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি
বাংলাদেশ এখন দুগ্ধশিল্পে বেশ উন্নত ও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। একসময় ক্ষুদ্র কৃষক ও খামারিদের একটি অসংগঠিত খাত এখন ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে কাঠামোবদ্ধ খাত হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের দুগ্ধ খাত গ্রামীণ জীবিকার অন্যতম ভিত্তি এখনো। দেশের মোট দুধ উৎপাদনের ৮০ শতাংশের বেশি আসে ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছ থেকে, যাঁরা সাধারণত এক থেকে তিনটি গরুর মালিক। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ দুধ উৎপাদনে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দুধ উৎপাদন ১ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছায়, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও বেড়ে আনুমানিক ১ কোটি ৩০ লাখ ৭ হাজার টনে পৌঁছেছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ডেইরি বাজারের আকার প্রায় ২৪৭ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতিবছর এই খাত ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিবছর অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও পোল্যান্ড থেকে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি করা হচ্ছে।
বার্ষিক প্রায় ২১ লাখ টনের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে। এই ব্যবধান পূরণের জন্য আমদানি করা হচ্ছে দুধ।
বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে মাথাপিছু দুধের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দৈনিক প্রায় ২৫০ মিলিলিটার দুধ পানের কথা বলে। যা প্রতিবছর প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির হিসাবে ৯১ দশমিক ২৫ লিটার। বাংলাদেশে গড় মাথাপিছু বার্ষিক দুধ পান হচ্ছে ২০২৪ সালের হিসাবে প্রায় ২৮ দশমিক ৫ লিটার। বাংলাদেশিরা পুষ্টিস্তরের চেয়ে অনেক কম দুগ্ধ পান করে। গুঁড়া ও তরল দুধের বাইরে দই, আইসক্রিম, পনির, মাখন ও মিষ্টির মতো দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার ক্রমবর্ধমান বিকাশমান। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ আনুমানিক ৩০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি করেছে। পরিসংখ্যান সাইট স্ট্যাস্টিটায় দেখা যায়, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের দুধের বাজার থেকে আয় হবে ৫৯৮ কোটি মার্কিন ডলার। দেশের বাজার বার্ষিক ৯ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধির গতিতে রয়েছে। [সূত্র: স্ট্যাস্টিটা ডটকম ও আইডিএলসি]।
ইউএন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইউএনআইডিও) হিসাবে, বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ৪৭ লাখ গরু, ১ কোটি ৫০ লাখ মহিষ ও ২ কোটি ৬৭ লাখ ছাগল রয়েছে। সাধারণত ধারণা করা হয়, প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও ৫০ শতাংশ মানুষ পরোক্ষভাবে এই খাতে নিযুক্ত। বাংলাদেশে দুধ উৎপাদিত হচ্ছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৭ হাজার টন। মাথাপিছু সরবরাহ প্রতিদিন ২২১ দশমিক ৮৯ মিলিলিটার, যদিও লক্ষ্যমাত্রা ২৫০ মিলিলিটারের কাছাকাছি। ৮৭ লাখ ২০ হাজার দুধ দোহন–উপযোগী গাভির মধ্যে ৪৬ লাখ ২০ হাজার (৫৩ শতাংশ) দেশীয় জাতের ও ৪০ লাখ ৪০ হাজার (৪৭ শতাংশ) সংকর জাতের গবাদিপশু। সংকর জাতের বেশির ভাগই হলস্টাইন ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল ও সিন্ধি জাতের। বাংলাদেশে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে ১ কোটি ৩০ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন করে। ঘাটতি প্রায় ১৬ শতাংশ। ইউএন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের বাজারে মিল্কভিটা (৪০ শতাংশ), প্রাণ (২৪ শতাংশ), আড়ং (২৪ শতাংশ) বাজার দখল করে রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২৩-২৪ সময়ে দুধ ও ক্রিমজাত পণ্যের জন্য আমদানিতে ৩ কোটি ৯৫ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়। বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে তরল দুধ উৎপাদনের তুলনায় গুঁড়া দুধ আমদানি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। ২০১৮ সালে আমদানি করা গুঁড়া দুধ ছিল প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন, যা তরল দুধ উৎপাদনের চেয়ে ১১ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি তিন ধরনের দুধের গুঁড়া আমদানি করে। হোল মিল্ক পাউডার, স্কিমড মিল্ক পাউডার ও ফিল্ড মিল্ক পাউডার আমদানি করে। আরলার হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশ ৭৬ হাজার টন হোল মিল্ক, ৩৪ হাজার টন স্কিমড মিল্ক ও ১৯ হাজার টন ফিল্ড মিল্ক আমদানি করেছে। এই আমদানি নিয়মিত হারে বাড়ছে। [সূত্র: আইডিডিপি ডটগভ ডটবিডি ও বাংলাদেশ ব্যাংক]
স্প্যানিশ কোম্পানি কান্ডার ওয়ার্ল্ড প্যানেলের ২০১৮ ব্র্যান্ড ফুটপ্রিন্ট প্রতিবেদন অনুসারে দেশের দুধের বাজারে সেরা ব্র্যান্ড মার্কস। এটি কেনা হয় প্রায় ২১ শতাংশ পরিবারে। এ ছাড়া এ খাতের সেরা পাঁচে আছে ডিপ্লোমা, ফ্রেশ, ডানো ডেইলি পুষ্টি ও মিল্ক ভিটা। বাংলাদেশের গুঁড়া দুধের বাজারে দেশীয় উৎপাদকদের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। [সূত্র: প্রথম আলো]
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ১৪ লাখ দুগ্ধ খামার রয়েছে, যাদের গড়ে ১-৩টি গরুর পাল রয়েছে। আইএফসিএন অনুসারে, বাংলাদেশ দুধ উৎপাদন ও দুগ্ধ শিল্পে ৯১ শতাংশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত ১০ বছরে দুধ উৎপাদন ১৮ শতাংশ বেড়েছে ও দুধের ব্যবহার ১৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালের হিসাবে বাংলাদেশ শীর্ষ ২০টি দুধ উৎপাদক দেশের একটি। প্রায় ২ দশমিক ৪৫ কোটি গবাদিপশুর সহায়তায় কনডেন্সড মিল্ক ও ক্রিমের মতো বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন দুধ প্রক্রিয়াজাত করা হয় পাস্তুরিত দুধ, দই, পনির এবং গুঁড়া দুধের মতো বিভিন্ন পণ্য তৈরির জন্য। দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন পনির তৈরি হচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন গুঁড়া দুধ উৎপাদন করা হচ্ছে। [সূত্র: টেট্রাপ্যাক]
বাংলাদেশে গুঁড়া দুধের বাজার ও মার্কস
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আবুল খায়ের গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরেই পাউডার মিল্ক আমদানি ও বিক্রি করছে। মার্কস, আমা, স্টারশিপ ও অরা—চারটি ব্র্যান্ডের গুঁড়া দুধ বা মিল্ক পাউডারের মাধ্যমে ভোক্তাদের চাহিদা মিটিয়ে আসছে গ্রুপটি। ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করে মার্কস ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার গুণগত মান বজায় রেখে প্রিমিয়াম মিল্ক ক্যাটাগরিতে অর্জন করেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের আস্থা। ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, মিনারেল, প্রোটিনসহ সব প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ মার্কস ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার আমদানি করা হয় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে। পূর্ণ ননিযুক্ত গুঁড়া দুধ হওয়ায় মার্কস ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, বিশেষ করে সেরা স্বাদের ডেজার্ট তৈরিতে অনন্য। ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার ছাড়াও মার্কসের সম্ভারে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ক্রেতাদের পুষ্টির চাহিদা উপযোগী বিশেষ মিল্ক পাউডার। স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের জন্য রয়েছে পরিপূর্ণ পুষ্টির আদর্শ দুধ মার্কস অ্যাক্টিভ স্কুল এবং অ্যাক্টিভ স্কুল টু-ইন-ওয়ান। ১৬ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের জন্য বায়োটিন ও ক্যারোটিনসমৃদ্ধ মার্কস ইয়াং স্টার। আছে হাই প্রোটিন নন–ফ্যাট মিল্ক মার্কস ডায়েট, যা ওজন নিয়ন্ত্রণ ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। আরও আছে হাড়ক্ষয় রোধে সহায়ক হাই ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি–সমৃদ্ধ নন–ফ্যাট মিল্ক পাউডার মার্কস গোল্ড। এ ছাড়া আছে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক লো জি-আই ফর্মুলার মার্কস ডায়াবেটিক ডায়েট।