সময়ের মুখ

নারীর শঙ্কামুক্তির খবরে পুরো ট্রেনে স্বস্তি ফিরে আসে

আমিরুল হক

ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলেন সন্তানসম্ভবা এক নারী। হঠাৎ তাঁর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তাঁর স্বামী তখন দিশাহারা। খবর পৌঁছে যায় ট্রেনের টিকিট পরীক্ষকের (টিটিই) কানে। তিনি ট্রেনের মাইকে দ্রুত জানতে চান, ট্রেনে কোনো চিকিৎসক ও নার্স রয়েছেন কি না। অন্য কামরায় থাকা এক চিকিৎসক ও নার্সরা ছুটে আসেন। ট্রেনেই নারীর মৃত সন্তান প্রসব হয়। বেঁচে যান তিনি। ঢাকা থেকে নীলফামারীর চিলাহাটিগামী আন্তনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে ৩ সেপ্টেম্বর রাতে এ ঘটনা ঘটে। সেদিন রাতে ট্রেনটিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেলওয়ের পার্বতীপুর হেডকোয়ার্টারের টিটিই আমিরুল হক (৪১)। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সরোয়ার মোর্শেদ

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নারী অসুস্থ, আপনি কীভাবে জানলেন?

আমিরুল হক: হঠাৎ শাহীন আলম নামের এক যাত্রী দৌড়ে এসে বললেন, ‘ঘ’ বগিতে এক নারী খুব অসুস্থ। তিনি অন্তঃসত্ত্বা, রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: তারপর কী করলেন?

আমিরুল হক: ট্রেনে কোনো চিকিৎসক আছেন কি না, জানার জন্য গার্ডকে (প্রহরী) মাইকে ঘোষণা দিতে বললাম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: চিকিৎসক তো এলেন।

আমিরুল হক: হ্যাঁ। প্রথমে ট্রেনের ‘জ’ বগি থেকে ঢাকার ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক মো. সানাউল্লাহ ছুটে আসেন। এরপর ‘চ’ বগি থেকে আসেন রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থী আফসানা ইসলাম। একই সঙ্গে কয়েকজন নার্স আসেন। তাঁরা ছোটাছুটি করে ‘ঘ’ বগি কোন দিকে জানতে চান।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ‘ঘ’ বগিতে গিয়ে কী দেখলেন?

আমিরুল হক: বগিভর্তি অনেক যাত্রী। নারী যাত্রীরা অসুস্থ ওই নারীকে কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখার চেষ্টা করছিলেন। চিকিৎসকের নির্দেশনায় আফসানা ও নার্সরা কাজ শুরু করেন। চিকিৎসক ওই নারীকে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর তাঁরা নিজেরাই মৃত বাচ্চাটি প্রসবের চেষ্টা শুরু করেন। ট্রেনে থাকা অন্য নারীরাও সহযোগিতার হাত বাড়ান। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট চেষ্টার পর ওই নারী মৃত বাচ্চা প্রসব করেন। এরপর চিকিৎসক সানাউল্লাহ সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, রোগী এখন অনেকটা আশঙ্কামুক্ত। পুরো ট্রেনে তখন স্বস্তি ফিরে আসে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: চিকিৎসক খোঁজার বিষয়ে কি আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে?

আমিরুল হক: রেলওয়ের প্রশিক্ষণে এগুলো শেখানো হয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নারী যখন বেঁচে গেলেন, তখন কেমন লেগেছে?

আমিরুল হক: শুধু আমি নই, নারীকে নিয়ে পুরো ট্রেনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। চিকিৎসক যখন আশ্বস্ত করলেন ওই নারী ভালো আছেন, তখন পুরো ট্রেনেই স্বস্তি ফিরে এসেছিল।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এমন কোনো ঘটনা আগে কি ঘটেছে?

আমিরুল হক: ২০১৭ সালের এক রাতে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে এক নারী অসুস্থ হন। তাঁর পেটে যমজ বাচ্চা ছিল। হঠাৎ প্রসববেদনা ওঠে। ট্রেনে থাকা নারীরা তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ট্রেনেই ওই নারী যমজ দুই পুত্রসন্তান প্রসব করেন। যাত্রীরা তাঁদের নাম রাখেন নীল ও সাগর। ৮ সেপ্টেম্বর রাতে ট্রেনে ছোড়া ঢিলে এক যাত্রীর কপাল কেটে যায়। সেদিও ডা. সানাউল্লাহ গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। তিনি ওই যাত্রীর চিকিৎসা দেন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঢিল ছোড়ার ঘটনা তো প্রায়ই ঘটে।

আমিরুল হক: এটা নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ওই নারী কেমন আছেন, খোঁজ নিয়েছেন?

আমিরুল হক: হ্যাঁ, খোঁজ নিয়েছি। তিনি ভালো আছেন। শুনে আমার ভালো লেগেছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঘটনাটি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

আমিরুল হক: তারপর তো শুধু ফোন আর ফোন। সাংবাদিকেরা তো ফোন দিয়েছেই, পরিচিত অনেকেই ফোন করেছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও ধন্যবাদ দিয়েছে।