শুরুটা মাজুনি দিয়ে, নারীদের হাতে গড়া ‘বাই রোজী’র পণ্য যাচ্ছে এখন ইউরোপে
বিড়ালের বিছানা, কুকুরের খেলনা, নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বানানো বাবুই পাখির বাসা, চটি জুতা, কাপড়ের চুলের ক্রাঞ্চি, টোট ব্যাগ—এসব তৈরি হচ্ছে বাগেরহাটে; যাচ্ছে গ্রিস, জার্মান ও বেলজিয়ামে। পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে এই পণ্যগুলো তৈরি করছেন স্বল্প শিক্ষিত, তালাকপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন বয়সী প্রায় ৮০ জন নারী।
নারীদের এই কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন রোজী আহমেদ। তিনি ‘অর্গানিক প্রোডাক্টস বাই রোজী’র কর্ণধার। গত বছর এসএমই নারী উদ্যোক্তা মেলায় পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তা সম্মাননা। ২০২২ সাল থেকে তিনি বিদেশে পণ্য রপ্তানি করছেন। তাঁর কারখানায় তৈরি পণ্য জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াতেও যাচ্ছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটের বাসাবাটি এলাকায় রোজী আহমেদের বাসায় বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। প্রথম আলোর বাগেরহাট প্রতিনিধি সরদার ইনজামামুল হকও সঙ্গে ছিলেন। দেখা গেল, রোজী আহমেদের সাদা রঙের মূল বাড়িটিই কারখানায় রূপ পেয়েছে। নিচতলায় অফিস এবং নারীরা কাজ করছেন, দোতলার তাঁর ড্রয়িংরুমেও শিশুদের কাঠের টুলে রং করাসহ চলছে নানান কাজ। এই ভবনের পাশেই পুরোনো একতলা ভবনে মূল কারখানা। এই ভবনের পাশে কাজের প্রয়োজনেই নতুন লম্বাটে ঘরও তুলতে হয়েছে। বাড়ি ঘুরে দেখা গেল, তিনটি শাখায় নারীরা যে যাঁর মতো কাজে ব্যস্ত।
কোভিড মহামারির সময় ২০২০ সালে পুরোদমে কাজ শুরু করেছিলেন রোজী আহমেদ। ব্যবসা এখন বেড়েছে। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লাভ থাকে বলে জানালেন রোজী আহমেদ। কারখানা ঘুরে দেখার সময় ‘রুবিনা’ ও ‘এলিনি’র গল্প বললেন তিনি। ৭০ হাজার জোড়া ‘রুবিনা’ আর ‘এলিনি’ গ্রিসে যাচ্ছে। এগুলো স্লিপারের নাম। হোটেল, রেস্টুরেন্টে এগুলো ব্যবহার করা হয়। ১১ হাজার জোড়া এলিনি আর রুবিনা গ্রিসে পৌঁছে গেছে। বাকিগুলো তৈরির কাজ চলছে। তাই এই শাখায় নারীদের ব্যস্ততা একটু বেশি।
বাগেরহাট শহরের কাছেই কোনডোলা গ্রামের মেয়ে রোজী। এইচএসসি পর্যন্ত পড়ার পর পারিবারিকভাবেই মোজাহিদ আহমেদের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। এরপর সন্তানের জন্ম, সংসার সামলে আর পড়াশোনা হয়নি। কোনো চাকরি করাও হয়নি।
ব্যবসায় রোজীর আসাটা ছিল শখের বসে, অনলাইনে একটি পেজ খুলেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘অর্গানিক প্রোডাক্টস’। বাড়ির ছাদে বসে নিজের হাতেই নারকেলের মালা দিয়ে ফুলের টব বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি করতেন। তবে তাতে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।
উদ্যোক্তা হিসেবে কাজের শুরু প্রসঙ্গে রোজী আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময় মিল–কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর বাসায় কাজের সাহায্যকারী যিনি ছিলেন, তাঁকেও এ সময়ে কাজে আসতে না করতে হয়েছিল। বেকার হয়ে যাওয়া এই নারীদের জন্য কিছু করা যায় কি না, সে চিন্তা থেকেই মূলত উদ্যোগের শুরু।
রোজীর ভাশুর মোস্তাফিজ আহমেদ ও স্বামীর আগে থেকেই পারিবারিক ব্যবসা ছিল। সেখানে তাঁরা নারকেলের ছোবড়া বা আঁশ এবং কাঠ দিয়ে কাজ করেন। তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম ন্যাচারাল ফাইবারস।
রোজী বলেন, তাঁর ভাশুর ও স্বামী ২০০২ সাল থেকে নারকেলের আঁশের পণ্য ও কাঠ দিয়ে বাড়ি বানাচ্ছেন। এগুলো দেশের বাইরে রপ্তানি করছেন। কাঠের বাড়ি বানানোর সময় টুকরা বা ছোট ছোট কাঠ বেঁচে যায়। এই কাঁচামাল দিয়েই নতুন বা অন্য রকম কিছু বানানো যায় কি না, তার জন্য গুগল, ইউটিউবের সাহায্য নেন তিনি।
প্রথমে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে থালাবাসন পরিষ্কারের মাজুনি বানানোর মধ্য দিয়েই কাজ শুরু হয়। বেঁচে যাওয়া কাট দিয়ে পরে বিড়ালের খাট, দোলনা, শিশুদের টুলসহ বিভিন্ন পণ্যের কাঠামোগুলো কর্মীদের দিয়ে বানিয়ে দেন ভাশুর ও স্বামী। তারপর সেই কাঠামো ধরে পণ্য ডেলিভারি পর্যন্ত অন্যান্য সব কাজ করেন নারীরা।
রোজী জানান, শুরুতে দেশের বাজারে মাজুনির মোটামুটি ভালোই সাড়া পাওয়া যায়। ১৫-১৬ জন নারীকে নিয়ে বাড়ির নিচতলায় কাজ শুরু হয়। কাজ শুরুর পর একটি এনজিও পাখির বাসা বানিয়ে দেওয়ার অর্ডার দেয়। রোজী একটি নমুনা বানিয়ে দেখালে ওই এনজিও তা খুব পছন্দ করে। তারপর এক হাজার পাখির বাসার একটি অর্ডার দেয়। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রোজীকে। বর্তমানে ১২ থেকে ১৩টি মডেলের বাবুই পাখির বাসা বানাচ্ছেন রোজীর প্রতিষ্ঠানের নারী কর্মীরা।
উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা পেলেন কোথা থেকে—এ প্রশ্নের উত্তরে রোজী আহমেদ বললেন, কাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন স্বামীর কাছ থেকে। অনলাইনে পেজ খুলে ব্যবসা শুরুর পর স্বামী তাতে আগ্রহ দেখান। পাখির বাসা বানানোর অর্ডার দেওয়া ওই এনজিও থেকে অগ্রিম ৩০ হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছিল, তা দিয়েই মূলত কাজটি শুরু করেন রোজী।
পারিবারিক ব্যবসা থাকায় রোজীকে বলতে গেলে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি, যা অন্য নারী উদ্যোক্তাদের পোহাতে হয়। পণ্য বানানোর নানান উপকরণ পান পারিবারিক ব্যবসা থেকে। তবে তা দাম দিয়েই কিনে নিচ্ছেন রোজী তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য।
বিড়ালের কাঠের ঘর, বিছানা, দোলনা, বিড়াল বহনের জন্য ব্যাগ, খামচানোর জন্য স্ট্রেচিং বোর্ড, পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের কদর বাড়ছে বলে জানালেন রোজী। পুরুষ ও নারী বিড়ালের জন্য কাপল বা যুগল পোশাক তৈরি, ডাইনিং টেবিল, ক্যাট ট্রি বা বিড়ালের গাছসহ নানান পণ্য তৈরির পরিকল্পনার কথাও তিনি জানান।
নারীরা দাঁড়াচ্ছেন নিজের পায়ে
ব্যবসাটা বাড়ানো গেলে অনেক নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে—এ চিন্তা থেকেই ব্যবসার পরিসর বাড়ানোর চিন্তা করছেন রোজী আহমেদ। বললেন, ‘অনেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি আমার এখানে কাজ করছে। অনেকের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। তাঁরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমি সময়মতো বেতন দেওয়ার চেষ্টা করি। বেতন পাওয়ার পর এই নারীদের মুখে যে হাসি দেখি, তা দেখতে খুব ভালো লাগে।’
এ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পারভীন আক্তার। তিনি জানালেন, স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর মা–বাবার সঙ্গেই থাকছেন। নিজের আয় দিয়ে নিজের খরচ মেটানোর পাশাপাশি মা–বাবার দেখভাল করতে পারছেন।
নারীরা বাড়িতে থাকেন, কোনো কাজ করেন না—এ ট্যাবুটা ভাঙতে চান রোজী আহমেদ। কারখানায় কাজে আসার আগে নারীরা নিজেদের সংসারের কাজ সেরে আসার সুযোগ পাচ্ছেন। যে নারীরা সন্তান বাড়িতে রেখে আসতে পারছেন না বা স্কুল থেকে ফেরার পর তাঁকে দেখার মতো কেউ নেই, সেই মা সন্তান নিয়েই কাজে আসেন। অনেকে মায়ের সঙ্গে এখানে আসার পর এখান থেকেই স্কুলেও যায়।
পূর্ণিমা সাহা চার বছর ধরে কাজ করছেন। মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। জানালেন, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসেন, এ নিয়ে কখনোই আপত্তি করেননি রোজী আহমেদ। রোজীর বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দেখা গেল, পূর্ণিমা সাহার মেয়ে আরেক শিশুর সঙ্গে রোজীর ব্যালকনিতে পাতা দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে।
অন্য মায়েরাও জানালেন, বাড়ির ভেতরেই খেলার জন্য অনেক জায়গা আছে। গেটে দারোয়ান থাকেন বলে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হয় না। নিশ্চিন্ত মনে কাজ শেষ করে সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁরা। এই নারীদের অনেকেই কতগুলো পণ্য তৈরি করলেন, সে হিসাবে মজুরি পান।
রোজী আহমেদের এক ছেলে মুকিত বিন মুজাহিদ ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ভাশুরের এক ছেলে প্রকৌশলী এবং মেয়ে ঢাকায় পড়াশোনা করছেন। রোজী আহমেদ বারবার বলছিলেন, তাঁদের তিন সন্তান। পরে আলাপে জানা গেল, ভাশুরের ছেলে ও মেয়েকেও নিজের সন্তান হিসেবেই মনে করেন। বাগেরহাটের বাড়িতে ভাশুর ও জা—সবাই একসঙ্গেই থাকেন। ভাশুরের ছেলের বউ রায়হানাতুল জান্নাতও নিজেকে রোজী আহমেদের ছেলের বউ হিসেবেই পরিচয় দিলেন। পরে অবশ্য হেসে বললেন, রোজী আহমেদ তাঁর চাচিশাশুড়ি হন।
রায়হানাতুল জান্নাতও পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসার হাল ধরতে রোজী আহমেদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন পণ্যে নকশা করা, জুতা এবং পেমেন্ট সেকশনের দেখভাল করেন।
অনেকেই দেখতে আসেন রোজীকে
কথা বলার একপর্যায়ে হাসতে হাসতে রোজী আহমেদ বললেন, অনেকেই তাঁকে দেখতে আসেন, নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে বলে কাজের প্রশংসাও করেন। এ ছাড়া এখানে কাজ করার কথা বললে নারীদের পরিবার থেকেও আপত্তি করা হয় না।
উদ্যোক্তা এবং উদ্যোক্তা হওয়ার আগের জীবন প্রসঙ্গে রোজী আহমেদ অকপটে বললেন, ‘যখন কাজ করতাম না, তখন ছোটখাটো মানে যা–ই কিনতে চাইতাম, তা আমার স্বামীর কাছে চাইতে হতো। অনেক সময় হাজব্যান্ড বলতেন, এত কেন লাগবে বা পরে কিনে দেব। এখন আমি নিজে ইনকাম করছি। নিজের পছন্দমতো কেনাকাটা করছি, পরিবারের অন্যদের জন্য যা কিনতে ইচ্ছে করছে কিনছি। এ বিষয়টা আমার খুব ভালো লাগে। এখন আমি অনেক ভালো আছি।’
নিজের আয়ের টাকা নিজেই খরচ করতে পারছেন, না স্বামীর হাতে তুলে দিতে হচ্ছে—এ প্রশ্নে আবারও হাসি দিয়ে রোজী আহমেদ বললেন, ‘মাঝে মাঝে স্বামীর টাকার প্রয়োজন হলে আমার কাছ থেকে নেন, তা হিসাব–নিকাশের মধ্যেই থাকে।’