বঙ্গবন্ধু, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাংলাদেশ দর্শন

মুজিব বর্ষ উপলক্ষে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহযোগিতায় ‘বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ বক্তৃতা’র আয়োজন করে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের (এলএসই) সাউথ এশিয়া সেন্টার। সেখানে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড ভিশনস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনলাইনে একটি বক্তৃতা দেন। বক্তৃতাটির অডিও ও এলএসইর ব্লগে প্রকাশিত লিখিত রূপ থেকে অনুবাদ করেছেন জামিল বিন সিদ্দিক।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: জহিরুল হক

সাদা বাংলায় বঙ্গবন্ধু মানে বাংলার বন্ধু। শেখ মুজিবুর রহমান অবশ্যই তার চেয়েও বেশি কিছু; তিনি অতুলনীয়। তিনি বাংলাদেশের মহান রাজনৈতিক নায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশ ধারণার রূপকার, বাংলাদেশিদের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক, বাংলার সবচেয়ে নন্দিত মানুষ। আর বারবারই যেটা বলা হয়ে থাকে, যথার্থই তিনি ‘জাতির পিতা’।

মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বা বাংলার বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করাটা আসলে খুব কম বলা। এর চেয়ে বড় কোনো পদবি যে তিনি চাননি, শুধু বন্ধুত্বেই খুশি ছিলেন, সেটা তাঁর বিষয়ে সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আমাদের বলে—তিনি নামের কাঙাল ছিলেন না, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষ তাঁকে ভালোবাসত।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করার সুযোগ পেয়ে আমি রোমাঞ্চিত। অতি চমৎকার একজন মানুষ আর মহান এক নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি আজকের দুনিয়াতেও তাঁর ভাবনাচিন্তা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে দু-একটা কথা আমি বলতে চাই।

মুজিব আজও ভীষণ প্রাসঙ্গিক
আমাদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁর স্বচ্ছ দূরদর্শিতা কেউ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আমাদের জীবনকে পরিচালিত করার পথে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে এই দূরদর্শিতা। আদর্শগত বিভ্রান্তির শিকার হয়ে ভারতসহ উপমহাদেশ এখন কঠিন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দিশা ও প্রেরণার জন্য বঙ্গবন্ধুর সাহায্যপ্রার্থী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আমাদের আছে। সুনির্দিষ্ট অনেক দিক থেকেই শেখ মুজিবের চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণ আজও ভীষণ প্রাসঙ্গিক। সেগুলোর অল্প কয়েকটার সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা করা যাক।

প্রথমত, ধর্মনিরপেক্ষতার নির্ভেজালতম সমর্থকদের একজন শেখ মুজিব। সব দেশেরই এ থেকে শেখার আছে। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ ভারতও এর মধ্যে আছে। বিশেষ করে ভারতেরই এখন বঙ্গবন্ধুর অন্তর্দৃষ্টি থেকে শিক্ষা নেওয়া খুবই জরুরি। তবে আরও বিস্তৃতভাবে দেখলে উপমহাদেশের সব দেশেরই বঙ্গবন্ধুর ধারণাগুলোর দরকার আছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে ৫০ বছরে বাংলাদেশও অনেক উত্থান–পতনের ভেতর দিয়ে গেছে। তবে কী ধরনের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু চাইতেন, এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট করেই তিনি যেহেতু বলে গেছেন, তাই ধর্মনিরপেক্ষতার কোন ধরনটা তিনি পছন্দ করতেন, খুব সহজেই আমরা সেটা তাঁর ব্যাখ্যা থেকে জেনে নিতে পারি।

জোর দিয়ে এখানে আমি বলতে চাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আর মানবস্বাধীনতার মধ্যে যে যোগ, তার একটি অনুপ্রেরণাদায়ী ভূমিকা শেখ মুজিবের কাছে ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার একটা রীতি হচ্ছে ধর্মের প্রতি নির্বিশেষ বৈরিতা পোষণ। ইউরোপে এই রীতি বেশ চালু আছে। এ ধারায় ধর্মনিরপেক্ষ একটা রাষ্ট্র কখনো কোনো ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত বা সাহায্য করবে না।

এ ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র মাঝেমধ্যে করেছে। তবে বেশির ভাগ মার্কিনের মনেই ঈশ্বর ও খ্রিষ্টধর্ম এতটাই পোক্ত আসন গেড়ে আছে যে এ ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্তরাষ্ট্রে খুব একটা সুফল বয়ে আনতে পারেনি।

এ তুলনায় ফরাসিরা বরং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে ভালো করেছে এই অর্থে, যেকোনো রকমের ধর্মীয় আচার থেকে রাষ্ট্রকে তারা দূরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু ধর্মবর্জিত নির্ভেজাল ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষ্য থেকে তারা দূরেই রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য স্পষ্ট, ধর্মনিরপেক্ষতার মানে এই নয় যে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে না। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বাধীনতা, ধর্মভীরু মানুষ এটিকে মূল্যবান মনে করে।

এসব কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মবিরোধী হিসেবে দেখার যে চিন্তাধারা, সেটিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি শেখ মুজিব। ‘ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া’র জন্য ধর্মাচার পরিহার বা ধর্মীয় স্বাধীনতা বর্জন করার কোনো কারণও তিনি খুঁজে পাননি।

১৯৭২ সালের নভেম্বরে ঢাকায় সংসদে যখন ধর্মনিরপেক্ষ নবীন গণতন্ত্রের সংবিধান গ্রহণ করা হলো, তখন ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবান আদর্শের খোঁজে তিনি আসলে ঠিক কী চাইছেন, এ বিষয়ে শেখ মুজিব যা বলেছিলেন, তার থেকে, সত্যি বলতে কি খসড়া সংবিধান থেকে, উদ্ধৃত করছি, ‘আমরা ধর্মকে বন্ধ করব না...মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে...হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে...বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে...খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে...আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে; আর বর্জন করতে বলা হয়েছে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং অতি অবশ্যই ধর্মের নামে রাজনৈতিক শোষণ। দেখতেই পাচ্ছি, এটি একধরনের স্বাধীনতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। রাষ্ট্রকে বলা হচ্ছে লোকের নিজ নিজ ধর্মাচরণ পালনে হস্তক্ষেপ না করতে।

বস্তুত, আমাদের আরও একধাপ এগোনো উচিত। নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী ধর্মাচার পালনের স্বাধীনতা উপভোগে মানুষকে সাহায্য করা উচিত। কারও ধর্ম পালনে কেউ যাতে কোনো হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে জন্য যা যা করণীয়, সব আমাদের করা উচিত। অন্যদের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র।

দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলতে হচ্ছে, ভারতে অধুনা এই নীতিগুলো খুব মার খাচ্ছে। ধর্মভেদে প্রায়ই অসম আচরণ করা হচ্ছে। হিন্দুত্বের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট কেন্দ্রীয় সরকার পছন্দের ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, এমনকি নাগরিকত্ব পর্যন্ত দিচ্ছে।

ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য নানা ধর্মীয় বিষয় নিষিদ্ধ করেছে। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের—বিশেষত আচারনিষ্ঠ হিন্দুদের অনুমোদন নেই, এমন অজুহাতে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে অন্য একটি সম্প্রদায়ের (যেমন মুসলমান) বিশেষ বিশেষ খাদ্য (যেমন গোমাংস) নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

একইভাবে আন্তধর্ম বিয়েতে বিধিনিষেধ, ক্ষেত্রবিশেষে নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত আরোপ করা হচ্ছে, যদিও বিয়েতে ইচ্ছুক দম্পতির নিজ নিজ ধর্মে এ ধরনের বিয়েতে কোনো শাস্ত্রীয় বাধা নেই। কনেকে জোর করে ধর্মান্তরিত করানোর গল্প প্রায়ই প্রচার করা হচ্ছে, বিশেষ করে খবরের কাগজে আসছে। অথচ আদালতে বারবারই দেখা যাচ্ছে, যথার্থ আলামতসহযোগে এসব অভিযোগ টিকিয়ে রাখাই কঠিন।

আকবর থেকে মুজিব
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা আমাদের জীবনভরই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আগেও ষোড়শ শতকের শেষ দিকে মোগল সম্রাট আকবরের সূত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি যথেষ্ট স্বচ্ছতার সঙ্গেই আলোচিত হয়েছিল। তিনি এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, জনগণ যে ধর্মীয় আচার স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে, তাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা চলে না। সে স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে রাষ্ট্র বরং সাহায্য করতে পারে। তবে অন্য ধর্ম পাচ্ছে না, এমন কোনো বিশেষ সুবিধা কোনো ধর্মেরই পাওয়া উচিত নয়।

ধর্মনিরপেক্ষতার যে দুটি নীতি নিয়ে মাত্রই আলোচনা করলাম, তার প্রথম ধরনটিতে আছে ‘অসাম্য’ পরিহার (আকবর যার ওপর জোর দিয়েছিলেন), আর দ্বিতীয়টিতে আছে ‘ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বর্জন’ (বঙ্গবন্ধু যে বিষয়ে নজর দিয়েছিলেন)।

অবশ্যই এ দুটি এক নয়। তবে কীভাবে এ দুটি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা নিয়েও আমরা আলোচনা করতে পারি। তাদের লঙ্ঘন কিন্তু একইভাবে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাবে, কেননা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সাধারণত এক ধর্মের তুলনায় অন্য ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্বের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে।

ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা লঙ্ঘনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর উদাহরণ দিয়ে সহজেই এটা তুলে ধরা যায়। ধর্মের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার সেখানে এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে এক ধর্মের তুলনায় অন্য ধর্মের প্রতি পক্ষপাত করা যায়।

বঙ্গবন্ধু যে কারণে বিশ্ববন্ধু
ধর্মনিরপেক্ষতার ভালো বোঝাপড়া শেখ মুজিব যেমন করেছেন—এবং আকবর—অনেক দেশের জন্যই এ মুহূর্তে সেটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভারতই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ধর্মের ক্ষেত্রে হয়তো এটা প্রাসঙ্গিক নয়, তবে জাতি বা নৃগোষ্ঠীগত অসাম্য জাতীয় রাজনৈতিক আলোচনায় কখনো কখনো তাদের জন্যও এটা প্রাসঙ্গিক। উপমহাদেশে, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কায় সমকালীন নানা বিতর্কে ও বিক্ষোভে তীব্রভাবে উঠে আসা বহু বিষয়ে এর প্রাসঙ্গিকতা আছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ভারতের পরিস্থিতিটা বরং বেশি আশঙ্কাজনক। এই সেদিন পর্যন্তও বহু দশক ধরে ভারত ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রচর্চার অনেক কাছাকাছি। কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনের পটভূমিতে বিষয়টি আরও তীব্রভাবে উঠে এসেছে। যেমন এ বছরের (২০২১) এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হওয়ার কথা। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল বিষয়গুলো, বিশেষ করে যে ধরনে মৌলিক প্রয়োজনীয়তাগুলো বঙ্গবন্ধু ব্যাখ্যা করেছেন, সেসব এখনই আলোচনার দাবি রাখে।

কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ—কিংবা অসংগতিপূর্ণ—বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আচরণের এ হিসাব পশ্চিমবঙ্গসহ বড় কিছু নির্বাচনী লড়াইয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বঙ্গবন্ধুর ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করার এ শক্তিশালী মানদণ্ড আজকের দিনেও খুব প্রাসঙ্গিক। আর শুধু বাংলা নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই যেহেতু এটা গুরুত্বপূর্ণ; বঙ্গবন্ধুকে তাই ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবেও বর্ণনা করা যেতে পারে। কেননা, তাঁর ধারণা অনুসরণ করে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধু বাংলা নয়, সারা বিশ্বের মানুষেরই অনেক কিছু অর্জন করার আছে।

শেখ মুজিব শুধু ধর্মনিরপেক্ষতাকেই স্বাধীনতার আলোয় দেখেননি, স্বাধীনতার গুরুত্বের প্রতি এমনিতেই তাঁর আগ্রহ ছিল অত্যন্ত দৃঢ় ও অবিচল। বস্তুত, তাঁর মাতৃভাষাবিষয়ক ভাবনাটির কেন্দ্রেও আছে স্বাধীনতা। সে লড়াইয়েও বঙ্গবন্ধু ভূমিকা রেখেছিলেন। একইভাবে বাঙালি জাতির ধারণাটিও মানুষের আপন ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

উপমহাদেশীয় অনেক আলোচনায়ও এটি একটি প্রধান প্রশ্ন হয়ে উঠেছে, শ্রীলঙ্কায় সিংহলি ও তামিল ভাষার আপেক্ষিক গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা যাবে। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভাষা প্রশ্নে শেখ মুজিবের বিশ্লেষণের প্রতি যদি আরেকটু মনোযোগী হতো এবং আপন মাতৃভাষার জন্য মানুষকে ছাড় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা অনুভব করত, তাহলে শ্রীলঙ্কা হয়তো যুদ্ধ ও বিপুল রক্তপাত এড়িয়ে যেতে পারত। ভাষা ব্যবহার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সামাজিক বিশ্লেষণের যে প্রজ্ঞা, তার উপযোগিতা বাংলা ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসের বেশ প্রথম দিকেই দেশটির সব প্রধান ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এভাবে গুরুতর কিছু সমস্যা ভারতে বেশ আগেভাগেই এড়ানো গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। জাতীয় ভাষাগুলোর সীমিত ভূমিকার কথা মাথায় রেখেই ভারতে এ সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তারপরও শেখ মুজিবের কিছু ভাবনা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, যখন আমরা সরকারি ভাষা বিভাগটির কাছে ফিরে যাই।

জাতীয় ভাষার মর্যাদা ভারতের প্রতিটি প্রধান ভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান গড়ে দিয়েছে সত্য, কিন্তু সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দি ও ইংরেজির সঙ্গে ভারতের অন্য প্রধান ভাষাগুলোর অসমতা আছে, যার কিছু কিছু হয়তো অনিবার্যও। যাদের মাতৃভাষা হিন্দি (এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজি) তাদের সঙ্গে সুবিধাবঞ্চিত অন্য ভারতীয়দের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে কিছু বৈষম্য রয়েছে। সরকারি কাজে এক ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষার ব্যবহারের সময় সমতার সমস্যাটি বাস্তবসম্মতভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সম্ভাব্য এ বৈষম্য যতটা মনোযোগ দাবি করে, ততটা পাচ্ছে না।

কিছু মাত্রায় এটা হয়তো পশ্চিমবঙ্গেরও সমস্যা। যদিও পশ্চিমবঙ্গ নিজেই একটি বহুভাষিক রাজ্য। বেশ কয়েকটি ভাষায় এখানে কথা বলা হয়। আমার বন্ধু রেহমান সোবহান কলকাতায় কথিত বহু ভাষা নিয়ে সর্বদাই লিখছেন। তবে ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলোয় এটি অনেক বড় উদ্বেগের বিষয়। সংস্কৃত নয়, মূলত প্রাচীন তামিল থেকে উদ্ভূত হয়েছে সেখানকার ভাষা।

সামান্য অতি সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েও এ কথা বলা যায় যে, সব সময় স্বাধীনতাই ছিল শেখ মুজিবের অগ্রাধিকার। মর্যাদা, অবস্থান, সরকারি কাজে বা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের মতো স্বতন্ত্র বিষয়গুলোকে স্বাধীনতার এই বৃহত্তর পরিসরেই বিচার করতে হবে।

আমার উপস্থাপনা শেষ করার আগে সমতাকে সামনে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা নিয়ে দু-চারটা কথা বলতে চাই। অবিভক্ত পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা চাওয়ার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের চিন্তাধারায় সমতাবাদী ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ভাষণগুলোয় বঙ্গবন্ধু তখন পর্যন্ত অনিশ্চিত নানা বর্গের ভোটদাতার সামনে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতার প্রসঙ্গটি তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি। মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে সমতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি এই নীতির ওপর জোর দিয়েছিলেন যে ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্যান্য নাগরিকের মতো সমান অধিকার ও সুযোগ ভোগ করার অধিকারী।’

পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায়বিচারের সমতাবাদী মনোভাব যে আওয়ামী লীগের দারুণ সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি (১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিই পায় আওয়ামী লীগ), তার কারণ বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপক প্রচারণা। ন্যায্য লক্ষ্য অর্জনে অকাট্য যুক্তি যে অসম্ভব কার্যকর, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির অনেক পর্বেই তা ভালোভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখানেও বড় একটা শেখার বিষয় আছে—যুক্তি দিয়ে নীতি উপস্থাপন।

ব্যতিক্রমী প্রতিবেশী
ইতিহাসের একটি সূত্র বলে শেষ করব। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধগুলোর সঙ্গে নিজের নৈতিক আদর্শগুলোর সম্পর্কের কথা বঙ্গবন্ধু বারবারই বলেছেন। তাঁর সমতাবাদী ভাবনার লক্ষণীয় কোনো ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে কি? উত্তরে বলাই যায়, হ্যাঁ, আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অনেক কাল আগে থেকেই সমাজসচেতন কবি আর চারণদের কবিতায় আমরা এটা দেখতে পাই। কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবিদের লেখার বেলায় এটি আরও বিশেষভাবে সত্য, এমনকি প্রাচীনতম বাংলা কবিতার মধ্যেও তার ইঙ্গিত আছে।

বাংলা ভাষার প্রাচীন ধাঁচে যেসব প্রাচীনতম বাঙালি কবি লিখতেন, প্রায়ই তাঁরা ন্যায্যতার পক্ষে তাঁদের ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করে গেছেন। একটি দৃষ্টান্ত দিই। বাংলা যখন বিকশিত হচ্ছিল, সে সময়ের লেখার প্রাচীনতম সংকলন চর্যাপদ। দশম শতকের প্রথম দিকে বাংলায় লেখা একটা চর্যাপদে পূর্ববঙ্গে তাঁর নদীযাত্রার বর্ণনা দিয়ে গেছেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য কবি ভুসুকু। সেই যাত্রা তাঁকে বাংলার পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে নিয়ে গিয়েছিল। পূর্বে যাওয়ার পথে সিদ্ধাচার্যের সঙ্গে নানা কিছু ঘটে, জলদস্যুরা তাঁর ধনসম্পদ লুট করে নেয় (কবি অবশ্য বলেন, সে কারণে তিনি বিলাপ করবেন না), সমাজের সবচেয়ে নিম্নবর্গ চণ্ডাল জাতের এক নারীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় (এতে অবশ্য তিনি আনন্দিত)।

তাই প্রায় এক হাজার বছর আগে ন্যায়পরায়ণতার বন্দনা করে নিচের কবিতাটি সিদ্ধাচার্য পেশ করেন। এই ন্যায্যতাপ্রীতি বাঙালি সংস্কৃতিরই বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেছেন তিনি: ‘বাজ ণাব পাড়ী পঁউয়া খালেঁ বাহিউ।/ অদঅ বঙ্গালে দেশ লুড়ি।।/ আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী।/ নিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী।।’

‘বাজ ণাব পাড়ী পঁউয়া খালেঁ বাহিউ (পদ্মা নদী ধরে আমি বজ্র-নৌকা চালিয়েছি)।’ ‘অদঅ বঙ্গালে দেশ লুড়ি (জলদস্যুরা আমার দুর্দশা লুট করে নিয়েছে)।’ তিনি আসলে বলছেন, জলদস্যুরা আমার সম্পত্তি লুটে নিয়েছে। তিনি বলছেন, এটাই ছিল আমার দুঃখ, কারণ আমার সম্পত্তির দরকার নেই। ওটা খালি আমাকে চিন্তায় ফেলে দিত। পরের দিকের কবিতাগুলোয় তিনি বলছেন, কেন তিনি সেগুলো ছেড়েছেন। ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী (ভুসুকু আজ তুমি সত্যি বাঙালি হয়েছ)।’ ‘বঙ্গালী’ বা ‘বাঙালি’ শব্দের প্রথম ব্যবহারগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। ‘নিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলী (এক চণ্ডাল নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি)।’

তাঁরা কী বলছেন, আমাদের তা বুঝতে হবে। তখনকার দিনে বাংলার যেকোনো জায়গায় বাস করলেই কিন্তু বাঙালি হওয়া যেত না, তাকে ঐতিহাসিকভাবে এবং বিশেষ করে আমরা এখন যাকে ঢাকা ও ফরিদপুর বলি, সেই এলাকার বাসিন্দা হতে হতো। যা–ই হোক, তখনো এটি বাংলারই একটি বড় অংশ ছিল। আর আমরা দেখতেই পাচ্ছি এক সহস্রাব্দ আগে ‘সত্যি বাঙালি’ আর তার ন্যায্যতাপ্রীতিকে কী চোখে দেখা হতো।

ঘটনাচক্রে ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চলের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্ম। আর আমিও যেহেতু ঢাকা থেকে এসেছি—মানিকগঞ্জ আর ঢাকা নগর—আমিও তাই উল্লাস করতে পারি।
এ আলোচনার সমাপ্তি টানার আগে সাহস করে বলি, আমি ভাগ্যবান যে এমন একজন ব্যতিক্রমী প্রতিবেশী আমি পেয়েছি, যাঁর মহান ধারণা ও নেতৃত্ব বিশ্বকে বদলে দিয়েছে।