ছেলের ছবিটা দেখলেই কলিজাটা ছিঁড়ে যায়

মিরসরাই বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের কাছে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেন পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়
ছবি: ইকবাল হোসেন

চট্টগ্রাম নগরের এমইএস কলেজের গণিত দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন জিয়াউল হক (সজীব)। বাবা আবদুল হামিদ মুদিদোকানের কর্মচারী। পড়ালেখার পাশাপাশি জিয়াউল পরিবারকে সাহায্য করতেন কোচিং সেন্টার চালিয়ে, করতেন টিউশনিও। জিয়াউল পড়ালেখায় সাহায্য করতেন ছোট ভাইবোনদের। পরিবারের হাল ধরা বড় ছেলেকে পাঁচ মাস আগে হারিয়ে এখনো দিশাহারা স্বজনেরা। কেটে উঠতে পারেননি শোক।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলার হাটহাজারীর চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়ায় জিয়াউলের ঘরে গিয়ে দেখা যায়, মা শাহনাজ আক্তার সবজি কাটাকুটি করছেন। আর কিছুক্ষণ পরপর ছেলে (জিয়াউল) ছবিতে হাত বুলাচ্ছেন। বললেন, ‘আমার পরিবারের হাল ধরা ছেলেটি নেই। কীভাবে সামনের দিনগুলো পার করব? এই পাঁচ মাস এক দিনও ভালোভাবে ঘুমাতে পারিনি। ছেলের ছবি দেখলেই কলিজাটা ছিঁড়ে যায়।’

শুধু নিহতের স্বজনেরা নন, শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি গ্রামবাসীও। মর্মন্তুদ এক দুর্ঘটনায় এলাকার ১৩ তরুণ, কিশোরের একসঙ্গে চলে যাওয়ার ঘটনাটি তাঁরা এখনো মেনে নিতে পারছেন না। মিরসরাই বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

সেদিন যা ঘটেছিল

চলতি বছরের ২৯ জুলাই বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেন পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে মারা যান ১১ জন, আহত হন ৭ জন। আহত সাতজনের দুজনের মৃত্যু হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায়। হতাহত ব্যক্তিরা চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজারের পূর্ব খন্দকিয়া গ্রামের বাসিন্দা।

নিহত ১৩ জনের মধ্যে মাইক্রোবাসচালক ছাড়া অন্যরা স্থানীয় ‘আর অ্যান্ড জে’ নামের একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছিলেন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন কোচিং সেন্টারের চার শিক্ষক জিয়াউল হক, মোস্তফা মাসুদ রাকিব, রিদুয়ান চৌধুরী ও ওয়াহিদুল আলম; শিক্ষার্থী সামিরুল ইসলাম হাসান, মোসাহাব আহমেদ, ইকবাল হোসেন, শান্ত শীল, তাসমির হাসান, আয়াতুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন ও মো. আসিফ এবং মাইক্রোবাসের চালক গোলাম মোস্তফা।

ঘটনার দিন সকালে তাঁরা মাইক্রোবাসে করে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনায় বেড়াতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। ঘটনার পর নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি। পরিবারের সম্মতিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁদের লাশ দাফন করা হয়।

এ দিকে ঘটনার পর রেলওয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ১৭ আগস্ট তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার জন্য গেটম্যান ও গাড়িচালককে দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দেয়। গেটম্যান সাদ্দাম হোসেন দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার বিষয়টি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ছেলের শূন্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন

চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের আমানবাজার থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে খন্দকিয়া গ্রাম। গতকাল বৃহস্পতিবার নিহত জিয়াউলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অশ্রুসিক্ত মা শাহনাজ। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, দিনরাত যখনই ছেলের কথা মনে পড়ে, তাঁর স্ত্রী শুধু কান্না করেন। কী বলে যে তাঁকে সান্ত্বনা দেবেন, জানেন না। কারণ, ছেলের জন্য তাঁর কলিজাও ফেটে যাচ্ছে।
আবদুল হামিদ বলেন, আজ ছেলে বেঁচে থাকলে তাঁর সংসারটা কত সুখেরই না হতো! বাবার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে জিয়াউলের ছোট ভাই মুজিবুল হক বলেন, ‘ভাইয়া না থাকায় আমরা শেষ হয়ে গেছি। ওনার শূন্যতা পূরণ হবে না।’ ভাইয়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই কথা বলল ছোট বোন শারমিন আক্তারও। সে এবার মাধ্যমিক (এসএসসি) পাস করেছে।

মর্মন্তুদ এক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ১৩ তরুণ ও কিশোরের মৃত্যু হয়। একজন ছাড়া তাঁদের সবাই শিক্ষার্থী ছিলেন। রেললাইন ঘেঁষে পড়ে আছে একজনের জুতা
ছবি: ইকবাল হোসেন
আরও পড়ুন

আবদুল হামিদের জিয়াউলসহ দুই ছেলে এক মেয়ে। তিনি একটি মুদিদোকানে চাকরি করেন। বাকি দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনায় তাঁকে সাহায্য করতেন বড় ছেলে জিয়াউল। তিনি বলেন, জিয়াউলকে অনেকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু পড়ালেখায় ভালো হওয়ায় নিজের কষ্ট হলেও সন্তানদের পড়া চালিয়ে নিচ্ছিলেন। স্বপ্ন ছিল, পড়া শেষ করে ছেলে চাকরি করবে, সংসারে আর দুঃখ থাকবে না। কিন্তু তাঁর সবই শেষ। ছেলে হারানোর পাঁচ মাসে তাঁর শূন্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।

সন্তানের সঙ্গে হারিয়ে গেল স্বপ্নও

জিয়াউলের ঘরের পূর্ব দিকে প্রায় পাঁচ শ গজ দূরে ইকবাল হোসেন মারুফের নানার ঘর। সেখানে যেতেই ভেতর থেকে এগিয়ে এলেন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা নুর নাহার বেগম। ইকবালের মা কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। অশ্রুসিক্ত নুর নাহার বলতে থাকেন, নাতিকে হারানোর পর থেকে তাঁর মেয়ে প্রায়ই ছবি দেখে কান্না করেন।

আরও পড়ুন

বৃদ্ধা নুর নাহার বলেন, মেয়ে কান্না করলে তাঁর কলিজাটাও ছিঁড়ে যায়। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ইকবালের বয়স যখন চার বছর, তখন তার মা পাশের মাদার্শা গ্রামের শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি খন্দকিয়ায় চলে আসেন। তখন থেকে তিনি তাঁদের দেখাশোনা করে আসছেন।

ইকবালের এবার স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। নানি নুর নাহার বেগম বলেন, স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে সন্তানদের নিয়ে মেয়ে চলে আসেন। মেয়ের বড় ছেলে ইকবালের স্বপ্ন ছিল এসএসসি পাস করেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। পরিবারের হাল ধরবে। তখন তাঁর মেয়ের পরিবারে আর দুঃখ থাকবে না। কিন্তু তার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় নাতি।

ততক্ষণে ঘরের ভেতর থেকে বসার কক্ষে এলেন ইকবালের মা কামরুন নাহার। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ছেলে তাঁকে প্রায়ই বলত, ভালো চাকরি পেলে তাঁদের আর দুঃখ থাকবে না। চাকরির আগেই ছেলে নেই হয়ে গেল। শেষ হলো না তাঁর দুঃখের।
ইকবালের নানাবাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে ওয়াহিদুল আলমের ঘর। ঘরে ঢুকতেই মা নাজমা আক্তার এলেন। বলতে থাকেন, কোচিং সেন্টার চালিয়ে সংসারে সাহায্য করতেন তাঁর বড় ছেলে। এখন তাঁর চারদিকে অন্ধকার। ছেলেকে হারিয়ে অসহায় তাঁর বৃদ্ধ স্বামী।

ছেলে ওয়াহিদুল আলমকে হারিয়ে বাবার আহাজারি
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

একই অবস্থা পাশের মোস্তফা মাসুদ রাকিবের নানাবাড়িতে। তাঁর নানা ফজলুল হক জানান, পারিবারিক অবস্থা ভালো না থাকায় মোস্তফা ছোটবেলা থেকেই নানাবাড়িতে থাকতেন। এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টায় ছিলেন। এখন তাঁর মেয়ের সবই শেষ হয়ে গেল। ২৬ ডিসেম্বর মোস্তফার জন্মদিন ছিল।
স্বজনদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান

জিয়াউল, ইকবাল, ওয়াহিদুল ও মোস্তফার মতো নিহত অন্যদেরও আর্থিক অবস্থা একই বলে জানান স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাইক্রোবাসের চালক ছাড়া বাকিরা সবাই পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি, কোচিং সেন্টারে পড়িয়ে পরিবারকে সাহায্য করতেন। তাঁরা না থাকায় পরিবারগুলো এখন আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

তোফায়েল আহমেদ জানান, দুর্ঘটনার পর জেলা পরিষদ থেকে প্রতিটি পরিবারকে ৪০ হাজার টাকা করে এবং স্থানীয় লোকজন ১১ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন। এর পর থেকে তারা আর সাহায্য পায়নি। পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো উচিত।