ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে না পারাকে ‘বাস্তবতার কাছে হার’ বলছে রেলওয়ে

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে গন্তব্যের পথে যাত্রীরা। কমলাপুর, ঢাকা, ৯ এপ্রিলছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে সোমবার সকালেও যাত্রীর বাড়তি চাপ ছিল না। তবে তৈরি পোশাক কারখানা ছুটি হওয়ার পর বিকেল থেকে বাড়তি চাপ শুরু হয়। সেই চাপ মোকাবিলা করে যাত্রীদের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। একে ‘বাস্তবতার কাছে হার’ বলছে রেলওয়ে।

ভেতরে জায়গা না পেয়ে সোমবার দিবাগত রাতে উত্তরাঞ্চলের ট্রেনে যাত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে ছাদে চেপে গেছেন। একই চিত্র ছিল মঙ্গলবার সকালেও। উত্তরাঞ্চলগামী একতা এক্সপ্রেস ও রংপুর এক্সপ্রেসের যাত্রীরা ছাদে চেপে গেছেন। ছাদে পুরুষের পাশাপাশি ছিলেন নারী-শিশুরাও। প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে রেলওয়ের অন্যান্য অঞ্চলের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতেও।

মঙ্গলবার সকালে উত্তরবঙ্গগামী একতা এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাদে ওঠেন দিনাজপুরের পার্বতীপুরের দুই বোন নাসরিন আক্তার ও নাসিমা আক্তার। তাঁরা প্রথম আলোকে জানান, ঢাকায় তাঁরা পড়াশোনা করেন। স্ট্যান্ডিং (দাঁড়িয়ে যাওয়ার) টিকিট কাটলেও ভেতরে জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়ে ছাদে উঠেছেন।

ঢাকার একটি কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন মো. হোসেন। ঠাকুরগাঁও যাওয়ার উদ্দেশে তিনি ছাদে উঠেছেন। তিনিও বললেন, স্ট্যান্ডিং টিকিট কিনেছেন, ভেতরে ঢুকতে পারছেন না।

সরেজমিনে দেখা যায় যায়, ট্রেনের ছাদে ভ্রমণকারীদের অধিকাংশই স্বল্প আয়ের মানুষ। কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। কম দামের টিকিটে দীর্ঘ পথ যেতে পারবেন বলেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে যাত্রা করেছেন তাঁরা।

যাত্রীদের যাত্রা নিরাপদ করতে না পারাকে ‘বাস্তবতার কাছে হার’ বলে মনে করেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার। মঙ্গলবার দুপুরে স্টেশনে নিজ কার্যালয়ে মাসুদ সারওয়ার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা বারবার বলেছি ছাদে না ওঠার জন্য। তারপরও তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাদে উঠেছেন।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাদে ওঠা থেকে যাত্রীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে বলে উল্লেখ করেন মাসুদ সারওয়ার।

বাস্তবতার কাছে হার মানলেও ঈদযাত্রা ‘নিরাপদ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম। ৭ এপ্রিল রাজবাড়ীর পাংশা ডাকবাংলোয় মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাড়ি ফেরা নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঈদযাত্রা নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে শ্রমিকেরা বাড়ি যেতে পারেন, আমরা সেই ব্যবস্থা নিয়েছি। এবার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য আগামী দুই দিন আমরা আলাদা বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’

বিশেষ ব্যবস্থার পরও ঈদযাত্রা অনেকের জন্যই নিরাপদ ও স্বস্তির হলো না।

কেন নিরাপদ হলো না

ঈদযাত্রায় শেষ সময়ে যে জনস্রোত আসে, সেটা সব সময় রেলমুখী হয় বলে মনে করছেন পরিবহনবিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সড়কপথে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে গণপরিবহন কম দেখিয়ে পরিবহন ব্যবসায়ীদের বেশি ভাড়া নেওয়ার প্রবণতা সব সময়। সে জন্য ট্রেনে একটা জনস্রোত তৈরি হয়।

কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ের সেই জনস্রোত মোকাবিলার সক্ষমতা আজও তৈরি হয়নি বলে মনে করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অসহায়, নিরুপায়। এই চাপ সামলানোর সক্ষমতা তাদের নেই। তারা অসহায়, নিরুপায় হয়ে যাত্রীদের ছেড়ে দেয়।’

ট্রেনের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছেন এক যাত্রী। কমলাপুর, ঢাকা, ৯ এপ্রিল
ছবি: প্রথম আলো

ট্রেনের ছাদে যাত্রার দুটি শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একটি হচ্ছে দুর্ঘটনার শঙ্কা। মাঝেমধ্যেই ট্রেনের ছাদে যাত্রার কারণে পড়ে যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয়ত, ট্রেনের বগিগুলোরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। কারণ, ট্রেনের ছাদ এমনভাবে তৈরি করা হয় না যে তা ভার বহন করতে পারবে।

নিরাপদ করার উপায়

ঈদ সামনে রেখে ট্রেন, সড়ক ও নৌপথে প্রচণ্ড চাপ শুরু হয়েছে সোমবার বিকেল থেকে। তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বাড়ি ফেরার জন্য রাস্তায় নামলে এই চাপ বেড়ে যায়। সাধারণত প্রতিবছরই চাপটা হয় ঈদযাত্রার শেষের দু-তিন দিন। এবারও তা-ই হয়েছে, এর আগে এতটা চাপ ছিল না।

দেশে ঈদযাত্রা নিরাপদ ও স্বস্তির করতে পরিকল্পনা ‘একেবারেই দুর্বল’ বলেও মনে করেন পরিবহনবিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, এই চাপ সামলানোর জন্য সরকারকে বিকল্প অভিনব ব্যবস্থা করতে হবে।

সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা সম্ভব হলে ঈদযাত্রা অনেকটাই নিরাপদ ও স্বস্তির করা সম্ভব বলে মনে করেন বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তাঁর মতে, সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালো মানের বাস ও দক্ষ চালক রয়েছেন। ঈদের শেষ সময়ে সেসব বাস রাস্তায় নামানো গেলে সড়কে গণপরিবহনের কৃত্রিম সংকট থাকবে না, যা ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে ভূমিকা রাখবে। ন্যায্য ভাড়ায় যেতে পারলে অনেকেই ট্রেনমুখী হবেন না।

ধাপে ধাপে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। একটু লম্বা ছুটি দেওয়া হলেও শেষ দিকে এত চাপ তৈরি হবে না। যেমন ৮ ও ৯ এপ্রিল সরকারের ছুটি দেওয়া উচিত ছিল। তাহলেও শেষ সময়ে চাপ অনেকটা কমে যেত। তিনি বলেন, আবার শুধু ছুটি দিলেও হবে না, যথাসময়ে বেতন-বোনাসও দিতে হবে। সঠিক সময়ে বোনাস না দিলেও কারখানার স্বল্প আয়ের মানুষদের পক্ষে ছুটি পেলেও আগে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রেও সরকারকে আরও নজরদারি বাড়াতে হবে।