মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নতুন বাস্তবতায় বুঝতে হবে
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীরও রক্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মনিবেদনে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবনা তাঁদের সন্তানদের? তাই নিয়ে এই আয়োজন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় পার হয়ে গেল। পাকিস্তানি শাসনে আমাদের কেটেছিল ২৪ বছর। সে হিসাবে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত অবস্থার চেয়ে স্বাধীনতার পর দ্বিগুণের বেশি সময় আমরা পার করলাম। এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা রাখা—এসব বিষয়ে অনেক কথা আমরা বলেছি, কিন্তু কাজ কতটা হলো, তা বিচার করার বিষয়।
স্বাধীনতার পর আমাদের অর্থনীতির পরিসর বেড়েছে। মানবসম্পদের উন্নয়ন হয়েছে। অনেক বিষয়েই ইতিবাচক বহু অগ্রগতি হয়েছে। এ-ও সত্য যে কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করেছে। এই পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটের নিরিখেই আমাদের অগ্রগতি বিবেচনা করতে হবে।
আমি মনে করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সংবিধান আমরা রচনা করেছি, সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আমরা কীভাবে পেতে চাই। এর চার মূলনীতি বর্তমান সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়েই আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে।
সমাজ ও গণতন্ত্র মানেই হলো রাষ্ট্রে মানুষের ভিন্নমত থাকবে। নানা পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে। মানুষ নির্ভয়ে তাঁদের স্বাধীন মতামত দেবেন। সমবেত হবেন, মিছিল-মিটিং করবেন। এর মধ্যে দমন-পীড়ন আসবে কেন? মুক্তিযুদ্ধের এত আত্মত্যাগ, এত দুঃখ-কষ্ট তো একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারই জন্য। কিন্তু সেই সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার অঙ্গীকার আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
নির্বাচনপ্রক্রিয়াও দিন দিন আমরা এমন জায়গায় নিয়ে এসেছি যে প্রকৃত সৎ ও যোগ্য মানুষকে বেছে নেওয়ার সুযোগ মানুষের হাতে অনেক ক্ষেত্রেই আর থাকছে না। দল যাকে মনোনয়ন দিচ্ছে, তার বিষয়ে বহু অভিযোগ থাকলেও অনুসারীদের তাকেই নির্বাচিত করতে হচ্ছে। যোগ্য লোক উপেক্ষিত হচ্ছেন। এগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রক্রিয়া। এখানে পরিবর্তন না আনলে গণতন্ত্র কথাটিরই অর্থ থাকে না।
সমাজতন্ত্রের মর্মকথা যদি সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা বোঝায়, তার বড় বাধা এখন দুর্নীতি। আমরা সাদা চোখেই দেখতে পাচ্ছি, রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে প্রভাবশালীরা দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাচ্ছে, অথচ সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ মানুষ দণ্ডিত হচ্ছে সামান্য অজুহাতে। আইনের এ রকম দুর্বল প্রয়োগ রোধ করতে না পারলে প্রকৃত ন্যায়বিচার আমরা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করব?
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা বলেছি, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান—আমরা সবাই বাঙালি।’ এটা মাথায় রেখে দেশের মানুষের মধ্যে সংহতি রচনার জন্য জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। শুধু বাঙালি নয়, সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার, নিরাপত্তা, সমান সুযোগ রাষ্ট্রের নিশ্চিত করা দরকার।
আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রসঙ্গে এখানে একটু বলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যখন শহীদ হন, তাঁর বয়স তখন মাত্র ৪৫ বছর। তাঁর রচনাবলি পড়ে দেখেছি, তিনি নিজের বিষয় ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্য ছাড়াও দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, নগরায়ণ, পরিবেশ ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বহু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল। অসময়ে পৃথিবী থেকে তাঁদের সরিয়ে দেওয়ায় তাঁরা নিজেদের অবদান সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের কাজ ও ভাবনা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা জরুরি।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কর্ম ও আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হলে তারা সেখান থেকে যেমন জাতি গঠন এবং ভবিষ্যতের অগ্রগতির পথনির্দেশ পাবে, তেমনি নিজেদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা পাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারেরই হয়তো প্রধান ভূমিকা। তবে এখন বেসরকারি পর্যায়েও বহু যোগ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তারা উদ্যোগী হলেও এ কাজ অনেক এগিয়ে যাবে।
দেশটা সবাই মিলেই গড়ে তুলতে হবে। সেটাই হবে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি আমাদের সর্বোত্তম শ্রদ্ধার প্রকাশ।
তানভীর হায়দার চৌধুরী: শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে এবং কাজী ফুডস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।