আহমদ রফিকের কাজ ও আদর্শ আরও বড় পরিসরে থেকে যাবে

ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিকের শোকসভায় সভাপতির বক্তব্য দেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ২৪ অক্টোবরছবি: প্রথম আলো

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক এখন নেই। কিন্তু তাঁর কাজ ও আদর্শ আরও বড় পরিসরে থেকে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। শুক্রবার বিকেলে আহমদ রফিকের শোকসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।

‘ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক শোকসভা জাতীয় কমিটি’র আয়োজনে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এই শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আহমদ রফিকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শোকসভার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। দুটি রবীন্দ্রসংগীত ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে’ এবং ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ’ পরিবেশন করেন অসীম দত্ত। এরপর আহমদ রফিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ২ অক্টোবর ৯৬ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন।

এরপর শুরু হয় আলোচনাপর্ব। আলোচকেরা আহমদ রফিককে নিয়ে স্মৃতিচারণা, তাঁর সমাজতান্ত্রিক, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ব্যক্তিজীবন, কাব্য ও সাহিত্যচর্চা, রবীন্দ্র গবেষণাসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তাঁর জীবনকর্ম পাঠ করেন সংস্কৃতিকর্মী ইশরাত রহমান। সঞ্চালনা করেন শোকসভা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ইসমাইল সাদী।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আহমদ রফিক ছিলেন আমাদের সবার অত্যন্ত আপনজন। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও সবাই তাঁকে “ভাই” বলে ডাকতেন, তিনিও “ভাই” বলে আপন করে নিতেন। এক অসাধারণ ব্যক্তিক্রম চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি। আহমদ রফিক দুই অর্থেই ভাষাসংগ্রামী ছিলেন। একদিকে তিনি সরাসরি মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যুক্ত ছিলেন। দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন সাহিত্যিক। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তিনি ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করা, সমৃদ্ধ করা, ভাষার ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং মানুষের সাংস্কৃতিক চর্চাকে উন্নত করতে আজীবন সংগ্রাম করেছেন।’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আহমদ রফিকের সংস্কৃতিচর্চার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। তিনি সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। সেই সমাজবিপ্লবের জন্য সাংস্কৃতিক চর্চার ভেতর দিয়ে জনমানসের প্রস্তুতির ক্ষেত্র তৈরি করার কাজ করেছেন। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস করতেন না। নিজে জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ তাঁর ছিল না। জীবনের পরিণামের কথা না ভেবে সব ব্যক্তিগত সম্পদ তিনি দান করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ কারণে জীবনের অন্তিম পর্যায়ে তাঁকে অর্থকষ্টেও পড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে এখন সভ্যতার সংকটের চেয়ে মানবিকতার সংকটই প্রধান। এমন সংকটময় সময়ে আহমদ রফিকের মতো মানুষের কাজ ও আদর্শ আমাদের অনুসরণ করতে হবে।’

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আহমদ রফিকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শোকসভার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন
ছবি: প্রথম আলো

এরপর ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি কবি মুনির সিরাজ বলেন, এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আহমদ রফিকের সংগৃহীত বইপত্র, লেখালেখি, পদকসহ সব নিদর্শন সংগ্রহ করা হবে। তিনি ল্যাবএইড, হেলথ অ্যান্ড হোপ, বারডেম হাসপাতালসহ যেসব হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স আহমদ রফিককে চিকিৎসা–সেবা দিয়েছেন, সরকারিভাবে যে অর্থসহায়তা দেওয়া হয়েছে, সে জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল আহমদ রফিকের স্বপ্ন ও সাধনা। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মৃদুভাষী ছিলেন। অল্প কথায় মনের ভাব প্রকাশ করতেন। তবে যা বিশ্বাস করতেন, কোনো দ্বিধা না করে তা সরাসরি বলতেন। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বিকল্প শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে। সে জন্য বাম শক্তিগুলোর বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন। শ্রোতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সেই ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়ায় তাঁরা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে আহমদ রফিকের আদর্শ নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।

আহমদ রফিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে পরবর্তী সময়ে অনেকে অনেক দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি নিরপেক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করেছেন। এ ছাড়া আজীবন তিনি বাঙালি সংস্কৃতিকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই কাজ অন্য কাজগুলোকে ছাপিয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, আহমদ রফিক বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্রষ্টা এবং রচনায় সেই সৃষ্টিকে ধারণ করেছেন। সমগ্র জীবন তিনি জ্ঞান সৃষ্টি ও জাতীয় ইতিহাসের সত্যানুসন্ধান করেছেন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে তাঁর প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তাঁর মতো এত বিচিত্র দিক থেকে ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ উভয় বঙ্গে কেউ করেনি। এ কারণে তিনি ভারতের টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি লাভ করেছিলেন।

গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের আহ্বায়ক মফিজুর রহমান বলেন, আহমদ রফিক জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কথা ও কাজের সামঞ্জস্য রেখে সমাজে এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। জীবনের শেষ পর্যায়েও তিনি গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামের কথা ভেবেছেন। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্য গঠনে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।

গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশারেফা মিশু বলেন, গণমানুষের মুক্তির এক বড় স্বপ্ন নিয়ে তিনি জীবন যাপন করেছেন এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন। বিপ্লবীদের জন্য তাঁর জীবন এক গভীর প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

আলোচনায় আরও অংশ নেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি এ এস এম কামালউদ্দিন, আহমদ রফিকের বইয়ের প্রকাশক অনিন্দ্য প্রকাশনীর প্রকাশক আফজাল হোসেন, বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলনের সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, বাংলাদেশ জাসদের নেতা মোস্তাক হোসেন, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের নেতা আবদুস সাত্তার, বাসদ মার্ক্সবাদী নেতা মাসুদ রানা, বাসদ (মাহাবু) নেতা হারুণার রসিদ, বাসদের নেতা জুলফিকার আলী, একুশে চেতনা পরিষদের গোলাম শফিক প্রমুখ। দীর্ঘ ৩৫ বছর আহমদ রফিকের পরিচর্যাকারী মো.আবুল কালাম স্মৃতিচারণা করেন। পরিবারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী তাঁর ভাগনে হ‌ুমায়ূন কবির ও কলকাতার লেখক দীপক পিপলাইয়ের অডিও বার্তা শোনানো হয়।

আরও পড়ুন