গম আমদানি নিয়ে টিআইবির বক্তব্য ভুল: খাদ্য মন্ত্রণালয়  

সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো ‘বেশি দামে গম আমদানি’ শিরোনামে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে নিজেদের বক্তব্য দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আজ সোমবার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, টিআইবির ওই বক্তব্যে ভুল ও অসংগতিপূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়েছে। জনমনে এ ধরনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এই মন্তব্য করে মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির বক্তব্যের বিভিন্ন অংশে তোলা প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে।  

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, গম ও চাল ক্রয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় গণখাতে ক্রয় আইনের কোনো লঙ্ঘন করেনি এবং কোনো তৃতীয় পক্ষকে ক্রয় প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেনি। কয়েকটি গণমাধ্যমের সংবাদে যে তৃতীয় পক্ষের নাম বলা হচ্ছে, তাদের রাশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে লোকাল এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোনো তৃতীয় পক্ষ বাংলাদেশের গম ক্রয়ের নেগোসিয়েশন, মূল্য নির্ধারণ ও নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিল না। জিটুজি কার্যক্রমে সরকার নির্ধারিত কমিটির সদস্যরা (বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের) বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সমঝোতার প্রক্রিয়ায় অংশ নেন এবং ৪ ঘণ্টাব্যাপী সভায় সর্বসম্মতভাবে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। সমঝোতার পর খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি ক্রয় কমিটিতে যায়। ক্রয় কমিটি বিস্তারিত আলোচনার পর অনুমোদন দান করে। তারপর খাদ্য মন্ত্রণালয় কার্যাদেশ দেয়। এখানে তৃতীয় কোনো পক্ষের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।

মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, টিআইবির অভিযোগ অনুসারে বেশি দামে গম কেনা হচ্ছে তথ্যটি সঠিক নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত গমের মূল্য ওঠানামা করে।

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজার গম সংগ্রহ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে বাংলাদেশের গম আমদানির অন্যতম উৎস ভারত সরকারি ও বেসরকারি গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় গম আমদানি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অথচ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম চালানো, নিয়মিত অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গম সংগ্রহ অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। গমের নিরাপত্তা মজুত যেখানে কমপক্ষে দুই লাখ মেট্রিক টন থাকার কথা তখন সেটা  একপর্যায়ে ১ লাখ ২৫ হাজার টনে নেমে আসে। বর্তমান মজুত ১ লাখ ২২ হাজার টন। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা হতে জিটুজি প্রক্রিয়ায় গম সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রে গমের দাম ৫০০ ডলারের ওপরে হওয়ায় সরকার সেখান থেকে গম ক্রয়ে আগ্রহী হয়নি।

এ ছাড়া অতি দ্রুত গম ক্রয়ের কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়নি। রাশিয়ার সঙ্গে গম আমদানির প্রথম সমঝোতা শুরু হয় চলতি বছরের ২৩ জুন। সে সময় রাশিয়া গম সরবরাহে সম্মত হয়নি, তারপর সরকারি পর্যায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়। তিন মাসের সফল কূটনৈতিক যোগাযোগের পর রাশিয়ায় বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গত ২৪ আগস্ট রাশিয়ার সঙ্গে গম আমদানির দ্বিতীয় সমঝোতা বৈঠক হয়। তখন রাশিয়ার গমের এফওবি মূল্য ছিল ৩৩০ মার্কিন ডলার। জাহাজভাড়া, লোডিং আনলোডিং, বার্থ অপারেটর হ্যান্ডলিং, ইনস্যুরেন্স ও লাইটেনিংসহ মোট মূল্য নির্ধারণ হয় ৪৩০ মার্কিন ডলার, যা যুক্তিসংগত ও সঠিক।

সরকারি ক্রয় কার্যক্রমের সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ক্রয় কার্যক্রম অনুমোদন দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, একসঙ্গে ৫ লাখ টন গম দেশে এনে সংরক্ষণ করার সক্ষমতা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নেই।

অপর দিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে রাশিয়া থেকে গম আনার জাহাজও এ মুহূর্তে পর্যাপ্ত নয়। জাহাজমালিকেরা এ অঞ্চলে জাহাজ দিতে চান না। রাশিয়া থেকে গম সরবরাহ কার্যক্রম ৪ মাস ধরে চলবে। তৃতীয় ও চতুর্থ মাসে গমের এফওবি মূল্য বৃদ্ধি পেলেও রাশিয়া চুক্তি মূল্যে গম সরবরাহ করবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এক পূর্বাভাসে বলেছে, আগামী বছর বিশ্বে খাদ্যঘাটতি হতে পারে। সে কারণে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অগ্রিম সতর্কতা হিসেবে একসঙ্গে ৫ লাখ মেট্রিক টন গম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

১৭ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার গমের এফওবি মূল্য ছিল ৩৩৪ দশমিক ২৫ ডলার। প্রতিনিয়ত গমের এফওবি মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। জিটুজির পূর্ববর্তী দুটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে গমের ক্রয়মূল্য ছিল যথাক্রমে ৪৭৬ দশমিক ৩৮ এবং ৪৪৮ দশমিক ৩৩ মার্কিন ডলার।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, প্রডিনটর্গ রাশিয়ার গম রপ্তানির জন্য রাশিয়া সরকার থেকে মনোনীত করা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকার প্রডিনটর্গকে মনোনীত করেনি। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে প্রতিষ্ঠানটি জিটুজি ভিত্তিতে বাংলাদেশে গম সরবরাহ করে আসছে। রাশিয়া বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে জিটুজি কার্যক্রমে অন্যান্য দেশের ন্যায় গম সরবরাহ করে আসছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ ৩ লাখ টন গম যথাসময়ে নিয়মমাফিক বাংলাদেশকে সরবরাহ করেছে। ২০২০-২১ সালে করোনাকালে ২ লাখ টন চুক্তিবদ্ধ ছিল। প্রতিকূলতার মধ্যে ও তারা ১ লাখ মেট্রিক টন গম সরবরাহ করে। পূর্ববর্তী ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ ২ লাখ মেট্রিক টন গম বাংলাদেশকে সঠিকভাবে সরবরাহ করেছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রডিনটর্গ মোট ৪  লাখ মেট্রিক টন গম সঠিকভাবে সরবরাহ করেছে।

বিশ্বের কোনো দেশ প্রডিনটর্গের সঙ্গে চুক্তি করে তা বাতিল করেছে কি না, কিংবা কেন করেছে, এর বিস্তারিত তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। খাদ্য মন্ত্রণালয় মনে করে সঠিক তথ্য গোপন করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছে টিআইবি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এ ষড়যন্ত্র করছে তারা।