সার্ভারে ঢুকে জন্মনিবন্ধন সনদ দিত চক্রটি

সার্ভার হ্যাক করে জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতির অভিযোগে এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে চট্টগ্রাম পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

জালিয়াতির মাধ্যমে ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় জন্মনিবন্ধন সনদ দিত চক্রটি। সরকারি সার্ভার হ্যাক করে তাঁরা এ কাজটি করতেন। তিন হ্যাকারসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের চট্টগ্রাম কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এ তথ্য জানিয়েছে।

গ্রেপ্তার পাঁচজন হলেন—সাগর আহমেদ ওরফে জোভান, শেখ সেজান, মেহেদী হাসান, শাকিল হোসেন ও মাসুদ রানা। পুলিশ বলছে, তাঁদের মধ্যে সেজান, শাকিল ও মাসুদ রানা হ্যাকার। বাকি দুজন তাঁদের সহযোগী। গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে চারজনের পড়াশোনা বেশি না হলেও মেহেদী হাসান সোনার গাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম, নড়াইল, ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের উপকমিশনার মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খান আজ রোববার দুপুরে নগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার দুই আসামির জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিন হ্যাকারসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্মনিবন্ধন অফিসের অফিশিয়াল সিল, অফিসের প্যাড, সিপিইউ, মনিটর, ল্যাপটপ, প্রিন্টার উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা চট্টগ্রাম, ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনসহ ফরিদপুর, বাগেরহাট, নরসিংদী জেলায় কয়েক হাজারের বেশি জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

জন্মনিবন্ধন জালিয়াতিতে গ্রেপ্তার পাঁচজনের কাছ থেকে এসব সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

লিয়াকত আলী খান আরও বলেন, একাধিক চক্র এ অবৈধ কার্যক্রমে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রতিটি জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরিতে তাঁরা ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা করে নেন। পরবর্তী সময় ওই ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাঁরা সরকারনির্ধারিত জন্মনিবন্ধন ওয়েবসাইটে ওই ব্যক্তির ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে প্রাথমিক নিবন্ধন করে। ওই তথ্য তথাকথিত একজন হ্যাকারকে দেন। হ্যাকার অবৈধভাবে জন্মনিবন্ধন সার্ভারে প্রবেশ করে একটি জাল সনদ প্রস্তুত করে পুনরায় চক্রের সদস্যদের কাছে দেন।

অবৈধভাবে হ্যাকারদের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন সনদ না নিতে লোকজনকে অনুরোধ জানান পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলী খান। তিনি বলেন, অবৈধভাবে নেওয়া এই সনদ শুধু সার্ভারে দেখা যাবে। কিন্তু সনদে কাউন্সিলরের সিল ও সই সবই জাল। পরবর্তী সময় এ সনদ নিয়ে বিপাকে পড়েন লোকজন। বাড়তি টাকা দিয়ে দালালদের মাধ্যমে জাল সনদ না নিয়ে বৈধভাবে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

যেভাবে হ্যাক করে

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত উপকমিশনার আসিফ মহিউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, কুকিজের (কুকিজ হলো ইন্টারনেট ব্রাউজারের ক্যাশ মেমোরিতে জমা হওয়া কিছু ফাইল। যখন বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ভিজিট করা হয়, তখন এই কুকিজগুলো ভিজিটকারীর ব্রাউজারে সেভ হয়ে থাকে) মাধ্যমে সরকারি জন্মনিবন্ধন সার্ভারে (লগইন) ঢুকে পাসওয়ার্ডসহ সব তথ্য নিয়ে নেন হ্যাকাররা। আইডি, পাসওয়ার্ডসহ নির্দিষ্ট সময়ের লগইন সেশন চুরি করে নেন হ্যাকাররা এবং পরবর্তী সময় চুরি করা কুকিজ তথ্য থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ব্যবহার করে মূল সার্ভারে প্রবেশ করে জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির কাজটি করে থাকেন।

আসিফ মহিউদ্দীন আরও বলেন, তাঁরা দীর্ঘদিন থেকে এটি অবৈধভাবে করে আসছেন। তবে গত জানুয়ারিতে থেকে আর পারছেন না। কারণ, এখন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারীর কাছে ওটিপি আসে। সেটি সার্ভারে দিতে হয়। গ্রেপ্তার পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে জানান আসিফ মহিউদ্দিন। চক্রের বাকি সদস্যদের সম্পর্কে পাওয়া তথ্যগুলো তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে যাচাই-বাছাই করা হবে।

গত ৮ থেকে ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫টি ওয়ার্ডের আইডি ব্যবহার করে সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে ৫৪৭টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। সবশেষ ২৪ জানুয়ারি নগরের লালখান বাজার ওয়ার্ডে ১৩৩টি জন্মসনদ অবৈধভাবে ইস্যু হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতির ঘটনায় এখন পর্যন্ত হওয়া চারটি মামলাই তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বরখাস্ত অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনসহ এই পর্যন্ত ৪টি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ১১ জনকে। গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া তিন হ্যাকার ছাড়া বাকিরা সবাই দোকানি।