গত বছর ১০৯৮ নম্বরে শিশু নির্যাতন–সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কল

শিশু নির্যাতনপ্রতীকী ছবি

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার এতিম মেয়েটি (১৭) মামার সংসারে থাকে। গত বছরের অক্টোবর মাসে মেয়েটিকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে। ঘটনার পর ক্ষোভে আত্মহত্যার চেষ্টা করে মেয়েটি। পরে তার মামা প্রতিবেশীর পরামর্শে চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ নম্বরে কল করে সাহায্য চান। ১০৯৮ থেকে স্থানীয় সমাজসেবা কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত চারজনকে পরে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮–এ গত বছর শিশু নির্যাতনের ঘটনা জানিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক কল এসেছে। এ সংখ্যা ১৫ হাজার ৭৮৫টি, যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০২২ সালে নম্বরটিতে এ ধরনের অভিযোগ জানিয়ে কল এসেছে ৮ হাজার ২১টি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ হেল্পলাইন প্রতিষ্ঠার পর থেকে শুধু শিশুর প্রতি সহিংসতা নিয়ে এত বেশিসংখ্যক কল আর কখনো আসেনি।

‘গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব নয়, শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে কি না। তবে আগের চেয়ে ১০৯৮ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। নম্বরটি লোকজনের কাছে পরিচিত হচ্ছে। অনেকে এখন জানেন, শিশুরা সমস্যায় পড়লে এখানে কল করা যাবে এবং সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। সেই আস্থা থেকেও কলের সংখ্যা বাড়তে পারে।
’—জামিলা আক্তার, ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ

শিশুর সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত এ হেল্পলাইনে নির্যাতন, আইনি সহায়তা, শারীরিক ও মানসিক সমস্যা, স্কুল–সম্পর্কিত বিষয়সহ নানা কারণে কল করে সাহায্য চায় শিশু নিজে বা তার মা–বাবা বা অভিভাবক বা অন্য কেউ।

যেমন সাতক্ষীরার তালা উপজেলা বাজারের একজন মুদিদোকানি ১০৯৮–এ কল করে জানান, তাঁর দোকানে ১৩ বছরের এক কর্মীকে পাশের দোকানের মালিক তুচ্ছ ঘটনায় বেধড়ক পেটাচ্ছে। ১০৯৮ থেকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং থানার ওসিকে অবহিত করা হয়। তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে শিশুটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরে ওই দোকানের মালিক ক্ষমা চান এবং এ ধরনের কাজ আর কখনো করবেন না বলে পুলিশের কাছে মুচলেকা দেন।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের (সিএসপিবি) আওতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ পরিচালিত হয়।

২০১০ সালে বেসরকারি সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের সঙ্গে পাইলট প্রকল্প আকারে এবং ২০১৬ সাল থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রম শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টায় পালা করে টোল ফ্রি এই নম্বরে আসা কল ধরেন ২৮ জন কল এজেন্ট।

শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কল বেশি আসা প্রসঙ্গে ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ জামিলা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব নয়, শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে কি না। তবে আগের চেয়ে ১০৯৮ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। নম্বরটি লোকজনের কাছে পরিচিত হচ্ছে। অনেকে এখন জানেন, শিশুরা সমস্যায় পড়লে এখানে কল করা যাবে এবং সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। সেই আস্থা থেকেও কলের সংখ্যা বাড়তে পারে।

গত বছর সোয়া তিন লাখ কল

১০৯৮–এ কলের কারণগুলো শুনলে শিশুদের সমস্যা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন এক কিশোরী অভিযোগ করে, তার বাবা মাদকাসক্ত এবং শাসনের নামে তাকে অতিরিক্ত মারধর করেন। ১০৯৮–এর সহায়তায় কিশোরীর বাসায় গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পায় পুলিশ। মেয়েকে আর নির্যাতন করবেন না জানিয়ে পুলিশের কাছে মুচলেকা দেন বাবা।

আরেক কিশোরীর মা–বাবা সন্তানকে দেখভালের জন্য একজন নারীকে নিয়োগ করেন। একপর্যায়ে ওই নারী তাঁর ২২ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে কিশোরীর পরিচয় করিয়ে দেন। ছেলেটি একটি জুতার দোকানে কাজ করেন। ধীরে ধীরে ওই নারী মেয়েটিকে নিজের ছেলের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকেন। একপর্যায়ে মেয়েটি ছেলেটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায় এবং কয়েক মাস আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।

১০৯৮–এ কল করে মা–বাবা সহায়তা চাওয়ার পর বরিশাল থেকে কিশোরীকে উদ্ধার করে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা) রাখা হয়।

১০৯৮–এ কল করে আরেক মা–বাবা অভিযোগ করেন, জেলা শহরের একটি মেধা প্রতিযোগিতায় তাঁদের মেয়ে অংশ নিয়ে প্রথম হয়েছিল। পরে অনিয়মের মাধ্যমে মেয়েটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাটি জানার পর মেয়েটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। একপর্যায়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। মেয়েটিকে এখন ১০৯৮–এর কাউন্সেলরদের মাধ্যমে নিয়মিত কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরে অবস্থিত ১০৯৮ হেল্পলাইন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে নম্বরটিতে মোট কল এসেছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৪১৪টি। মোট কলের মধ্যে বরাবরের মতো বিভিন্ন ধরনের তথ্য চেয়ে সবচেয়ে বেশি কল এসেছে। এ সংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজারের বেশি।

গত বছর শিশু নির্যাতন–সংক্রান্ত কল ছাড়াও আইনি বিষয়ে ১ হাজার ৬১৩টি, প্রেম–সম্পর্কিত বিষয়ে ১ হাজার ৮৯৩টি, মনোসামাজিক সমস্যা নিয়ে ৮ হাজার ৫২৮টি, শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ৮ হাজার ৩৯৯টি, স্কুল বিষয়ে ৬ হাজার ২৪৩টি, মাদক ব্যবহার–সংক্রান্ত ৬৩৬টি, ঝুঁকিতে থাকার বিষয়ে ৮ হাজার ২২৯টি, প্র্যাংক বা মজা করার জন্য কল ১৯ হাজার ১৯০টি এবং অন্যান্য কল এসেছে ৮৫ হাজার ৭২৯টি।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের (সিএসপিবি) আওতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ পরিচালিত হয়। ২০১০ সালে বেসরকারি সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের সঙ্গে পাইলট প্রকল্প আকারে এবং ২০১৬ সাল থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রম শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টায় পালা করে টোল ফ্রি এই নম্বরে আসা কল ধরেন ২৮ জন কল এজেন্ট।

২০২২ সালে মোট কল ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি, ২০২১ সালে প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার এবং ২০২০ সালে প্রায় ২ লাখ।

চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় শিশু নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর বা শিশু কোনো সমস্যায় পড়ার পর করণীয় জানতে মা–বাবা কল করেন। বিগত বছরগুলোতে শিশু নির্যাতন নিয়ে যত কল এসেছে, তার মধ্যে গত বছরই সবচেয়ে বেশি কল এসেছে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে কল তো এসেছেই। তিনি জানান, কলের প্রয়োজন অনুসারে স্থানীয় সমাজসেবা কর্মকর্তা বা সমাজকর্মী ঘটনাস্থলে যান। কোনো শিশুকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়, কারও মানসিক সহায়তার প্রয়োজন হয়। অনেক শিশু মা–বাবার মনোযোগ কম পায়, কথা বলার সুযোগ পায় না। মনোসামাজিক কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মা–বাবা সম্পর্কে শিশুর মনে যে ভুল ধারণা আছে, তা ভাঙা হয়।

অনেক কল ড্রপ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন বলেন, জনবলের ঘাটতি থাকায় কিছু কল ড্রপ হয়ে যায়।

চাইল্ড হেল্পলাইন থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে ইউনিসেফের জামিলা আক্তার বলেন, এটা শিশুর জীবন রক্ষাকারী সেবা। কারণ, এ ধরনের সেবার মাধ্যমে একটি অভিযোগের বিরুদ্ধে যখন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তখন এ ধরনের অপর কয়েকটি ঘটনা প্রতিরোধ হয়। তিনি জানান, ২০২৫ সাল থেকে ১০৯৮ হেল্পলাইনটি সম্পূর্ণভাবে পরিচালনা করবে সরকার। ইউনিসেফ শুধু কারিগরি সহায়তা দেবে। সরকার পরিচালনা শুরুর পর ১০৯৮-এ সেবার পরিসর ও জনবল আরও বাড়বে।