সড়কের ৫১% কাজ পেয়েছেন ‘প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ’ ৫ ঠিকাদার

সড়ক নির্মাণ ও মেরামতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১,১০০। তবে বেশি কাজ পায় গুটিকয় প্রতিষ্ঠান।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ঠিকাদারি কাজের অর্ধেক পেয়েছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে হিসাবে হারটি ৫১ শতাংশ। যদিও সড়ক ও জনপথে কাজ করে প্রায় ১ হাজার ১০০ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে এত বেশি কাজ পেয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

অর্ধেক কাজ পাওয়া পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, মুহাম্মদ আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, মো. মাহফুজ খান লিমিটেড ও হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠান মূলত সড়ক তৈরি, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ছোট ছোট কাজ করে। তবে সব মিলিয়ে কাজগুলোর টাকার অঙ্ক বড়—২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কিছু কাজ তারা যৌথভাবে পেয়েছে।

সওজ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০২২–২৩ অর্থবছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে তারা বরাদ্দ পেয়েছিল ২৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলমান কাজের বরাদ্দ বাদ দিলে নতুন কাজের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। ফলে দেখা যাচ্ছে, অর্থমূল্যের দিক দিয়ে মোট নতুন কাজের প্রায় অর্ধেক পেয়েছেন পাঁচ ঠিকাদার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত নন। তবে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেন। অভিযোগ রয়েছে, কাজ পেতে ঠিকাদারেরা কমিশন দেন এবং উপহার ও অন্যান্য ব্যবস্থা থাকে। 

ঠিকাদারের সঙ্গে সওজ অধিদপ্তরের কোনো কোনো প্রকৌশলীর যোগসাজশ রয়েছে। নাম এসেছে তিনজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর, যাঁরা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ‘বিশেষ পছন্দের’ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।

অতীতে দেখা যেত, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ ঠিকাদারদের দরপত্র জমা দিতে বাধা দিতেন। সেটি থামাতে ২০১১ সালে চালু হয় ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট ব্যবস্থা (ই-জিপি), যেখানে অনলাইনে দরপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়, যাতে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায়ও যে সুফল পাওয়া যায়নি, তা স্পষ্ট হয়েছে ঘুরেফিরে গুটিকয় ঠিকাদারের কাজ পাওয়ার মাধ্যমে। 

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী মনে করেন, ই-জিপি দরপত্রপ্রক্রিয়ায় কিছুটা গলদ রয়েছে। এ কারণে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি সব মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়েছে। দরপত্রপ্রক্রিয়া সংস্কারে কাজ করছে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিউ)। 

ই-জিপি পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা ‘সিন্ডিকেট’ তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন—এমন অভিযোগ সম্পর্কে সচিব বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

অবশ্য কারও কারও মতে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের অপেক্ষায় থাকার কথা বলাটা দায় এড়ানোর কৌশল। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় চাইলে নিজেরাই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। যাঁদের বিরুদ্ধে পছন্দের ঠিকাদারদের অনৈতিক সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বদলি করে দিতে পারে। অসৎ কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব চাইতে পারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু কোনো কিছুই করা হয় না; কারণ, রাজনৈতিক ইচ্ছা নেই। 

বিভিন্ন সময়ে সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তাঁর ভাই মির্জা আবদুল কাদের ও সওজ বিভাগের প্রকৌশলীদের সঙ্গে নিজের ছবি ফেসবুকে দিয়েছেন আবেদ মনসুর। 

কত কাজ তারা পেয়েছে

ছবি: সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং সিপিটিইউ সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সওজ অধিদপ্তরের অধীনে প্রায় ৫ হাজার ২০০ দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ২ হাজার ৬৬০টি, যা মোট কাজের ৫১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের চিত্রও মোটামুটি একই ছিল। 

২০১৮ সাল থেকে সব ঠিকাদারি কাজের হিসাব রাখা শুরু করে সিপিটিউ। পাঁচ বছরের হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন লিমিটেড—সংখ্যা ৩ হাজার ১০০টির মতো। এককভাবে তারা পেয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কাজ। আবেদ মনসুরের অধীনে এখন চলমান কাজ ২১৮টি। এগুলোর মূল্য প্রায় ১৭৬ কোটি টাকা। 

আরও পড়ুন

আবেদ মনসুরের বাড়ি নোয়াখালী। তিনি সওজ অধিদপ্তরে ঠিকাদারি শুরু করেন বছর সাতেক আগে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের পেজে তিনি ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী ও রাজনীতিক বলে পরিচয় দেন। বিভিন্ন সময়ে সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তাঁর ভাই মির্জা আবদুল কাদের ও সওজ বিভাগের প্রকৌশলীদের সঙ্গে নিজের ছবি ফেসবুকে দিয়েছেন আবেদ মনসুর। 

ঠিকাদার আবেদ মনসুর চীনে রয়েছেন। তাঁর মুঠোফোন নম্বরে ফোন করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।

পাঁচ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮০০টি ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন আমিনুল হক। এসব কাজের মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আমিনুল হকের বাড়ি নওগাঁয়। তবে সওজ অধিদপ্তরের প্রতিটি বিভাগীয় (জেলা) কার্যালয়ে তিনি কাজ করেন। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠানের অধীনে ৪০০ কোটি টাকার ২০০টি কাজ চলমান।

গত দুই অর্থবছরের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে নেই ঠিকাদার দেলোয়ার হোসেন বাবুল। তবে পাঁচ বছরের হিসাবে কাজ পাওয়ার দিক দিয়ে তৃতীয় তিনি। পেয়েছেন প্রায় ১ হাজার ১৫০টি কাজ, যার অর্থমূল্য ১৭০ কোটি টাকা।

দুই অর্থবছর ও পাঁচ বছরের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে রয়েছে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠান পাঁচ বছরে ১ হাজার ১০০টি কাজ করেছে, যার অর্থমূল্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। 

মোজাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মোজাহারুল হকের বাড়ি খুলনায়। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক স্থানীয় একটি প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ঠিকাদারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁর অধীনে বর্তমানে ৮৭টি কাজ চলমান। 

পাঁচ বছরের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশী) লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা পেয়েছে ৭৫০টি কাজ। এসব কাজের অর্থমূল্য বেশি—প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মঈনউদ্দিন। 

দুই অর্থবছরের শীর্ষ তালিকায় নাম রয়েছে হাসান টেকনোর। তারা পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক ঠিকাদারি কাজ করেছে, যার অর্থমূল্য প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। হাসান টেকনোর মালিক নাজমুল হাসানের বাড়ি চাঁদপুরে।

দুই অর্থবছরের শীর্ষ তালিকায় থাকা আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম মো. মাহফুজ খান লিমিটেড। তারা পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক কাজ করেছে। মাহফুজ খানের বাড়ি বরিশালে। ওই অঞ্চলে সওজ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি কাজ একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। স্থানীয় সূত্র বলছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে।

বেশি কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার কারণে তারা বেশি কাজ পেয়েছে। যেমন আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ভালো কাজ করেন বলেই বেশি কাজ পান। অন্যদিকে বরিশালের ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক রাজনৈতিক পরিবারের আশীর্বাদকে ‘বানানো কথা’ বলে দাবি করেন ঠিকাদার মাহফুজ খান। 

ভালো কাজ ঠিকাদারেরা কতটুকু করেন, তা সড়কেই স্পষ্ট। সওজ নতুন সড়ক করার ক্ষেত্রে তা ২০ বছর চলাচলের উপযোগী থাকবে বলে ধরে নেয়। কিন্তু দেখা যায়, কয়েক বছর পরপরই সড়ক মেরামত করতে হয়। জনগণের বিপুল অর্থ ঠিকই ব্যয় হয়।

সওজ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে পরবর্তী ১০ অর্থবছরে তারা ব্যয় করেছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় ২০১৭ সালে জানিয়েছিল, প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশ। এই বাড়তি খরচের জন্য দায়ী উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া এবং দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকা। 

সাম্প্রতিক কালে বড় অঙ্কের কাজ পাওয়া বাকি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এমএম বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, আবদুল মোনেম লিমিটেড, মীর আক্তার হোসেন, তমা কনস্ট্রাকশন, ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং, তাহের ব্রাদার্স, ওহিদুজ্জামান চৌধুরী, র‍্যাব-আরসি লিমিটেড, জন্মভূমি নির্মাতা, সালেহ আহমেদ প্রভৃতি। 

কাজ কেন ছোট হয় 

সওজ সূত্র বলছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা সংস্থাটির ঠিকাদারি কাজের বেশির ভাগকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করেন। বেশির ভাগ কাজ থাকে এক লাখ থেকে এক কোটি টাকার মধ্যে। কারণ, ছোট কাজের ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে বিল দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয় সংশ্লিষ্ট জোনের (অঞ্চলের কার্যালয়) মধ্যে।

ছোট ছোট কাজ ভাগ করে দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, বৃষ্টি হলেই রাস্তায় গর্ত হয়। এসব কাজ সব সময় করতে হয়। এ জন্যই ছোট দরপত্র হয়। 

আরও পড়ুন

সওজ অধিদপ্তরের ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত মাঝারি ব্যয়ের মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও নির্মাণকাজেরও দরপত্রপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় অঞ্চলের মধ্যে। এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। অভিযোগ রয়েছে, যোগসাজশ ও ‘কমিশনের’ ভাগাভাগি হয় অঞ্চলের মধ্যেই। 

বড় বড় সড়ক ও সেতু নির্মাণকাজের অনুমোদন নিতে হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) থেকে। 

ঠিকাদারেরা নিজেরা নিজেরা একেক অঞ্চল ভাগ করে নিয়ে কাজ পাচ্ছেন। তাঁরা চাইলেও ঠেকাতে পারছেন না। গাজীপুর ও মানিকগঞ্জে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বেশির ভাগ কাজ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান

বড় কাজ বেশি পায় যারা

সওজ অধিদপ্তরের বড় কাজে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করে। সেগুলোর বেশির ভাগই চীনের বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশি ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান যৌথ ও এককভাবে বড় কাজ করছে। তারা সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি কাজ পেয়েছে। 

বড় কাজ পাওয়া শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই)। ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এনডিই ৪২টি কাজ পেয়েছে, যার মূল্য ৩ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি সওজ অধিদপ্তরে নতুন। তবে তারা কাজ বেশি পাচ্ছে। সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছে সওজ সূত্র।

ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানিটি গঠন করা হয়েছে বছর আটেক আগে। গঠনের পরই মেঘনা-গোমতী সেতুর মেরামতকাজ পেয়ে আলোচনার জন্ম দেয় তারা। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, নোয়াখালী জেলার সড়ক উন্নয়নকাজসহ বিভিন্ন কাজ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আলী হায়দার ওরফে রতনের বাড়ি নোয়াখালীতে। রতন নিজেকে একসময় একজন মন্ত্রীর ভাগনে পরিচয় দিতেন। 

সাম্প্রতিক কালে বড় অঙ্কের কাজ পাওয়া বাকি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এমএম বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, আবদুল মোনেম লিমিটেড, মীর আক্তার হোসেন, তমা কনস্ট্রাকশন, ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং, তাহের ব্রাদার্স, ওহিদুজ্জামান চৌধুরী, র‍্যাব-আরসি লিমিটেড, জন্মভূমি নির্মাতা, সালেহ আহমেদ প্রভৃতি। 

ঠিকাদার-প্রকৌশলী ‘যোগসাজশ’

কোনো ঠিকাদারি কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় ঠিকাদারের জানার কথা নয়। তবে সূত্র বলছে, অসৎ কর্মকর্তারা ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের কাছে সেটি প্রকাশ করে দেন। ফলে সব ঠিকাদার ১০ শতাংশ ছাড়ে দরপত্র জমা দেন। এতে সবার দরই এক হয়ে যায়। তখন অতীত পারদর্শিতা মূল্যায়ন (পাস্ট পারফরম্যান্স ইভল্যুশন ম্যাট্রিক্স) পদ্ধতিতে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে অতীতে যিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন, তিনিই আবার কাজ পেয়ে যান। 

দীর্ঘদিন ধরে সওজ অধিদপ্তরে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি (ওটিএম) ও সীমিত ঠিকাদারের মধ্যে দরপত্র (এলটিএম) পদ্ধতি চালু রয়েছে। ২০২১ সালে এক ধাপ দুই খাম (ওএসটিইএম) পদ্ধতি চালু করা হয়। কোনো পদ্ধতিতেই গুটিকয় ঠিকাদারের কাজ পাওয়া বন্ধ হচ্ছে না।

সওজ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, যে কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন, তাঁর সততা না থাকলে কোনো পদ্ধতিই কাজে আসবে না। কিন্তু যাঁদের বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের অনৈতিক সহায়তা করার অভিযোগ, তাঁরাই ঘুরেফিরে বড় দায়িত্ব পান। 

সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের মধ্যে ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান আলোচিত। তিনি ২০০৯ সালের পর থেকে ঘুরেফিরে মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকা—এই তিন কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। আট বছর দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও একই অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে। যেটি এই অধিদপ্তরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এলাকা। তাঁর বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।

অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে সবুজ উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদারেরা নিজেরা নিজেরা একেক অঞ্চল ভাগ করে নিয়ে কাজ পাচ্ছেন। তাঁরা চাইলেও ঠেকাতে পারছেন না। গাজীপুর ও মানিকগঞ্জে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বেশির ভাগ কাজ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

সওজ অধিদপ্তরের কুমিল্লা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু হেনা তারেক ইকবালের বিরুদ্ধেও ঠিকাদারদের অনৈতিক সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। তাঁকে ঘুরেফিরে এমন জায়গায় বদলি করা হয়, যেখানে কাজ বেশি থাকে। তিনি এর আগে চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন। তাঁর বাড়ি ফেনী। সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ফজলে রাব্বির বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ। 

আবু হেনা তারেক ইকবাল ও ফজলে রাব্বী গুটিকয় ঠিকাদারের বেশি কাজ পাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবস্থাকে (সিস্টেম) দায়ী করেছেন। তবে তাঁরা বলছেন, ঠিকাদারদের অংশগ্রহণ যতটা বেশি হওয়ার কথা, ততটা হয় না। ঠিকাদারেরা নিজেরা ‘সিন্ডিকেট’ করে এলাকা ভাগ করে নিয়েছে কি না, সেটা দেখা যেতে পারে।

প্রকৌশলীরা পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে সহায়তা করছেন—এমন অভিযোগ সম্পর্কে তারেক ইকবাল বলেন, ‘এই অভিযোগে জন্ম থেকেই জ্বলছি। এগুলো ঠিক নয়।’

এই তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ঠিকাদারকে অনৈতিক সহায়তার অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ এই যে সওজ অধিদপ্তরের আরও কিছু প্রভাবশালী প্রকৌশলী ঠিকাদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেন। 

‘জনগণ সুফল থেকে বঞ্চিত’

২০২০ সালের নভেম্বরে একনেকের সভায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনেক কাজ পাওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তখন একটি কাজ শেষ না করলে অন্য কাজ না দেওয়ার নির্দেশনা দেন। এ বিষয়ে পরে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দপ্তরে নির্দেশনা দিয়ে সিপিটিইউ থেকে চিঠিও দেওয়া হয়। 

২০২২ সালের অক্টোবরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১৬তম বৈঠকে সওজ অধিদপ্তরের ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে দরপত্রে অধিকসংখ্যক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির সুপারিশ করা হয়। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২১তম সভায় কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান বলেন, পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে সওজের কাজ পাচ্ছে। তিনি এটাকে রহস্যজনক ও দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত বলে মন্তব্য করেন।

জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক মিলিয়ে সওজ অধিদপ্তরের অধীনে সড়ক আছে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার। ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক জরিপ অনুসারে, সড়কের খারাপ অবস্থার দিক থেকে তখন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় ছিল। সড়কের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। 

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এক গবেষণায়ও এভাবে ‘সিন্ডিকেট’ করে সওজের ঠিকাদারি কাজ বাগানোর তথ্য পেয়েছেন। তিনি বলেন, রাজনীতিক, প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মিলে এই ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি হয়েছে। তিন পক্ষ এক হয়ে যে যোগসাজশ গড়ে তুলেছে, তা অসততা ও দুর্নীতি। তিনি বলেন, এর ফলে ঠিকাদারি কাজের মান খারাপ হচ্ছে। কদিন পরই মেরামতের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় হচ্ছে; কিন্তু জনগণ সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।